পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসরকারী কর্মচারিদের বামপ্রভাবিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সংগঠন কোঅর্ডিনেশন কমিটি। ২০১১-তে রাজ্যে বামশাসনের পতনের সাথে সাথেই তার অবস্থাও শোচনীয় হয় সেই কোঅর্ডিনেশন কমিটির এক সময়ের বসিরহাট মহকুমার প্রথম সারির নেতার সাথে লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে আমার একদিন কথা হচ্ছিল। চাকরি পাওয়ার আগে ইনি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সিপিআই(এম)-এর প্রকাশ্য পার্টি সদস্য ছিলেন। কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, পার্টির নীচুতলাতেই তো রটে গেছে, এরাজ্যে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে একমাত্র বিজেপিই প্রকারান্তরে অশীতিপর মানুষটি স্বীকারও করে নিয়েছিলেন যে, তাঁরও সহানুভূতিও বিজেপির দিকেই শুধু ইনিই নন, বিজেপি যেখানে নতুন নতুন করে পা ফেলেছে তার প্রত্যেকটি জায়গাতেই এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি তৃণমূলের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ণ এবং প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতামূলক উস্কানির বিরুদ্ধে সামনের সারিতে থেকে বামেদের যে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, তার বদলে আজ গোটা পশ্চিমবঙ্গের জায়গায় জায়গায় বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের লড়াই-এর প্রথম দফা থেকেই এই বিষয়টি আকার ইঙ্গিতে উঠে আসতে থাকে এবং ২৩শে মে বেলা বাড়ার সাথে সাথেই তা স্পষ্ট হতে থাকে। একদিকে জনমানসে তৃণমুলের প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ, অন্যদিকে বামেদের ‘ডিফাংক্ট’ রাজনীতি, আর তার সাথে কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকার ফায়দা তুলে গুণ্ডামি-খুনোখুনির রাজনীতিতে বিজাপির তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়ার লাইন রাজ্য-রাজনীতিতে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিজেপির উত্থান সুনিশ্চিত করে। গোটা রাজ্য জুড়ে একটা মত যেন তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে ২০১৯এর এই লোকসভা ভোট হচ্ছে আগামী বিধানসভা ভোটে সরকার থেকে শাসক দলের যবনিকা-পতনের সেমিফাইনাল’, ঠিক ২০০৯এর মতো
ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট যে এরাজ্যে বামেদের ভোটের প্রায় ৭০% চলে গিয়েছে বিজেপিতে। রাজ্যের উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলে যেখানে বিগত পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলেই দেখা গেছিল যে, শাসকদল তৃণমূলের ঘুম উড়িয়ে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি, সেখানে একাধিক বাম নেতাকর্মীসমর্থকেরা দল বেঁধে পদ্ম’ ছাপ মারা গেরুয়া উত্তরীয় গলায় জড়িয়েছিলেন বাম নেতৃত্ব তাঁদের কর্মীদের মধ্যে একটা মত ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন : “আগে তো তৃণমূল যাক তারপর বিজেপির সাথে লড়ে নেওয়া যাবে” ! কিন্তু তাঁদের নিজেদের কর্মীরাই বিজেপিতে চলে গেলে “তারপর বিজেপির সাথে” লড়বে কে ? বাস্তবে তো দেখা গেল সিপিএম থেকে বেরিয়ে যারা ‘শ্রীকমলচরণ’-এ আশ্রয় নিচ্ছে তারাই ছিল তাদের এলাকার মূল সংগঠক !
পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী হিসেবে বিজেপির এই উত্থানের সুত্রপাত যদিও গত লোকসভা ভোট থেকেই। ২০১৪-এ এমন এমন আসনে বিজেপির ভোটে উত্থান লক্ষ্য করা গেছিল, যা কস্মিনকালেও চিন্তা করা যায়নি। কিন্তু এর নেপথ্যে কি ছিল শুধুই মোদী হাওয়া ? আজ আর কারোর পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে তৃণমূলের প্রতি প্রবল ক্ষোভ আর সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেদের প্রতি জনগণের বিশ্বাসহীনতা পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে ব্যপক শূণ্যতার সৃষ্টি করেছিল, বিজেপির উত্থানের শুরু সেখান থেকেই, সেই সময় থেকেই, — যার পরিণাম আজ মহীরূহ হয়ে দেখা দিয়েছে এই নির্বাচনে।
২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন, যেখানে বিজেপির ফল বিশেষ ভাল হয়নি, আসলে তাকেই কিন্তু এরাজ্যে পদ্মবাহিনীর উত্থানের এক মাইলস্টোন বলা চলে। সেই নির্বাচনে সমস্ত নীতি-আদর্শ জলে ভাসিয়ে নিজেদেরই গায়ে থুতু ছিটিয়ে এরাজ্যে সিপিএম যেভাবে কংগ্রেসের হাত ধরে, এবং রাজ্যে তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়, তাতে বাম কর্মী-সমর্থকদের সুবিপুল অংশই বুঝে যান যে “এঁদের দিয়ে আর হবে না”। ক্ষত আরও গভীর হতে থাকল যখন দেখা গেল, নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ার নামে যে কংগ্রেসের জন্য বাম-কর্মী সমর্থকেরা প্রাণপাত করেছিলেন, ভোট-পর্ব মেটার পরই তার অধিকাংশ জিতে আসা বিধায়কেরা একে একে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরতে লেগেছেন। সিপিএম-এর সূর্যবাবু যে মানস ভুঁইয়াকে গলা জড়িয়ে নিজে হেরেও জিতিয়েছিলেন, তিনিই সবার আগে তৃণমূলে গিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ হলেন। তার পরেও এই লোকসভা নির্বাচনে যখন সিপিএম কংগ্রেসের সাথে জোটের পথে এগোল এবং নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে কংগ্রেসের চিরাচরিত ‘ল্যাং-মারা’ রাজনীতির শিকার হল, চরম হতাশায় ডুবে যাওয়া বাম কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তার দিক পাল্টে চরম ডানদিকে চলে গেলেন। উপরন্তু বিমান বসুর বেশীরভাগ আসনে তৃতীয়-চতুর্থ হওয়ার ঘোষণা বা রাহুল গান্ধীর কেরলে বামেদের বিরুদ্ধেই প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল। উল্লেখ্য, এরপরেও বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএম ঘোষিত ভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ প্রার্থী হিসাবে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর হয়ে প্রচার করেছে, যেখানে বামফ্রন্টের আরএসপি প্রার্থী ছিলেন ঈদ মহম্মদ। অর্থাৎ, সিপিএম-এর চোখে বামফ্রন্টে থাকা আরএসপি-র চাইতে কংগ্রেস বেশি ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’। হায়রে ‘বামঐক্য’ ! আর বিপরীতে শ্রী অধীর চৌধুরী ব’নে গেলেন ‘গণতান্ত্রিক’ ! ভাবা যায় ! মজার কথা হল কংগ্রেস প্রার্থী না দিয়ে সমর্থন করার পরেও কিন্তু যাদবপুরে সিপিএম-এর বিকাশ ভট্টাচার্য্য তৃতীয় স্থানেই রইলেন ! আসলে ২০১৬ পরবর্তী সময়ে তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়বার প্রশ্নে বামফ্রন্ট তথা সিপিএম নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং কেবল কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তিতে অতি-সক্রিয়তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের গোটা সংগঠনটাই আজ হাওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই পশিমবঙ্গের সিংহভাগ মেহনতী মানুষের কাছেই এবারের লোকসভা নির্বাচনে, যা তাঁদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল আগামী বিধানসভার আগের ‘সেমিফাইনাল’, তাতে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট একটি কার্যকারিতাহীন, গ্রহণযোগ্যতাহীন অবয়বে পরিণত হয়েছিল।
মুখে যাই বড়াই করুন, সকলে খোলাচোখে দেখেছেন যে, এই নির্বাচনে রাজ্যে তৃণমূল এবং কেন্দ্রে বিজেপির বিরোধিতা প্রসঙ্গে সিপিএম ও তার সহকারী বামদলগুলি যতটা কম গর্জেছেন, বর্ষেছেন এমনকি তার চেয়েও আরও কম। তৃণমূল ও বিজেপির অনুসৃত একের পর এক জণগণের পেটে লাথি মারা সরকারী নীতির বিরুদ্ধে একটি কথাও নির্বাচনী প্রচারে তাঁরা তুলে ধরলেন না, কেবল সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুটিকে ধরে পপ্যুলিস্ট প্রচারে গেলেন। এমনকি প্রচারে নিজেদের ‘উন্নয়ন’ ও ‘বিকাশ’-এর পক্ষে যে মিথ্যা ভড়ং দিয়ে গেল তৃণমূল ও বিজেপি, যেমন ‘কন্যাশ্রী’ বা ‘জিডিপি গ্রোথ রেট’, সেগুলির অসারতাকেও উন্মোচিত করল না বামেরা। ফলে বামেদের তৃণমূল-বিরোধী ভোট তো বিজেপিতে গেলই, উল্টোদিকে ২০১১-য় সরকার বদলের পরেও সংখ্যালঘু মানুষের যে অংশটি বামেদের পাশে ছিলেন, তাঁরাও সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেণ্ডায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তৃণমূলকেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি বলে মনে করলেন। ২০০৯ থেকে এরাজ্যে বামেদের যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল, ২০১৯-এ এসে তা প্রায় রক্তশূন্যতায় পর্যবসিত হল।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের আগের থেকেই অর্থাৎ ‘এক্সিট পোলের’ ফলাফলের দিন থেকেই নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোট হয়েছে কেবল ধর্মীয় মেরুকরনের ভিত্তিতে। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস ছিল এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোটে একচ্ছত্র ভাবে থাবা বসিয়েছে বিজেপি এবং মেরুকরণের রাজনীতির অন্যদিকে মুসলিম ভোটাররা ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে। বাম, তৃণমূল বা বিজেপির নেতৃবৃন্দও এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোনও মত রাখেননি। আজ বেশ জোরের সাথেই এই প্রচার চলছে যে, মানুষ এই নির্বাচনে ধর্মীয় পরিচয়কে মাথায় রেখেই ভোট দিয়েছেন এবং সার্বিকভাবে তৃণমূল সরকারের মুসলিম-তোষণের বিরুদ্ধে হিন্দুরা দিকে দিকে বিজেপিকে জিতিয়েছেন। এখন, একটা সহজ সরল হিসেবে আসা যাক। প্রথমত, লোকসভার নিরিখে যদি বিচার করা যায়, তবে মুসলিম জনসংখ্যা ৫০%-এর আশেপাশে বা তার থেকে বেশী এমন লোকসভা কেন্দ্রের সংখ্যা ৮ (মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর, বহরমপুর, বসিরহাট, মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, রায়গঞ্জ ও উলুবেড়িয়া)। অর্থাৎ বাকি লোকসভা কেন্দ্রগুলিতে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটার; সেখানে দাঁড়িয়ে যদি সম্পূর্ণ মেরুকরণের ভোট হয় তবে তৃণমূলের তো আসন সংখ্যার নিরিখে দুই সংখ্যাতেও পৌঁছানোর কথা ছিল না, সেখানে তারা কিভাবে ২২টি আসন পেল? দ্বিতীয়ত, এই ৮ টি আসনের মধ্যেই বা দুটিতে বিজেপি জিতল কীভাবে? তৃতীয়ত, ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৭.০১%। সেখানে দাঁড়িয়ে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমুলের প্রাপ্ত ভোট ৪৩.৩%, অর্থাৎ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, মুসলিম ভোট সম্পূর্ন ভাবে গেছে তৃণমুলের পক্ষে তাহলেও অতিরিক্ত ১৬% হিন্দুভোট তৃণমূল পেল কেমন করে? উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব মেদিনীপুরের মুসলিম জনসংখ্যা ২০১১-এর আদমশুমারী অনুযায়ী ১৪.৫৯%, এই জেলার দুটি কেন্দ্র কাঁথী এবং তমলুকের তৃমূলের প্রাপ্ত ভোটের গড় হয়, ৪৯.৫৮%। যদি মুসলিমদের সমস্ত ভোটও পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের খাতায় জমা পড়ে থাকে, তাহলেও অতিরিক্ত প্রায় ৩৫% শতাংশ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, এবং তাঁরা যে হিন্দু বলাই বাহূল্য। অর্থাৎ সম্পূর্ন মেরুকরনের এই যে ‘তত্ত্ব’ পশ্চিমবঙ্গের আকাশে-বাতাসে ভাসছে তাকে তাত্ত্বিকদের আষাঢ়ে গপ্পই বলা যায়। কারণ তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই বিজেপিকে সমর্থন করেননি। আসলে এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট যতটা না বিজেপির দিকে মেরুকৃত হয়েছে, তার থেকে বেশী বেশী মুসলিম জনগণ তৃণমূলকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছেন নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে বিজেপি তার জন্ম থেকেই উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের উগ্র জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে পরিচিত, তারাই পশ্চিমবঙ্গের এক বিরাট অংশের তফশিলী জাতি, আদিবাসী ও উদ্বাস্তু মানুষের উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে ২০১৮-এর পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই। সেই তালিকায় বনগাঁ থেকে রানাঘাট, পুরুলিয়া, আলিপুরদুয়ার, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া সবই আসে; আর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে এই সবকটি আসনেরদখল নিয়েছে বিজেপিযে বিজেপি সরকার এন.আর.সি করে উদ্বাস্তুদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করল অসমে, তারাই কীভাবে উদ্বাস্তু অধুষিত রানাঘাট ও বনগাঁ লোকসভা দখল করলো? গোটা দেশ জুড়ে যখন আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে একের পর এক বনাঞ্চল খনিজ সম্পদ লুঠ করবার জন্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার, তখন কিভাবে পশ্চিমবঙ্গের উপজাতি অধ্যুষিত চার কেন্দ্রের মধ্যে চারটিতেই জয়ী হলো তারা ! এক্ষেত্রে বিষয়টিকে অনেকে বিজেপির ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। যেমন বলা হচ্ছে উদ্বাস্তু অঞ্চলে বিজেপির প্রচার ছিল মুসলিমরা হলো অনুপ্রবেশকারী, তাদের এন.আর.সি-র মাধ্যমে দেশ থেকে তাড়ানো হবে এবং নাগরিকত্ব আইন দিয়ে উদ্বাস্তু মতুয়াদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এবং এতেই নাকি মতুয়াদের এক বিরাট অংশ বিজেপির দিকে ঢলে পড়ে। এত বছর ধরে নাগরিকত্ব না পাওয়া মানুষগুলো এত সহজেই এসব কথা বিশ্বাস করে নিলো, বিশেষত যেখানে অমিত শাহ নিজেই নিজেদের ‘জুমলা’ দেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন ! তার উত্তরে কেউ কেউ হাজির করছেন আর এক নয়া তত্ত্ব : এ নাকি ‘উত্তর-সত্য’ যুগ। ডাহা মিথ্যার এমন আড়ম্বরপূর্ণ নামের কী প্রয়োজন? আসলে এসব তত্ত্বের মূল ভিত্তিই হল জনগণকে নির্জীব জড় পদার্থ রূপে ধরে নেওয়া। কিন্তু খোলা চোখে লক্ষ করলেই দেখা যায় যে গোটা রাজ্য বা গোটা দেশ জুড়েই মানুষের ভোটে ছিল একই প্রবণতা : একটা পরিণামমুখী ভোট। ভোটের ক্ষেত্রে বিপুল সিংহভাগ মানুষের জন্য বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমুক দল বা তমুক মতকে সমর্থন নয়, বরং কাকে হারাতে চাই, কাকে জেতাতে চাই। হয় ছক্কা, নয় ফক্কা; হয় সাদা, নয় কালো; এক কথায় ‘ডিজিটাল’। মোদীর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র থেকেও অনেক দ্রুতহারে একটা ‘ডিজিটাল সমাজদর্শন’ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। এমনকি এই দর্শনের রোগে আক্রান্ত হয়েছে সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বও; নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের পরোয়া না করে কে সরকারে আসবে, কে যাবে, তার নির্ণয় করবার পরিকল্পনায় নেমে পড়েছিল সবাই। 
কিন্তু গোটা দেশের রাজনীতির দিক থেকে এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে সম্পূর্ণরূপে একটা গুরত্বহীন ও অগ্রহণযোগ্য শক্তি হিসেবে বাতিলের খাতায় ফেলেছে দেশের জনতা। যে উত্তরপ্রদেশকে পাখির চোখ করে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের প্রধান মুখ হিসেবে প্রচারে নামিয়েছিলেন সেখানকার দায়িত্ব দিয়ে, সেখানে মাত্র ৬% ভোট পেয়েছে কংগ্রেস ! রাহুল গান্ধী নিজে হেরেছেন বাপ-দাদার জায়গীর ‘আমেথি’ থেকে ! কেবল উত্তরপ্রদেশ নয়, গো-বলয়ের সমস্ত রাজ্যে পর্যুদস্ত হয়েছে কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীশগঢ় সহ যে কটি রাজ্যে মাত্র কটা দিন আগে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস সরকার তৈরি করেছিল, সেখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। কেবল তা-ই নয় কংগ্রেস-সহ সমস্ত মোদিবিরোধী তথাকথিত ফেডেরাল ফ্রন্টের মুখগুলিকেও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফেডেরাল ফ্রন্টের মুখ হিসেবে যারা সবথেকে আলোচিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি কার্যত ধরাশায়ী হয়েছেন নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে। বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল লোকসভায় একটিও আসন পায়নি, মায়াবতী-মুলায়মের জোটও সম্মিলিতভাবে মাত্র ১৫ টি আসন পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও মমতা ব্যানার্জীর তৃণমুল-কংগ্রেস ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপির কাছে। আর সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট তো গোটা দেশে কার্যত বিলোপের পথে চলে গিয়েছে।
আসলে এই শক্তিগুলি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে মানুষের কাছে কখনই বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারেনি, না শক্তি হিসাবে, না কোনও বিকল্প নীতির ভিত্তিতে। ফলে দেশের সিংহভাগ জনগণ ভোট দিয়েছেন ‘স্টেবিলিটি’-র পক্ষে। বিজেপি সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপগুলি, যেমন জিএসটি, নোটবন্দী, ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণ ইত্যাদি প্রশ্নে, কোনও প্রকৃত বিরোধিতা বা তার কোনও বিকল্প প্রস্তাব হাজির করেনি এরা কেউই, শুধু এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলি একটু মোলায়েম ভাবে করবার দাবী তুলেছে; আর তার আসল কারণ হল এরা প্রত্যেকেই ঐ একই পথের পথিক। ফলে আপামর দুর্নীতিতে ডুবে থাকা কংগ্রেসের ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান বা একাধিকবার বিজেপির জোটসঙ্গী থাকা দলেদের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতার নামে বিজেপি-বিরোধী মহাজোট মানুষের কাছে এক পসলাও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আর ঠিক এখানেই মোদির ‘মজবুর সরকার নয়, মজবুত সরকার’ স্লোগান কাজে লেগে গিয়েছে।
শেষে না বললেই নয়, বিজেপির এই বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়ের সাথে সাথে দেশের রাজনীতিতে সব চেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে বামেদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সিপিএম-এর তিন শক্তিশালী ডেরায় এসেছে একটি মাত্র সিট ! মহারাষ্ট্রের দিকবিদিক উজাড় করা সেই কৃষক-জাঠার পরেও বিজেপি ও শিবসেনা পেয়েছে ৪৮ টির মধ্যে ৪১ টি আসন, বামেরা ০ ! কীভাবে?
আসলে ১৯৯০-৯১ সালে দেশে নয়াউদারবাদ ঢুকে পড়বার পর থেকেই মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত শ্রেণীগুলি বুঝতে শুরু করেছিল তাদের এতে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, কিন্তু বিপুল অংশের শ্রমজীবী মানুষের সাহায্য-সমর্থন না পেলে তাদের আখের গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা মেহনতী মানুষের পার্টি তথা সিপিএম সহ বামদলগুলিকে ব্যবহার করে; শ্রমিকদরদী মুখোশ পরে তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাদের ঘাড়ে চেপে বসে; নিজেদের স্বার্থান্বেষী দাবিগুলি, যেমন বিপুল মাইনে বাড়ানো, চাকরির মেয়াদ বাড়ানো, ডিএ, এমন শিল্পায়ন যাতে তাদের ঘরের ছেলেমেয়েদেরই চাকরি হবে, আয়করে ছাড়, ধনী কৃষকদের কৃষিঋণ (স্বাভাবিকভাবেই সরকারী ঋণ) মুকুব ইত্যাদিকেই সামাজিক দাবী বলে প্রতিষ্ঠা দেয়, দরিদ্র শ্রমিক-কৃষককে শ’ শ’ মাইল পথ হাঁটিয়ে, ব্যারিকেড ভাঙতে তাঁদেরকে লড়িয়ে দিয়ে, তাঁদেরই কাঁধে পা রেখে সেসব দাবীর বেশীর ভাগ আদায়ও করে, এবং সব মিটে গেলে “ঘরের ছেলে ঘরে ফেরো” বলে বিজেপির মতো চরম দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দলের নিরাপদ আশ্রয় বেছে নেয়। আর যে শ্রমজীবী মানুষ বামেদের নেতৃত্বে এতদিন এই মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত শ্রেণীগুলোর পিছনেই চলতে শিখেছিল, তারাও স্বাভাবিকভাবেই এখনও তাদেরই পিছু নিলো। বামদের হাতে রইল পেনসিল। …
 
কিংশুক চক্রবর্তী পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেড-এর সদস্য। 
প্রচ্ছদঃ শ্রীমন্ত বোস 
 
Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *