সাম্প্রতিক শারদোৎসবে ‘বেস্ট-সেলার’ অ্যাওয়ার্ড পেতে পারে যে বইটি, তার শিরোনাম ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’; লেখক সিপিআই(এম)-এর প্রাক্তন পলিট ব্যুরো সদস্য এবং পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য। বইটির একটি কপি সদ্য হাতে পেয়ে পড়ে কয়েকটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেগুলি তুলে ধরলাম পৃষ্ঠার ক্রম-পরম্পরায়। কয়েকটি প্রশ্ন অনিচ্ছাকৃত ভাবে বাদ পড়ে যেতে পারে, তার জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
১) পৃঃ ১৩ : এখানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীনে যে “সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ”-এর কথা বলা হয়েছে তা ঠিক কী? কমরেড লেনিন যাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, “পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়” বলে বিশ্লেষণ করেছেন, তা তো উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় শুরু হয় ! লেনিনের বিশ্লেষণের মুখ্য বিষয়ই ছিল সাম্রাজ্যবাদকে একটি আগ্রাসী নীতি হিসাবে দেখার বিপরীতে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ ও শ্রমিক বিপ্লবের যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা। যদিও সমীর আমিনের মতো একাধিক ইতিহাসবিদ এই যুগের আগেও সাম্রাজ্যবাদ ছিল বলে দেখিয়েছেন যা লেনিনের ঠিক বিপরীত ধারাটিকে তুলে ধরে। লেখক কি সেই মতের পক্ষে ?
২) পৃঃ ৩৪-৩৫ : কৃষক কমিউনের প্রেক্ষিতে ষাটের দশকের কথা উল্লেখ করে লেখক বলেছেন “হিসাবে কারচুপি করা হল”। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির উল্লেখ পর্যন্ত করতে লেখক কি ভুলে গেলেন? তাচাই ব্রিগেডের ঘটনা ? যেখানে ৩৬০ জন মানুষ বন্যার বাধা পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক বৃহদায়তন টব বানিয়ে তাতে চাষ করে নিজেদের ও দেশের অন্যত্র ফসলের জোগান দিয়েছিলেন। তাঁদের উৎপাদনশীলতার তথ্যে কারচুপি করা হয়েছে বলে যখন অভিযোগ করা হল, তখন প্রধানমন্ত্রী চো এং লাই-এর নির্দেশে (লেখক যাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন) যে তদন্ত হয় তাতে প্রমাণিত হয় তাচাই ব্রিগেডের এই বিস্ময়কর উৎপাদনের হিসাবে কোনও কারচুপি নেই ! এবিষয়ে লেখক নিশ্চুপ কেন?
৩) পৃঃ ৩৬ : লেখক বলেছেন, সমাজতন্ত্রের নীতি “কাজ অনুযায়ী মজুরী”। ‘গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা’-য় মার্কস লিখেছিলেন “কাজ অনুযায়ী ভোগের সামগ্রী”-র কথা। দুটি বিষয় যে এক নয়, মজুরী প্রথা পুঁজিবাদের শোষণের পদ্ধতি, মজুরী দাসত্বের অবসান চাই, সেটাই তো মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল কথা। তাহলে সমাজতন্ত্রে “মজুরী”-র অর্থটি ঠিক কী? এ কি কেবল কথার ছলে বলে ফেলা? পরে অবশ্য একাধিকবার সমাজতন্ত্রে পুঁজির অস্তিত্ব রক্ষা করার কথা বলে লেখক প্রমাণ দিয়েছেন তিনি শ্রমিককে শোষণকারী মজুরীর কথাই বলতে চেয়েছেন।
৪) পৃঃ ৩৭ : বিপ্লবের পরেও পুঁজিবাদের বিপদের কথা বলার জন্য কমরেড মাও সে তুং-এর যে সমালোচনা লেখক করেছেন, সেই একই কথা লেনিন লিখেছিলেন ‘প্রলেতারিয় একনায়কত্বের যুগে অর্থনীতি ও রাজনীতি’ প্রবন্ধে বারংবার সতর্ক করে। এ প্রসঙ্গে লেখকের মত কী?
৫) পৃঃ ৩৮ : কমিউন সাম্যবাদের প্রথম পদক্ষেপ নয় এই মত জোরের সাথে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক। কথাটা কেন্দ্রীয় অর্থে সঠিক, কিন্তু সামগ্রিক অর্থে সঠিক কি? সমাজতন্ত্রে পৌঁছোবার নির্দিষ্ট পথের কথাও তিনি বলেছেন। কিন্তু এখানে কৃষিতে যৌথ মালিকানা হিসাবে কমিউনের কথাই তো তিনি বলেছেন, কিন্তু সে প্রশ্নে মার্কস কী বলেছেন তা উহ্য রাখা হল কেন? কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার-এর ১৮৮২ সালের ভূমিকায় মার্কস ও এঙ্গেলস রাশিয়ার উদাহরণকে সামনে রেখে বলেছিলেন : “যদি রাশিয়ার বিপ্লব পাশ্চাত্যের সর্বহারা বিপ্লবের এক সংকেত হয়ে দাঁড়ায় যাতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে, তবে বর্তমান রাশিয়ার জমিতে যৌথ মালিকানা কমিউনিস্ট বিকাশের সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে”। মার্কস ও এঙ্গেলস যাকে কৃষিপ্রধান দেশে একটি সম্ভাবনা হিসাবে বিচার করেছেন, তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন লেখক?
৬) পৃঃ ৪১ : সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বলা হয়েছিল “যে যতো পড়ে সে ততো মূর্খ হয়”? এর কোনও তথ্য আছে?
৭) পৃঃ ৪৭ : ১২-পার্টি ও ৮১-পার্টির দলিল সম্পর্কে সোভিয়েত ও চীন পার্টির বিতর্কের মূল বিষয় থেকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব কোনটি তার উল্লেখটাই লেখক কোনও অজ্ঞাত কারণে করেননি। মূল বিরোধ বলে যা তিনি তুলে ধরেছেন, বিশেষত সমাজতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ এবং সাম্রাজ্যবাদ কোটের বোতাম কিনা সে প্রশ্নে চীন পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে লেখকের মত কী সেটাই বা জানালেন না কেন?
৭) পৃঃ ৫০ : চীন পার্টির ‘৩৫০০ শব্দের প্রস্তাব’-এ লেখকের পছন্দের যে শব্দগুলি “গুরুত্বপূর্ণ বিষয়” পাওয়া গেল তা হল “বাজার” ও “বিদেশী মুদ্রা”। লেখক বলতে চান এটাই সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা?
৭) পৃঃ ৫২ : কমরেড দেং জিয়াও পিং-এর ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’-র সপক্ষে বলতে গিয়ে লেখক চীন-হংকং ঐক্যের বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে আবাগে ভেসে গেছেন বলা যায়। কিন্তু তাঁর (এবং আমাদের সকলের) চীন-হংকং বিষয়ে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কোনও উল্লেখ নেই কেন? এ প্রসঙ্গে তাঁর মত কী? বিশেষত যেখানে তিনি বলেছেন : “সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি পুঁজির ভূমিকাও থাকবে। সরকারের লক্ষ্য দুইয়েরই উন্নয়ন। বাজার যেভাবে চাইবে সেভাবে এগোবে। শেষপর্যন্ত কর্তৃত্ব থাকবে সরকারের হাতে”!
৮) পৃঃ ৫৪-৫৫ : লেখক বলেছেন : “জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা এখন নিম্নগামী। সেটাই বাঞ্ছনীয়” ! প্রশ্ন থমকে গেছে !
পরের প্রশ্নে আসি যেখানে লেখক চীনের “অগ্রগতি”-কে মেপেছেন বিদেশী পুঁজির প্রবেশ, IMF, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও WTO-র সাথে সংযোগের ভিত্তিতে ! আবারও প্রশ্ন থমকে গেল !
৯) পৃঃ ৫৮-৫৯ : লেখকের তথ্যে চীনের ১৪২ কোটি জনগণের প্রায় “পাঁচ ভাগের কিছু কম” (বোধ হয় শতাংশ বলতে চেয়েছেন) মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে যা “নগণ্য”। (শতাংশ বলে ধরলে) দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় ৭ কোটি জনগণ ! “নগণ্য” ? উল্লেখ্য দারিদ্র্যের এ সীমাটিও IMF-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-WTO ত্রয়ীরই মান্যতায় ঠিক করা, যার পরিমাণ আমাদের দেশের ‘রেগা’-র রোজের কাছাকাছি।
উপরন্তু দুর্নীতি, দারিদ্র্য, আয়ের ব্যবধান, উচ্ছেদ আর অন্যদিকে বিশাল সংখ্যক কোটিপতির আবির্ভাব লেখকের মতে “চাঁদের কলঙ্ক” ?
১০) পৃঃ ৬১-৬২ : চীনে পশ্চিমী গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন : “যে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী বৈপ্লবিক গৃহযুদ্ধে জনতার শেষ পর্যন্ত জয় অর্জিত হয়েছে সেখানে পশ্চিমী গণতন্ত্রের কোনও উপাদানই ছিল না”। আশ্চর্য, তা সত্ত্বেও পশ্চিমী পুঁজিবাদ সেখানে গজিয়ে ওঠার উপাদান পেল কীভাবে?
১১) পৃঃ ৬৮ : চীন এই পথে চলার প্রাক্কালে লেখক যখন চীনে গিয়েছিলেন এবং তাঁর মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল “সমাজতন্ত্র কোন পথে?” তখন বিদেশ থেকে ডাক্তারি শিখে আসা এক ডাক্তার ও হাসপাতালের ঝাড়ুদারের মাইনের ফারাক খুব কম দেখে সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তিনি বলেছেন : “অবাক লেগেছে” ! প্রশ্নকারী নির্বাক!
১২) কভার পেজ : কমরেড মাও সে তুং-এর ভূমিকা এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব-এর প্রসঙ্গে একাধিক সমালোচনামূলক প্রশ্ন বর্তমান প্রশ্নকারীর মধ্যেও ঘোরতর ভাবে আছে। কিন্তু আজকের চীনে পুঁজিবাদের যে “মহাবিশৃঙ্খলা” দেখা দিয়েছে, মার্কস যাকে দেড়শ বছর আগেই পুঁজির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন, তারই মধ্যে “স্বর্গ” খোঁজবার এই প্রয়াস আদৌ “তথ্য থেকে সত্য” তুলে ধরছে তো ?
কিন্তু ‘কভার পেজ’-এর শিরোনাম ও লেখকের নাম আমার মধ্যে শেষ যে প্রশ্নটি হাজির করেছে তা হল : নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল লড়াইয়ের ইতিহাসকে হত্যাকারী সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-টাটা-সালেম-SEZ-এর কালিমাকে “চাঁদের কলঙ্ক” বলে প্রমাণ করা যাবে কি?