নিজস্ব সংবাদদাতা, কাকদ্বীপঃ বর্ষা নামবে, আর এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে টাটকা ইলিশ পাবে না, তা কী হয়! তারপর আবার পেট টিপে পছন্দ না হলেই নাক বেঁকিয়ে পাশের দোকানে যাত্রা। মাছের ব্যাপারে আমরা ভীষণ খুঁতখুঁতে। তাই উচ্চমানের তাজা ইলিশ খুঁজে আনতে নিজেদের জীবনের ঝুঁকিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বর্ষা এলেই পঞ্চাশ হাজারের ওপর মৎসজীবী প্রতি বছর পাড়ি দেন মাঝসাগরে, ‘ব্যবসা এবার আর একটু ভালো হবে’ এই আশা বুকে বেঁধে। ইতিমধ্যেই তারা নেমে পড়েছেন সাগরে। প্রায় ১৬হাজার ট্রলার এবং ৪হাজারের বেশি ছোট নৌকা নেমেছে মাছ সংগ্রহের কাজে।
 
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক বিজন মাইতি
 
এই বছর ইলিশের ফলন বেশ ভালোই হওয়ার কথা। বর্ষা দেরীতে ঢুকলেও, আগের বছর ছোট ইলিশ মাছ তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে এই বছর উন্নত মানের ব্যাপক পরিমাণে ইলিশ সংগ্রহ করতে পারবেন এমনটাই আশা মৎস্যজীবীদের। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক বিজন মাইতি জানিয়েছেন, “১৫ই এপ্রিল থেকে ১৪ই জুন ইলিশের ব্রিডিং পিরিয়ড। ১৫ই জুন থেকে মৎস্যজীবীরা ট্রলার নিয়ে সাগরে যাচ্ছেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় প্রায় ৬-৭ হাজার ট্রলার প্রস্তুতি নিয়েছে। ১৫ তারিখ থেকেই নেমে পড়েছে।” 
 
বাদল দাসের বয়ান
 
মাছের পরিমাণ কম হলে প্রায় দ্বিগুন বা কখনো তারও বেশি দাম দিয়ে মাছ কিনতে হয় বলে জানিয়েছেন মাছ বিক্রেতা রবীন মজুমদার। তাই তারাও চান যেন ফলন বেশি হয়। এই কাজে ব্যাপক ঝুঁকি থাকে মৎস্যজীবীদের এবং নিরাপত্তার বন্দোবস্তও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদেরই করতে হয় কারণ সরকারি যাবতীয় সুরক্ষাব্যবস্থা ও সমস্তরকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় নির্বাচিত কিছু মানুষকেই, দলীয় ক্ষমতার প্রভাব এখানেও ফলান মৎস্যবিভাগের দায়িত্বরত কর্মীরা এবং তার মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরানোর জন্য সরকারি সহায়তার একাংশ বাঁচিয়ে রাখেন। 
এই প্রসঙ্গে বাদল দাস, একজন সাধারণ মৎস্যজীবী, বলেছেন “এখান থেকে আমাকে দেড় হাজার টাকা দিয়েছে। এই যে বেরোবো ৯ মাস সমুদ্রে থাকবো, কিছু জামা কিনেছি নিজের জন্য, কিছু টাকা বাড়িতে দিয়েছি, আমি রাজমিস্ত্রির কাজও জানি, কিন্তু এটাই আমার মূল জীবিকা।” বোঝাই যাচ্ছে সরকারি সহায়তার বিষয়টি ঠিক কতটা সহায়ক তাদের কাজের ক্ষেত্রে। যদিও মৎস্যবিভাগের তরফ থেকে মাছ চাষীদের সাথে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে এবং হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে লাগাতার যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আবহাওয়া ও সতর্কতা সংক্রান্ত সমস্ত খবর মাছচাষীদের নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে।
 
 
 
সবমিলে এই কাজে মাছচাষীদের এক বিপুল অঙ্কের খরচ জোগাতে হয় প্রাথমিক লগ্নেই কিন্তু ফাটকা কারবার আর ফোঁড়েদের দাদাগিরির ফলে বাজারদরের তুলনায় অনেক কম দামে মাছ ছেড়ে দিতে হয় মৎস্যজীবীদের! এমনকি বিদেশে সরবরাহের জন্য বরাদ্দ মাছের পরিমাণ বাড়ানোর ফলে আঞ্চলিক বাজারে ইলিশের দাম বেশি উঠলেও মৎস্যজীবীদের খুব সস্তায় সেই মাছ ছেড়ে দিতে হয়। ফলে বাজারে মাছের দাম দিনের পর দিন বেড়ে চললেও মৎস্যজীবীদের জীবনের কোনো উন্নতিই হয়নি গত কুড়ি বছরে। নিশ্চিত হয়নি তাদের জীবনের সুরক্ষাও। 
 
মাছ বিক্রেতা রবীন মজুমদার 
 
এই বর্ষায় কুর্নিশ ও সংগ্রামী অভিনন্দন মৎস্য চাষে নিযুক্ত এই শ্রমজীবীদের। বিদেশের তুলনায় দেশের বাজারের জন্য বেশি মাছ বরাদ্দ করা এবং সমস্ত মৎস্যজীবীদের জীবনের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করতে মৎস্যজীবী সংগঠনগুলির আন্দোলনরত হওয়া একান্ত কাম্য। নয়তো এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ বেশিদিন জুটবে না।
 
Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *