পশ্চিমী দুনিয়া ভূত দেখছে — সংকটের ভূত!
উদ্ধৃতিটি কোথা থেকে নেওয়া তা সবারই জানা। বর্তমান পরিস্থিতিটাও কি তাই? আসুন, একবার দেখে নেওয়া যাক। পাশ্চাত্যে মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা, বিশেষত বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের নেতৃস্থানীয় দেশগুলিতে, অর্থাৎ জি-৭-এর অন্তর্গত দেশগুলিতে, ইতিমধ্যেই সংকটাপন্ন। গত দশকে এই প্রতিটি দেশে মুদ্রাস্ফীতি গড়ে মাত্র ২-৩% বা তারও কম ছিল; অথচ গত অর্থ-বর্ষে ইতিমধ্যেই সেই মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯%, কানাডায় ৮.১%, ইউকে-তে ১১%, জার্মানিতে ৮.৮%, ফ্রান্সে ৬.২% এবং ইতালিতে ১২%-এ [১]। এমনকি তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রানীতি কঠোর করার পরেও, মুদ্রাস্ফীতি এখন পর্যন্ত মাত্র ~৫-৭%-এ নেমেছে। স্পষ্টতই, ভূত দেখাই স্বাভাবিক!
মজার ব্যাপার হলো, ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের মুদ্রা ও অর্থনৈতিক বিভাগের প্রধান ক্লডিও বোরিও সদ্য স্বীকার করেছেন যে “এত দীর্ঘ সময় ধরে ঝিমিয়ে থাকার পরে হঠাৎ করে এত জোরালোভাবে কেন যে আবার মুদ্রাস্ফীতি ফিরে এলো, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানিইনা” [২]! “মুদ্রাস্ফীতির বিস্ময় বিশ্বব্যাপী”, বলছেন আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জোনাথন ডি ওস্ট্রি, এবং প্রকাশ করছেন যে “ফেড [ফেডারেল রিজার্ভ] একা নয় যারা এই পরিস্থিতিকে ভুল বুঝেছিল… আইএমএফ… তার ব্লগে মুদ্রাস্ফীতির এই উত্থানের বর্ণনা দিয়েছে তার (তৎকালীন) প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথের কলমে… ক্ষণস্থায়ী কারণগুলির দিকে ইঙ্গিত ক’রে এবং দায়সারা কিছু আশ্বাস দিয়েছে” [৩]। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেগ কাপলান, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের বেঞ্জামিন মোল এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওভান্নি এল ভায়োলান্তে আইএমএফ দ্বারা প্রকাশিত একটি নিবন্ধেও এই একই ভ্রান্তির কথা স্বীকার করেছেন। যদিওবা, তাঁরা সকলেই এই ধরনের বিপর্যয়ের জন্য কোভিড-১৯ অতিমারী এবং তারপরে রাশিয়ার ইউক্রেন-এ আগ্রাসনকে দায়ী করেছেন।
কিন্তু আসল গল্পটা কি এটাই?
বাস্তবে কিন্তু, তথাকথিত ‘অতিমারী’ বা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই সংকটের ‘কারণ’ নয়; বরং এগুলো হচ্ছে এর সবিশেষ ‘ফলাফল’। ‘অতিমারীর খেলা’ (এখন বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এটি বোঝেন, যদিও আমরা শুরু থেকেই এটি দাবি করে আসছি) শুরু হওয়ার ঠিক আগে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে, আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা স্পষ্ট করেছিলেন যে তাঁদের অনুমান “বিশ্বের নব্বই শতাংশ দেশে স্লো গ্রোথ” চলবে এবং বিশ্ব অর্থনীতি এক “সুসংবদ্ধ স্লথতা”-র মধ্যে ডুবে যেতে চলেছে। যদিওবা, তখন থেকেই আমরা উচ্চস্বরে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম সেইসব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ নিয়ে, যাঁরা “বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিগুলির গুরুতর পরিবর্তনের দাবি” জানাচ্ছিলেন [৫]। এবং খুব শীঘ্রই সে পরিবর্তন আসতে দেখা গেল, কোভিড-যুদ্ধের নামে বিশ্বব্যাপী লক-ডাউনের মধ্য দিয়ে। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, এটি সম্ভবত মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম এক বিশ্বব্যাপী অতিমারী যেখানে অতিমারীতে মৃত্যুর সংখ্যা বার্ষিক গড় মৃত্যুহার থেকে একটুও বাড়েনি! কিন্তু তার চেয়েও আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এটা কি কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন যে, এই অতিমারী পরিস্থিতি বা লক-ডাউনের মধ্যেই জিডিপি নাকি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে! কিন্তু বাস্তবে এমনটাই ঘটেছে (ব্যতিক্রম জার্মানি, সম্ভবত এর পূর্ব ব্লক থেকে পুরানো প্রতিরোধের কারণে)। ২০২১ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৯%, কানাডায় ৪.৫%, ইউকে-তে ৭.৫%, জার্মানিতে ২.৬%, ফ্রান্সে ৬.৮% এবং ইতালিতে ৬.৭%, যা গত দশকে প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ছিল কেবল ২% বা তার কম [১]।
সুতরাং এতা স্পষ্ট যে, লক-ডাউন আদৌ উত্পাদন বন্ধ করেনি। প্রকৃতপক্ষে, এটা কেবল উত্পাদনের গোটা ধারাটাকেই ঠেলে দিয়েছে অতি-নয়াউদারবাদের দিকে। এখানে নয়াউদারবাদ বলতে আমরা বোঝাতে চাই, যেমনটা আমরা ইতিমধ্যেই ব্যখা করেছি [৫-৭]-এ যে, “আপডেট বা রি-মডেলের মাধ্যমে তুলনায় কম সংখ্যায় কিন্তু দামী পণ্য বারবার উত্পাদন”-এর ধারা (অর্থাৎ উৎপাদনের ‘টেম্পোরারি মোড’), যা আবার অচিরেই “বর্তমানে উৎপাদিতই হয়নি এমন পণ্যগুলি থেকে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা” (অর্থাৎ ডেরিভেটিভ ট্রেডিং)-এর দিকে নিয়ে যায়। উৎপাদনের এই ধারাকে স্পষ্টতই বিশাল মাত্রায় ইনফরমেশন-এর সংগ্রহ এবং ম্যানিপুলেশনের উপর নির্ভর করতে হয়। আর লকডাউন ঠিক এখানেই তার ভূমিকা পালন করেছে অতি দ্রুত ও বিশাল আয়তনে সমস্তকিছুকে একটি ‘অন-লাইন’ সিস্টেমে গিলে ফেলার ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই, এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে কয়েকজন মুষ্টিমেয় শীর্ষ-পুঁজিবাদী মালিকের সম্পদের পরিমাণের পরিবর্তনে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের দুনিয়ার ধনীতম পাঁচজন পুঁজিপতির সম্পদ সময়ের সাথে গত দশ বছরে কীভাবে বদলেছে, তা আমরা নীচের লেখচিত্রে তুলে ধরেছি [৮]। ছবি থেকেই স্পষ্ট যে, প্রথমত, অ্যামাজন, টেসলা, এলভিএমএইচ, মাইক্রোসফ্ট এবং ফেসবুকের মালিকরা, যারা ব্যয়বহুল এবং/অথবা তথ্য সম্পর্কিত পণ্যগুলির ব্যবসা করছেন, লক-ডাউনের সময়ের মধ্যে তাঁরাই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পেরেছেন; এবং দ্বিতীয়ত, তাঁদের প্রত্যেকের সম্পদ ২০২০ থেকে ২০২১ সালে বেড়ে গেছে এক ধাক্কায় অনেকখানি লাফিয়ে। করোনা ভাইরাসের কী অপার মহিমা!
লক-ডাউনে নয়াউদারবাদী কায়দায় মুনাফা অর্জনের এই দ্রুততা ২০২১ সালে এক বিস্ময়কর জিডিপির বৃদ্ধি ঘটায়, যাকে অনুসরণ ক’রে ২০২২ সালে অপ্রত্যাশিত (মূলধারার অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে) মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, যা এখনও বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অস্বস্তিতে ফেলে রেখেছে। যদিওবা, আমরা আগেই [৭]-এ ব্যাখ্যা করেছিলাম যে “উৎপাদনের এই টেম্পোরাল মোড-এ জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং মুদ্রাস্ফীতি এমন বন্ধনে আবদ্ধ যাতে একটি আরেকটিকে অনুসরণ করে… যদি বৃদ্ধির হার বাড়ে তাহলে তা আরো বেশি মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা ডেকে আনে; আর যদি মুদ্রাস্ফীতি কমাতে চেষ্টা করা হয় তাহলে বৃদ্ধির হার নেমে যায়। সুতরাং, পুঁজিবাদের বর্তমান নয়াউদারবাদী দশায় সৌভাগ্য কখনই একা আসে না, বরং তার সাথে নিয়ে আসে একটি অনিবার্য দুর্ভাগ্য।” [৭]-এ এটাও দেখানো হয়েছিল যে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার পতনের পর থেকেই, যদিওবা এই ধরণের মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চালান করা যেতে পারে। কিন্তু, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে জাহাজ-পরিবহনের খরচ হটাত বেড়ে যাওয়ায় পাশ্চাত্য থেকে ‘মুদ্রাস্ফীতির রপ্তানি’ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ‘ইউএন কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (UNCTAD) বলেছে: “ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউক্রেন এবং কৃষ্ণ-সাগর অঞ্চলের বাণিজ্য ও তার রসদের কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে… এটি বিশ্বব্যাপী জাহাজের চাহিদা এবং জাহাজ-পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে” [৯]। অন্যদিকে, রাশিয়া এই যুদ্ধের মাধ্যমে (প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয় বরং পাশ্চাত্যের সাথে বাণিজ্য-যুদ্ধ) তার নিজের মুদ্রাস্ফীতি ২০২২-এর এপ্রিলে ১৮% থেকে এবছর মার্চের মধ্যে ৩.৫%-এ নামিয়ে আনতে সফল হয়েছে। কিন্তু তবুও, রাশিয়াই হোক, আর পাশ্চাত্যই হোক, অথবা বাণিজ্য-শৃঙ্খলের শত শত দেশের মধ্যে যে কোনও জাতিরাষ্ট্রই হোক না কেন, এই সংকট কিছুতেই নির্মূল হবে না।
যেমনটা আমরা [৫]-এ তুলে ধরেছি যে “পুঁজিবাদের এই টেম্পোরাল মোড-এ নতুনতর গুণমানের পণ্যের বারংবার উৎপাদনের ধারা ভবিষ্যতের উৎপাদন এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিপুল সংখ্যক চুক্তির ব্যাবসার জন্ম দেয়”, যা আবশ্যিক ভাবেই ডেকে আনে “বর্তমান নয়াউদারবাদী শাসনব্যবস্থায় ‘সময়ের নিরিখে অতিউৎপাদন’”, যা “প্রকাশ পায় বিশ্বব্যপী স্টক-বাণিজ্যের পরিমানের বাস্তব জিডিপিকেও ছাপিয়ে যাওয়ায়, যা আবার ডেকে আনে পর্যায়ক্রমিক সঙ্কট”। আমরা দেখিয়েছি এই সংকটের চক্র গড়পড়তায় প্রায় ৮ বছর পরপর উপস্থিত হচ্ছে, যার ভিত্রেখাটিও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আমরা অনুমান করছি যে আগামী ‘ডি-ডে’-টি আসতে চলেছে ২০২৪ নাগাত, যখন চুক্তির মেয়াদপূর্তির দিনে বিপুল পরিমাণ সরকারী ঋণ সম্পূর্ণরূপে নন-পারফর্মিং অ্যাসেটে পরিণত হতে যাচ্ছে।
আর এর পরিণাম? না, কোন মার্কসবাদী নন, আইএমএফের ইতিহাসবিদ হ্যারল্ড জেমস বলছেন: “আগের বারে চক্রাকার গতিপথের ধাপে, ব্যয়ের বৃদ্ধি আরও চাহিদা সৃষ্টি করেছিল, যা আরও ঘাটতির দিকে নিয়ে গেছিল। আবার একটি চক্র আসতে চলেছে। খাদ্য ও জ্বালানির বাড়তে থাকা দাম সৃষ্টি করতে পারে বিশ্ব জুড়ে অসন্তোষ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, একাধিক সরকারের পতন, এবং এমনকি আছড়ে পড়তে পারে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গও [১০]”। আপনাকে মার্ক্সবাদী হতে হবে না, বাস্তব আপনাকে মার্ক্সবাদী ক’রে ছাড়বে।
1. https://tradingeconomics.com.
2. Claudio Borio, “Monetary policy under test”, IMF publication (March 2023).
3. Jonathan D. Ostry, “The costs of misreading inflation”, IMF publication (January, 2023).
4. Greg Kaplan, Benjamin Moll, Giovanni L. Violante, “The very model of modern monetary policy”, IMF publication (March 2023).
5. https://jabardakhal.in/english/neoliberalism-no-reformist-solution-to-its-crisis/.
6. https://jabardakhal.in/english/chapter-02-neoliberalism-the-temporal-mode-of-production/.
8. https://www.forbes.com/real-time-billionaires/#fa142693d788.
10. Harold James, “In Defense of Globalization”, IMF publication (March 2023).