জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রশ্নে ধর্মীয় নেতৃত্ব কতটা কার্যকরী, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন হচ্ছে। হচ্ছে এই কারণেই যে বিগত দুই দশক, বা কোথাও তার অধিক সময় ধরে নিম্নজাতির অধিকার অর্জনের প্রশ্নটি অধরাই রয়ে গেছে। তার বদলে যা হয়েছে, তা হল সেই ধর্মীয় নেতা ও তার পরিবারের প্রতিপত্তি ও স্বচ্ছলতাবৃদ্ধি। উদাহরণস্বরূপ মতুয়া গোষ্ঠীকেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

‘মতুয়া’, বা যাদের ‘নমঃশূদ্র’ বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমবঙ্গের তফশীলী জাতির মোট জনসংখ্যার যারা ১৮ শতাংশ (২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে), তাদের নেতৃত্বে ধর্মীয় গুরুই সাযুজ্যপূর্ণ নাকি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের তাগিদে উঠে আসা কোনো নয়া নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে?

একদিকে বড়মা বীণাপাণি দেবী ও এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে মেরুদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে মতুয়াদের ভোটের অংকটি সুন্দরভাবে কষে নিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে মন্ত্রীত্বও প্রদান করেছে তৃণমূল সরকার। এমনকি বড়মার বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরও বনগাঁর তৃণমূলের নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছেন। মমতাবালা ঠাকুর এখন সেখানকার তৃণমূলের এমপি। এবারেও টিকিট পেয়েছেন। এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ধর্মীয় গুরুদের নেতৃত্বে আসলে কারা উপকৃত হচ্ছে, বলাই বাহুল্য লাস্যময় জীবনযাপন করছে। কার্যত পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই জায়গা করে নিয়েছে মতুয়া গোষ্ঠীর মধ্যে। অথচ মতুয়াদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, বেকারত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে যা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলেরই মাথাব্যাথা নেই। ডান-বাম নির্বিশেষে বৃন্দা কারাট-বিমান বসু-গৌতম দেব থেকে রাহুল-মমতা-মোদী সকলেই মতুয়া ভোটের হিসেব বুঝে নিতে বড়মার পা ছুঁতে চলে এসেছেন ভোটের আবহ এলেই। অন্যদিকে ২০০৩-এর ‘সিটিজেন আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুসারে মতুয়াদের একটি বড় অংশের ভারতীয় নাগরিকত্বই স্বীকৃত নয়। অথচ সেই বিষয় নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটা বড়মা, তার দুই পুত্র এবং এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে সদ্য বড়মার পা ছুঁয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী সকলেরই। বীণাপাণি দেবীর প্রয়াণের পরে নেতৃত্বের প্রশ্নে শুরু হয়েছে নতুন কোন্দল…

এখন বুঝতে হবে, মতুয়াদের জাতিগত শোষণের বিষয়টি তাদের ধর্মীয় অবস্থানের কারণে নয়; এই বিষয়টি সম্পূর্নভাবে সম্পত্তি সম্পর্ক, পেশা এবং অর্থনৈতিক অবস্থানভিত্তিক। জাতিগত বঞ্চনার নামে আদতে এই সংখ্যালঘু জাতিগুলির ওপর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শোষন চালানো হয়। শোষন চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রতিটি ক্ষেত্রতেই। তাই, সমানাধিকারের লড়াইয়ের এই প্রশ্নটি তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের লড়াইয়ের থেকে ভিন্ন কিছুই নয়। এবং অর্থনৈতিক শ্রেণিসংগ্রামই পারে তাদের জাতিগত অধিকারও প্রতিষ্ঠিত করতে।

সেই হরিচাঁদ ঠাকুরের হাত ধরে যে ধর্মীয় নেতৃত্ব উঠে এসেছিল, পরিবারতন্ত্রের শিকড় বেয়ে তা আজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগের রসে নিমজ্জিত হয়ে সমগ্র মতুয়া জাতির জাতিগত অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার এবং সর্বোপরি তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের লড়াই হারিয়ে যেতে বসেছে কারণ তা কোনোভাবেই কোনো ধর্মীয় গুরু বা ধর্মীয় নেতৃত্বের হাত ধরে সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক শ্রেণিসংগ্রামের দাবীকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা লড়াই এবং শ্রেণিচেতনা সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা সামগ্রিকভাবে মতুয়াদের সমস্তরকম অধিকার আদায়ের লক্ষেই সংগ্রামকে পরিচালিত করবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *