Assembly Election result 2021

২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল, এরাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে নিঃসন্দেহেই এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এই ফলাফলের বিশ্লেষণ করার আগে, গোটা ফলাফলকে এক কথায় চুম্বক করতে হলে সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয়, বিজেপির মতো একটি বর্বর, উগ্র-হিন্দুত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির সরকার গড়তে না পারাই মানুষের মতের বহিঃপ্রকাশ। একে আপাতভাবে মেহনতী জনতার জন্য ইতিবাচক বলেই মনে হয়। কিন্তু খোলা চোখে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে বলেই তো মনে হয় ! অতি-সরলীকরণ যে শুধু ভুলকে সামনে আনে তাই-ই নয়, তা ঠিককে খোঁজার রাস্তাও বন্ধ করে দেয়। মনে রাখা দরকার, এই নির্বাচন এরাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষের সামনে তিনটি প্রধান অশনি-সঙ্কেতকে হাজির করেছে : 

(ক) তীব্র জনবিরোধী, স্বৈরাচারী-একনায়কতান্ত্রিক-পরিবারতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও সম্পূর্ণ সমাজবিরোধী-কেন্দ্রিক শাসকদল, যা বৃহৎ-কর্পোরেট-প্রভুদের একান্ত পোষ্যদাস, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের আবারও সরকারে আসা;

(খ) গোটা বিধানসভাটাই বৃহৎ-পুঁজির দুই প্রত্যক্ষ এজেন্ট তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি-তে সম্পূর্ণরূপে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া, যা এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেও আগামী দিনে ব্যাপক শক্তি জোগাবে;

(গ) এবং সবচাইতে বিপজ্জনক, এই প্রথমবারের জন্য, পশ্চিমবাংলার বিধানসভা বাম-শূণ্য হওয়া, ও ফলতঃ বিধানসভায় “মেহনতী মানুষ”-শব্দটির একেবারেই “অফিশিয়ালি” একটি পরিত্যক্ত শব্দে পরিণত হওয়া।

সবার আগে, এই নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের বেছে নিতে হবে, নির্বাচনের ফলাফলের সেই সেই ‘আউটকাম’-গুলোকে, যেগুলি দিয়ে গোটা নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। আমরা, এই নির্বাচনে মূলত তিনটি প্রধান ‘পলিটিকাল আউটকাম’-কে চিহ্নিত করতে পারি : 

(১) বিজেপির পরাজয় ও তৃণমূল কংগ্রেসের পুণরুত্থান

(২)মূল ধারার বামেদের আদর্শহীনতা ও ‘সংযুক্ত মোর্চা’-র ‘জগাখিচুড়ি’

(৩) “নো ভোট টু বিজেপি”-র নামে নকশাল ও অভিজাত বাম শিবিরের ঘৃণ্য তৃণমূল-দালালি

(১) বিজেপির পরাজয় ও তৃণমূলের পুণরুত্থান

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ৪২ টি আসনের মধ্যে ১৮ টি আসনে জয়লাভ-ই প্রথমবারের জন্য বিজেপির একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রাধান্যকে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু তার পর ২০২১-এ তার প্রাধান্যের আরও বিস্তারের বদলে এভাবে হারের কারণ কী ? 

অনেকেই মনে করছেন এনআরসি-সিএএ একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে কাজ করেছে পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে। কিন্তু, প্রথমত, এরাজ্যে এনআরসি-সিএএ-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন (তখনও আইন পাশ না হওয়ায় “সিএএ”-র নাম ছিল “সিএবি”) শুরু হয় ২০১৮-এ আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর থেকেই, এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই তা যথেষ্ট গতি পায়; তার কোনও “নেগেটিভ” প্রভাব তো লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পায়নি ! দ্বিতীয়ত, এনআরসি-সিএএ-প্রশ্নে এরাজ্যে কংগ্রেস-সিপিআই(এম)-এর মিউ-মিউ স্বর আর অন্যদিকে “অভিজাত বাম”-দের পরিকল্পিতভাবে “নো এনআরসি”-আন্দোলনকে একদা এনআরসি-র পক্ষেই সওয়াল করা মমতা ব্যানার্জির হাতে তুলে দেওয়ার পরেও “সিএএ”-র পক্ষে প্রায় ৩ কোটি মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ও অন্যান্য উদ্বাস্তুদের প্রকাশ্য সমর্থন পাচ্ছিল বিজেপি। উপরন্তু টানা এক’দশকের তৃণমূল-সরকারের বল্গাহীন স্বৈরতন্ত্র, উপুর্যুপুরি স্ক্যাম, জনগণের টাকা নিয়ে নয়ছয় করা ও রাজ্যব্যপী সন্ত্রাস-দূর্বৃত্তির নজির এরাজ্যের মানুষের মনে তৃণমূলের প্রতি এক ব্যপক ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছে, যার সম্ভাব্য পরিণাম অনুভব করেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় তৃণমূল নেতারা বিজেপিতে যোগদান করতে থাকেন। যদিও এই “এনআরসি” ইস্যুই, বিশেষত “সিএএ” আইন পাস হওয়ার পর, মুসলমান সম্প্রদায়কে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে একজোট করে; এমনকি সিএএ পাশ হওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল সাংসদদের সংসদে ‘অ্যাবস্টেন’ করা ও ‘অ্যাবসেন্ট’ হওয়ার পরেও ! 

কেউ কেউ আবার মনে করছেন যে, বিধানসভা নির্বাচনের আগের একবছরে বেশী থেকে কম ওজনের বিভিন্ন তৃণমূল নেতাদের বিজেপিতে যোগদান ও তাদের বিজেপির টিকিট লাভের ঘটনা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় যে, কার্যত এই দলবদলের প্রধান দুই মুখ, তৃণমূলের প্রাক্তন দুই চোর-শিরোমনি ও অপকর্মের বাদশা মুকুল রায় ও শুভেন্দু অধিকারী (প্রথম জন সদ্য আবার তৃণমূলে ফিরেছেন), সারদা-নারদা-রোজভ্যালি সবেতেই যাদের দরাজ ভূমিকা, তারা কিন্তু দুজনেই জিতে বিধায়ক হলেন। এমনকি শুভেন্দু অধিকারী নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে দল বদলেও পরাজিত করলেন খোদ তৃণমূল-সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, তৃণমূলের উত্থানের উৎস সেই নন্দীগ্রামেই…। ফলে এই দলবদলই বিজেপির সরকারে আসতে না পারার কেন্দ্রীয় ও প্রধান কারণ হতে পারে না কখোনোই। 

অনেক অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ এবং বামপন্থী দলই (এমনকি সিপিআই(এম)-এর দলীয় বিবৃতিতেও) এই নির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের পিছনে তার আনা বিভিন্ন ‘সহায়তা প্রকল্প’-গুলিকে, যেমন যুবশ্রী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, খাদ্যসাথী, ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন। প্রথমত, এসব প্রকল্পের সুবিধা কত শতাংশ মানুষ বাস্তবে পান, তা কারোর অজানা নয়। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড-এর কথা ছেড়ে দিন, ২০১৮-১৯ সালে কন্যাশ্রীর ২৫ হাজার টাকা পেয়েছেন সরকারী তথ্য অনুযায়ী রাজ্যের ০.৭%-এর কম মেয়ে। দ্বিতীয়ত, এগুলির মধ্যে অধিকাংশই ২০১৯-এর অনেক আগে থেকে চলছে; এর জন্যই যদি তৃণমূল কংগ্রেস আজ মানুষের সমর্থন পেয়ে থাকে, তবে ২০১৯-এর লোকসভায় পেল না কেন, সে উত্তর মেলে না। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক আম্ফানে জনগণের প্রাপ্য কয়েক হাজার কোটি টাকা থেকে শুরু ক’রে বন্যায় ভেসে যাওয়া পরিবারগুলোর হকের চাল-ডাল-রেশন-ত্রিপল চুরি করার ঘটনায় যে তীব্র গণ-বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে, তা-ও তৃণমূলের জয়ের পিছনে এই সব “সহায়তা প্রকল্প”-এর কাহিনীকে “আষাঢ়ে গল্প” বলেই প্রমাণ করে। 

স্পষ্টতই, ২০২১-এর নির্বাচন, যা তৃণমূল কংগ্রেসকে এত বড় জয় এনে দিয়েছে, তা তৃণমূলের পক্ষে না, বরং বিজেপিকে রোখবার পক্ষে মানুষের মতের প্রকাশ। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ২০১৯-এর প্রশ্নাতীত সাফল্যের পর অতি-সম্প্রতি বিজেপি এমন কী করল, যার দরুন গোটা নির্বাচনী ফলাফলটাই তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে চলে গেল ? 

“এনআরসি-র থ্রেট”-এর সাথে সাথে “মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট”-এর বিজেপির “পোষা তোতা”-র মতো কলঙ্কজনক রামমন্দির-রায় এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডে বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে সরাসরি ক্লিনচিট-এর ঘৃণ্য সিদ্ধান্তও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে বিকল্প শক্তির অভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এই নির্বাচনে। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এত সংখ্যক মানুষ যারা তৃণমূল সরকারের পতন চেয়ে বিজেপির ব্যাপক উত্থান ঘটিয়েছিল ২০১৯-এ, তারা সকলে এক ধাক্কায় বিজেপি-র থেকে সরে গেল কেন ? কী ছিল সেই ধাক্কা, যা ২০১৯ আর ২০২১-এর মাঝে এসেছিল আপামর জনগণের ওপর ? 

২০২০-র “লকডাউন”! 

দেশের সিংহভাগ মানুষকে পিষে মেরে ফেলার হুকুমনামা ! 

যে বিষয়ে আমাদের মহান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ নির্লজ্জভাবে এড়িয়ে যাওয়ার পথ বাছেন, মেহনতী মানুষের কাছে যা বিভীষিকাময়, সেই “লকডাউন”!

কোভিড-১৯ “প্যান্ডেমিক” মোকাবিলার নামে কেন্দ্র সরকার ২৩ শে মার্চ চালু করে দেশব্যাপী “লকডাউন”, সরকারী তথ্যে যখন দিনে ৫০ জনের করোনা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছিল; আর সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের পেটের ভাত মেরে আড়াই মাস পরে “আনলক” শুরু করা হল যখন করোনার সংক্রমণ হচ্ছে দিনে ১০’হাজার মানুষের মধ্যে। সিংহভাগ মানুষ সহজেই অনুভব করেন যে করোনার সাথে এই লকডাউনের কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি মিডিয়া যতই টার্গেট করে করোনায় মৃত্যুর খবর ছড়াতে থাক, দেখা যায় গত বছর দেশে মোট যত মানুষ মারা গেছেন, তার মধ্যে কোভিডে মৃত্যু মাত্র ১.৫%। এটা সবচেয়ে সহজে অনুভব করেন সেই সকল খেটে খাওয়া গরীব মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত টিবি, নিউমোনিয়া, হার্টের রোগ ইত্যাদিতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় এর কয়েক গুণ হারে নিজের কাছের মানুষকে হারান; করোনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর অজুহাতে যাঁদেরকে অনাহারে আর বিনা চিকিৎসায় মারার পথে হাঁটে সরকার। কিন্তু এঁরাই সমাজের সিংহভাগ মানুষ।   

বর্তমান বিজেপি সরকার ও দেশের অন্যান্য সরকারের অগণিত অগণতান্ত্রিক ও মানুষখুনে সিদ্ধান্তসমূহের সাথে “লকডাউন”-এর মূল তফাৎ এই যে, এই “লকডাউন” একঝটকায় মাত্র তিন মাসে অসাম্যকে “আকাশ-পাতাল” করে তুলেছে; এই লকডাউন দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের (মাসে ২০ হাজার টাকার কম আয় করেন যাঁরা) আয় কেড়ে নিয়েছে ৩৭%, আর দেশের বিলিওনেয়ারদের আয় বাড়িয়ে তুলেছে ৩৫% ! আর যখন দেশের সাধারণ গরীব শ্রমজীবী মানুষকে নিংড়ে নেওয়ার এই যজ্ঞের আয়োজন করা হচ্ছিলো, মহান শিক্ষিত ডিগ্রীধারী মধ্যমিত্তরা থালা-বাটি বাজিয়ে আকাশে টর্চ জ্বালিয়ে থাকে সমর্থন জানাচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষের কাজ কেড়ে নেওয়া, লক্ষাধিক পরিযায়ী শ্রমিককে সহস্র মাইল পথ হাঁটতে বাধ্য করা, কোভিড-এর নামে এমনিতেই মুমূর্ষু স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বসিয়ে দেওয়া, কোভিড-বিধির নামে পুলিশ-প্রশাসনের নির্মমতম অত্যাচার— এসবই গত এক বছরের এই “অতিমারী”-অবস্থায় দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ও ফলে বিজেপির বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে দেশে ও আমাদের রাজ্যের বৃহত্তর অংশের জনগণকে একটি কেন্দ্র-বিরোধী ও ফলে বিজেপি-বিরোধী অবস্থানের দিকে সম্পূর্ণ ঠেলে দিয়েছে। এই লকডাউনকে বাস্তবায়িত করার কাজটি এরাজ্যে মমতা-সরকারের পুলিশ-প্রশাসন চরম নৃশংস গণ-নির্যাতনের মধ্যে দিয়েই করে, তবু গোটা দেশব্যপী কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত এই প্রকল্পের দায়ভার স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রের সরকারে আসীন দলের উপরেই বর্তে যায়; বিশেষত যখন এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার-আন্দোলনের অভাব থাকে। এর নমুনা কেবল তাই আমাদের রাজ্যেই নয়, বরং এইসময় হওয়া অন্যান্য নির্বাচনগুলোতেও দেখা গেছে। লকডাউন ও তার পরবর্তীতে হওয়া সবকটি বিধানসভা নির্বাচন, যেমন বিহার, আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা সর্বত্রই বিজেপির সমর্থন কমেছে লোকসভার তুলনায়। বিহারে ও আসামে সরকার গড়লেও, ফলাফল এমনকি আগের বিধানসভার থেকে বেশ খারাপ হয়েছে। 

এরাজ্যে তৃণমূলের সরকারে আসাকে, তাই তৃণমূলের জয় হিসেবে নয়, বরং বিজেপি-র অন্যান্য জনবিরোধী কার্যকলাপের সাথে প্রধানত “লকডাউন-বিরোধী গণক্ষোভ”-এর বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা যায়। একই সাথে বিকল্প সংগ্রামী জনশক্তির বিকাশ ঘটতে না পারাও এর যুগপৎ কারণ। 

(২) মূল ধারার বামেদের আদর্শহীনতা ও ‘সংযুক্ত মোর্চা’-র ‘জগাখিচুড়ি’ 

২০২১-এর বিধানসভায় সমস্ত ফলাফলের মধ্যে, তৃণমূল নাকি বিজেপি — এই পোলারাইজড টানাপড়েনের মধ্যে, সবচাইতে নিঃসন্দেহ ও/বা সবচেয়ে সম্ভাব্য, সবচাইতে সহজে অনুমেয় ফলাফল ছিলো সংযুক্ত মোর্চার সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়া ও সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামেদের শূণ্য হয়ে যাওয়া। জাতীয় কংগ্রেস ও পীরজাদা আব্বাস-কে যথাক্রমে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র প্রতীক বানালে জনগণের চোখে যে নিজে আর ‘বাম’ থাকা যায় না— নির্বাচনে এই ‘বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ’ মোর্চার কুৎসিততম ফলাফল তারই অকাট্য প্রমাণ! 

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটনার কদর্য পরিণাম হিসাবে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ক্রমান্বয়ে এই বামেদের ফলাফলের রেখচিত্র যেভাবে নিম্নগামী থেকেছে, ১৩ বছরে তা অবশেষে সিটের বিচারে তাদের শূণ্যে নামিয়ে আনলো। বৃহৎ পুঁজিপতিদের দাক্ষিণ্যলাভের চেষ্টার সাথে ২০১৬ সাল থেকে যুক্ত হয়েছিল বৃহৎ পুঁজিপতিদের বৃহৎ এজেন্ট কংগ্রেস দলের স্থায়ী জুনিয়র পার্টনার হয়ে ওঠার আত্মঘাতী লাইন, যা তাদের নির্বাচনী ফলাফল এবং অপ্রতীকী আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংগঠনের দিক থেকে কার্যত হাপিস হয়ে যাওয়ার পথে ঠেলে দেয়। 

এরাজ্যে জোটের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো এই যে, বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে অ-বিজেপি ও অ-তৃণমূল শক্তিসমূহের সাথে নির্বাচনী আঁতাতের পথ খোলা রাখতে হবে। বিজেপি ও তৃণমূলের সাথে কংগ্রেসের শ্রেণীগত ফারাকটা কোথায়, তার কোনও উত্তর আছে ? যদি এমনকি শ্রেণীগত আদর্শের প্রশ্নটিকে কিছুক্ষণ সরিয়ে রাখি, কার্যত আড়াই দশক আগেই রাজ্য রাজনীতি থেকে মুছে যাওয়া শক্তিহীন-সামর্থ্যহীন কংগ্রেস যে কিভাবে এমনকি ভোটের বিচারেও ‘সহায়ক শক্তি’ হতে পারে, এই প্রাইমারী স্কুলের প্রশ্নটিরও কোনও উত্তর মেলে না ! উপরন্তু, দেশের মানুষ যাকে ২০১৪-র লোকসভাতে কেবল হারায়ইনি, এমনকি ২০১৯ এর লোকসভাতে তাকে ঐতিহাসিকভাবে সবচাইতে খারাপ ফল করিয়ে কার্যত কেন্দ্রীয় ভাবেও গোটা দেশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেই কংগ্রেস যে ঠিক কীভাবে জনগণের জন্য লড়াইয়ে সহায়ক হতে পারে, তারও কোনও উত্তর নেই। 

কার্যত সত্তর বছর ধ’রে যে কংগ্রেস দেশভাগ থেকে শুরু ক’রে শিখদাঙ্গা অব্দি সাম্প্রদায়িক হিংসার নজির গড়েছে, নব্বইয়ের দশকে উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রদায়িক টেন্সনে বিজেপি ও তার সহকারী শক্তিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করেছে, এবং হালে এমনকি রামমন্দির-বাবরি মসজিদ রায়ের পর যে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদিকা প্রিয়ঙ্কা গান্ধী উদ্বাহু নৃত্য করেছেন রাম-জন্মভূমি স্থাপনের আনন্দে, সেই কংগ্রেস হয়েছে এরাজ্যে বিজেপি-তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে নাকি সিপিএমের ‘মিত্রশক্তি’! পাগলের প্রলাপ বললেও কম বলা হয়না কি ! 

যে কংগ্রেস এ দেশে ‘নয়াউদারবাদ’-এর প্রধান প্রবক্তা, ‘নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে’ ঘোষণা (শুধুই ঘোষণা) করা সিপিআই(এম)-এর সে হলো জোটসঙ্গী ! কেবল ২০০৮ থেকে ২০১৪-এর মধ্যে (ইউপিএ-১ থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের পর) কয়লা, টু-জি, চপার, কমন ওয়েল্‌থ্‌, আইপিএল, আবাসন ইত্যাদি মিলিয়ে কয়েক’লক্ষ কোটি টাকার স্ক্যাম করে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার, যার জন্য ২০১৪-এ ইউপিএ-২ সরকারকে পদাঘাত করে দেশের জনগণ। সে সময় এরাজ্যে বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তেহারের ট্যাগলাইন ছিলো : “ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে”। কী অদ্ভুত, যে, ২০১৪ সালে যে কংগ্রেস ছিলো “ফুটন্ত কড়াই”, দুবছরের মধ্যে সেই কড়াইতেই জলকেলির বাসনা নিলেন এরাজ্যের সিপিআই(এম)-নেতৃত্ব ! 

অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সিপিআই(এম) যেহেতু জন্মই নিয়েছিলো, প্রথমত, প্রধানত কংগ্রেসের সাথে কমিউনিস্টদের যুক্তমোর্চা বানানোর শোধনবাদী লাইনের বিরোধিতা ক’রে এবং দ্বিতীয়ত, মেহনতী-জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের ‘ম্যাসকট’ হিসেবে— ফলে, পঞ্চাশ বছর পর এসে এই দুইকেই খারিজ করার আঁত্মঘাতী পথ, তার সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা দুটোকেই কার্যত ছুঁড়ে ফেলেছে। 

কংগ্রেসের জীবানু এরাজ্যে সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের শরীরে যে গোদের সৃষ্টি করে, তাতেই বিষফোড়া হয়ে দাঁড়ায় পীরজাদা আব্বাসের আইএসএফ-এর ইনফেকশন। পীরজাদা আব্বাস একজন মৌলবাদী ধর্মগুরু এবং বাংলার পুরোনো সামন্ত-জোতদার-পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই অধুনা প্রতিনিধি, এবং সাথে, তাঁর চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক মতামতের বহু নজির যে শুধু অতীতেই ছিল, তা-ই নয়, জোটের পরেও মিডিয়াতে তার বেনজির নজির রেখেছেন। এমনকি আব্বাসের তৃণমূল বিরোধিতাও কোনও আদর্শগত বা রাজনৈতিক দিক থেকে নয় বা জনগণের স্বার্থেও নয়; স্রেফ নির্বাচনের আসন সংখ্যা নিয়ে বোঝাপড়া ও দরকষাকষি করতে গেলে তৃণমূলের তাকে হাঁকিয়ে দেওয়াতেই তার যাবতীয় তৃণমূল-বিদ্বেষ— একথা তিনি মিডিয়া সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট করে বলেন। পাশাপাশি যেখানে বিজেপি সরাসরি ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিই করছে এবং তাকে যোগ্য সঙ্গত দেওয়ার সবরকম কার্যক্রমের হোতা তৃণমূল কংগ্রেস, সেখানে মৌলবাদী ধর্মগুরুকে জোটসঙ্গী করার মধ্যে ধর্মীয় তাস খেলাই যে বঙ্গবামেদের লক্ষ্য ছিলো, তা আব্বাসকে শতবার ‘সাবল্টার্ন আখ্যা’ দিয়েও ঢাকা যায়নি। 

বহুদিন ধরেই সিপিআই(এম)-এর অন্দরে ও তাদের যাবতীয় মহান শুভানুধ্যায়ী বুদ্ধিজীবি ও ফেসবুক-কর্মীদের মধ্যে থেকেও আওয়াজ উঠছিলো ‘তরুণ নেতৃত্ব চাই’। মানুষ নাকি সিপিএম-কে ভোট দিচ্ছেনা, কেবল মাত্র তরুণ নেতৃত্ব বা ‘মুখ’ নেই ব’লে। তরুণ ‘মুখ’ বলে মূলত কিছু অভিজাত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের সামনে আনার পরিণাম তো স্বতঃস্পষ্ট ! 

শেষতঃ, কয়েকদিন আগে, বঙ্গ-সিপিএমের নেতা শমীক ভট্টাচার্য একটি পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা হাজির করেন, যেখানে কংগ্রেসের সাথে জোটের নির্লজ্জ তাঁবেদারীর নেশায় তিনি বিভিন্ন তথ্যগত কারিকুরি ও বুজরুকি চালিয়েছেন; এই নিয়ে আবার অন্য কিছু বামপন্থী বিতর্ক তুলেছেন। কিন্তু, আমাদের প্রশ্ন, যে ১০০-এ ৫ পায়, সে আসলে সাড়ে-৫ পেয়েছে না সাড়ে-৪, তাই নিয়ে বিতর্ক তাকে কোনও দিন পাস করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে ! 

(৩) “নো ভোট টু বিজেপি”-র নামে নকশাল ও অভিজাত বাম শিবিরের ঘৃণ্য তৃণমূল-দালালি

এই বিধানসভা নির্বাচনের আগে যা আমাদের প্রতিপাদ্য ছিল এবং নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যা প্রমাণিত সত্য, তা হল “নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগানের গোটা ক্যাম্পেইনটাই ছিল সরাসরিভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার ও তাকে জেতানোর প্রকাশ্য আহ্বান। 

এই ক্যাম্পেনের মূল কথা ছিল “বিজেপিকে ভোট নয়” এবং “বিজেপির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রার্থীকে ভোট”। বিধানসভা নির্বাচনের আগে সাম্প্রতিকতম ২০১৯-এর লোকসভার ফল অনুযায়ী ২৮০টি (২টি লোকসভা অর্থাৎ ১৪টি বিধানসভায় বামেদের প্রার্থী ছিল না) বিধানসভা ক্ষেত্রের একটিতেও বাম-প্রার্থীরা এগিয়ে ছিলেন না। তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে কাকে ভোট দিতে আহ্বান দিলেন নকশাল ও অভিজাত বামেরা ? এরাজ্যে বাই ডিফল্ট, তৃণমূল কংগ্রেস-কেই !  তাঁদের প্রিয়তম মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসকেই ! 

“নো ভোট টু বিজেপি” মঞ্চের পক্ষ থেকে তাই কোনওভাবেই নীল-সাদা ও ত্রিফলা স্ক্যাম, চিটফান্ড দুর্নীতি, আম্ফান দুর্নীতি, চরম একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, জনগণের ওপর নির্মম পুলিসি অত্যাচার, বেলাগাম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, কর্পোরেট প্রভুদের হয়ে শ্রমজীবী জনগণের ওপর অসহনীয় শোষণ ও দমন— তৃণমূল কংগ্রেসের এহেন বিপুল সম্ভারে ঠাসা জনবিরোধী রাজনীতি নিয়ে একটিও কথা বলা হয়নি।  তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই প্রকাশ্যে তাঁদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে ভোলেননি।   

সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক, যে ঠিক কতটা নির্লজ্জ রাজনৈতিক বেইমান হলে নিজেরা ‘স্বঘোষিত বামপন্থী’ হয়েও, প্রো-পিপল ইস্যুতে নতুন ও সংগ্রামী আন্দোলন ও তার ভিত্তিতে বাম-ঐক্য গঠনের ডাক দিলেন না ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র নেতৃত্বে থাকা “বিপ্লবী বাবু”-রা ! তৃণমূলের জয়ে তাঁদের উল্লাস তাই জনগণকে দুয়ে খেতে কর্পোরেটদের এক এজেন্সির বদলে আর এক এজেন্টকে বেছে নেওয়ার আনন্দ বৈ কিচ্ছু নয়।

“নো ভোট টু বিজেপি” ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি নকশাল ও অভিজাত বাম শিবিরের এই মৈত্রীর সবচাইতে ভয়ানক দিকটি ঠিক কী ? নয়াউদারবাদের নির্মমতম শোষণ এবং সংকট কালে, তার চরম মাত্রার ফলেই, দেশজুড়ে মোদী সরকার ও বিজেপির বিরুদ্ধে যে ক্ষোভের হাওয়াও প্রস্তুত হচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে মোদী-বিরোধী জনমতকেও বুর্জোয়া শিবিরের একান্ত কোনও পোষ্যদাসের হাতেই যে তুলে দিতে হবে, সেই ব্যপারে কোনও সন্দেহ অন্তত কর্পোরেট-গোষ্ঠীর মধ্যে নেই ! ফলে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেই বুর্জোয়াদের শিবির থেকেও তাদের নতুন বা বিকল্প প্রতিনিধি খোঁজার কাজটাও চালাতেই হচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে, কর্পোরেট মহলের কাছেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা, যে, সাম্প্রতীক অতীতে বিভিন্ন রাজ্যেই বিজেপির আসন বা ভোট শতাংশ হ্রাস পেলেও, কার্যত ‘গোহারান হারা’-র নজির এইরাজ্যেই দেখা গেল, তাও আবার এক সম্পূর্ণ কর্পোরেট-অনুগত, চরম একনায়কতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক এবং ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিরোধী শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। ফলে এরাজ্যে মমতার পুনরুত্থান আসলে আগামী দিনে কর্পোরেট মহলের “কমিটেড ফেস” খোঁজার এক্সপেরিমেন্টে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগামী লোকসভায় এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে, অন্যান্য সমস্ত এনডিএ-বহির্ভূত আঞ্চলিক শক্তি, জাতীয় কংগ্রেস ও মেইনস্ট্রীম বামেদের, এমকি নকশাল ও অভিজাত বামেদের (যেমনটা বিহার নির্বাচনে ইতিমধ্যেই হয়েছে) যৌথমোর্চার অন্যতম মুখ হিসেবে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসের সম্ভাবনা ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠছে ! 

কী করা যেত ?

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে, বামেদের উভয় শিবিরই, তা সে বামফ্রন্ট হোক বা নকশালপন্থীরা, কেউই কোনও নির্নায়ক ভূমিকায় ছিলেন না। না তাঁরা নিজেরা সরকারে আসার মতো সাংগঠনিক ও গণভিত্তি নিয়ে ছিলেন, না তাঁদের ছিলো কে সরকারে আসবে, তা ঠিক করার ক্ষমতা ! দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই দুই ভ্রান্তির পথেই যথাক্রমে বামফ্রন্ট ও নকশালেরা পা বাড়ালেন ! তাহলে প্রশ্ন ওঠে, যদি এই নির্বাচনে কমিউনিষ্ট ও বাম শিবিরের পক্ষ থেকে একটা নতুন লড়াইকে তৈরী করতে হতো তবে তার নীতিগত ও কৌশলগত অবস্থান কী হওয়া দরকার ছিল ? 

প্রথমত, জনগণের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে বিজেপির মতো উগ্র-হিন্দুত্ববাদী ও কর্পোরেট-অনুগত শক্তির সহায়ক অবস্থানেই যে জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস-সহ দেশের সিংহভাগ আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলি অবস্থান করে, এবং সুতরাং, এরাজ্যের নিরিখে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেস— এই তিনশক্তির নয়াউদারবাদী, সাম্প্রদায়িক ও মেহনতী-বিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থী ও কমিউনিষ্ট পার্টি ও সংগঠনের ঐক্য নির্মান ছিলো প্রথম প্রয়োজনীয়তা। এই ঐক্যের মূল বিষয়বস্তুই হতে হতো কর্পোরেটগোষ্ঠী ও কর্পোরেট মিডিয়ার তৈরি করা “সাম্প্রদায়িক” বা “কেন্দ্র-রাজ্য” বা “হিন্দি-বাংলা” পোলারাইজেশন-এর বিপরীতে “দক্ষিণপন্থী বনাম বামপন্থী” ও “কর্পোরেট বনাম সাধারণ শ্রমজীবী”-র পোলারাইজেশন-কে সামনে নিয়ে আসা। অ্যাজেন্ডার দিক থেকে বিভিন্ন চলতি ইস্যুর সাথে এর কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হতে পারত সাম্প্রতিক চরমতম জনবিরোধী “লকডাউন”, যা সম্প্রতি অভূতপূর্ব পরিমাণে “কর্পোরেট বনাম সাধারণ শ্রমজীবী”-র পোলারাইজেশন বাস্তবেই ঘটিয়েছে অর্থনৈতিক ভাবে।   

দ্বিতীয়ত, সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করতে হতো নয়াউদারবাদের পক্ষে (যেমন, কর্পোরেট মালিকদের পক্ষে, এসইজেড-এর পক্ষে ইত্যাদি) এবং এদেশে তার প্রবক্তা কংগ্রেসের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য, আর নকশালপন্থীদের প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করতে হতো নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে সেই নয়াউদারবাদেরই একান্ত বিশ্বস্ত এজেন্ট তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য, যাতে রাজ্যের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের স্পৃহাটাই দীর্ঘকালের জন্য খতম হয়ে গিয়েছে। 

তৃতীয়ত, যেহেতু সমস্ত বাম মিলিয়েও এসময়ে বামেরা সরকার গড়ার ক্ষেত্রে নির্নায়ক শক্তি ছিলেন না, ফলে প্রচারের স্লোগান কখোনোই বাম বা বিকল্প সরকার গড়ার বিষয়ে হতে পারতো না। বরং এই নতুন বাম-ঐক্যের প্রচারের রাজনৈতিক বিষয়বস্তু হতে হতো, কর্পোরেট-অনুগত সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় খেটে খাওয়া মানুষের প্রবল লড়াই ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং, সেই লড়াইকে সাহায্য করতে যত বেশী সংখ্যক বামপন্থী প্রার্থীকে বিধানসভায় পাঠানো যায়, জনগণের কাছে তার আহ্বান জানানো। অর্থাৎ, চলতি প্রতিশ্রুতির নির্বাচন-ম্যানিফেষ্টোর বিপরীতে হাজির করতে হতো নির্বাচনী-ম্যানিফেষ্টোরও এক নতুন ও সময়োপযোগী ধারার নির্মান। 

এই তিনটি বিষয়ে একটি সাধারণ ঐক্যের ভিত্তিতে মতাদর্শগতভাবে বিবিধ ফারাক সত্ত্বেও, বিভিন্ন বাম ও কমিউনিষ্ট পার্টি ও সংগঠনের ঐক্যের ফলে পশ্চিমবাংলায় নতুন বাম আন্দোলনের একটি নয়া পথ প্রশস্ত হতে পারতো। ২০১১ ও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে যথাক্রমে নকশালপন্থীদের তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে এবং বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-এর জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আদর্শহীন সহবাসকে পরিত্যাগ ক’রে, দেশের বুকে এটি হতে পারতো নতুন ধারার বাম আন্দোলনের পথ, যা সমাজে দক্ষিণপন্থীদের দুই শিবিরের মেরুকরণের বিপরীতে একটি পাল্টা মেরুকরণের রাস্তা খুলে দিত। প্রাথমিক দশায় তার শক্তি, এমনকি, কম হলেও, তার সৃষ্টি করা আশাবাদ আগামীদিনে তার ব্যাপক শক্তি সঞ্চার করার সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলতো ! 

কী করতে হবে? 

একদিকে, আজ গোটা রাজ্য-রাজনীতি তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মতো সম্পূর্ণ মানুষ-মারা দুই দক্ষিণপন্থী শক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর অন্যদিকে, বামপন্থীদের (বামফ্রন্ট ও নকশাল উভয়ই) দক্ষিণপন্থী শিবিরেরই লেজুড়ে পরিণত হওয়ার ঘটনা, পরিচিত এই বাম-ঘরানাগুলি থেকে যে আর খেটেখাওয়া মানুষের লড়াই-সংগ্রামের নতুন ও স্বাধীন (দক্ষিণপন্থী হেজিমনি থেকে স্বাধীন) দিশা বেরিয়ে আসবে না, তা স্পষ্ট করেছে।  

সমাজে আজকে অন্যতম সঙ্কট আদর্শের দিক থেকে ন্যূনতম বামপন্থী ও প্রগতিশীল এবং প্রো-পিপল রাজনীতি ও চিন্তাধারার “ভ্যানিশ” হয়ে যাওয়া। বস্তুগত দিক থেকে সমাজে তাই যতই ‘লুঠেখাওয়া’ বনাম ‘খেটেখাওয়া’-র মেরুকরণকে প্রবল করুক আজকের নয়াউদারবাদী রাষ্ট্র, রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে সেই একই মেরুকরণের চিহ্নমাত্র নেই ! খেটেখাওয়াদের লড়াইকে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন শক্তিশালী বাম বা কমিউনিষ্ট পার্টির উপস্থিতিই নেই। 

এদিকে প্রায় ৮ বছরের চক্রাকারে আসা নয়াউদারবাদের সঙ্কট কিন্তু দেখিয়েও দিচ্ছে যে সে মুমূর্ষু। আর এই মুমূর্ষু অবস্থাতেই তার এই বিশ্বজনীন হিংস্রতা— দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ ও হানাহানির আবহ, দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে চূড়ান্ত গণদমনের রাজনীতি ও তাকে ধ’রে রাখতে পারে এমন দলগুলোই প্রধান ক্ষমতায় আসছে। ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের যুগ এটাই, যার সূচনা হল “লকডাউন”-এর মাধ্যমে দুনিয়ার দেশে দেশে “গণ-বেকারত্ব” তৈরির মধ্যে দিয়ে ! 

তারপরেও মনে রাখা দরকার, “দুর্ভাগ্য কখনও একা আসে না”। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ সংকটের সাথে সাথে ফিন্যান্স পুঁজির গভীরতম সংকট কেবল ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধই ডেকে আনে না, সে সর্বহারা বিপ্লবেরো সম্ভাবনাও তৈরি করে ! ফলে, আজকের কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনকে একদিকে যেমন আগামী লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদী-নেতৃত্বাধীন বিজেপি-এনডিএ জোট আর সম্ভাব্য মমতা-নেতৃত্বাধীন অবিজেপি ফেডারেল ফ্রন্ট-এর পোলারাইজেশনের বিপরীতে “কর্পোরেট বনাম মেহনতী”-র পলিটিকাল পোলারাইজেশন গ’ড়ে তুলতে হবে, তেমনই অন্যদিকে নয়াউদারবাদী শোষণের স্বরূপকে উন্মোচন ক’রে মেহনতী জনগণ ও নিপীড়িত পরিচিতিস্বত্ত্বাগুলির গণ-বিক্ষোভকে এই সংকটগ্রস্ত নয়াউদারবাদী যুদ্ধবাজ ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলার আশু বৈপ্লবিক লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে হবে “মেহনতীরাজ-সমতা-শান্তি” কায়েমের উদ্দেশ্যে।

অরিত্র বসু ও বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের সদস্য

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *