বিশ্বব্যাপী করোনা সৃষ্ট অতিমারীর প্রেক্ষিতে গত ২২শে মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ডাকে ‘জনতা-কারফিউ’-এর মধ্যে দিয়ে এদেশে শুরু হয় ‘লক্-ডাউন’ ⚊ নাকি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর ‘অব্যর্থ ঔষধি’ ! সদ্য ১২ই মে ওনার আরেকটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে কার্যত শুরু হয়ে গেল এই ‘লক্-ডাউন’ তুলে নেবার প্রক্রিয়া। এই গোটা প্রক্রিয়ায় অন্যান্য রাজ্যের মতোই আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর সাথে ‘খাট্টা-মিঠা’ সম্পর্কের আড়ালে একান্ত অনুগত শিষ্যের মতোই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন, তখন পুলিশ দিয়ে লোক পিটিয়ে, আর এখন ‘রেড জোন’-কেও তিন ভাগে ভাগ করে…। কিন্তু ঘটনা হল, যখন ‘লক্-ডাউন’ চালু করা হয়েছিল, সেই ২২শে মার্চের প্রাক্কালে এদেশে করোনা আক্রান্তর সংখ্যা ছিল ২০০, আর এখন যখন ‘লক-ডাউন’ উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তখন সংখ্যাটা ৮০ হাজার ! তখন করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৪, আজ যা ২.৫ হাজারেরও বেশি ! আমেরিকা ও ইউরোপের যে প্রধান দেশগুলি ঐরকম সময়েই ‘লক-ডাউন’ চালু করেছিল, তারাও এখন ক্রমে তা খুলতে শুরু করেছে; তাদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও অনেক ভয়াবহ ! স্পষ্টতই বোঝা যায় যে সরকারের ‘লক্-ডাউন’ চালু করার সাথে দেশের জনগণকে করোনার অভিশাপ থেকে বাঁচাবার কোনও সম্পর্কই নেই। বিপরীতে করোনাই যে তাদের কাছে আশীর্বাদ রূপে হাজির হয়েছে মোক্ষম সংকট কালে, সেইটেই আমরা তুলে ধরবো এই প্রবন্ধে।
এটা তো যেন ম্যাজিক যে, শ্রমিকরা একদিনের ধর্মঘট ডাকলে যে সরকার পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে চরম শাসানি আর অকথ্য অত্যাচার চালায়, যে কর্পোরেট মহল তাদের ‘লস্’এর খতিয়ান দিতে মরাকান্না জুড়ে দেয়, আর যে মিডিয়া দিনভর “শ্রমদিবস নষ্ট” আর “যাত্রী দুর্ভোগ”-এর ফাটা রেকর্ড চালাতেই থাকে, তারাই অকস্মাৎ জনদরদে আপ্লুত হয়ে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে ‘লক-ডাউন’ চালাতে যারপরনাই ভূমিকা পালন করলো ! প্রতিদিন মানুষের ওপর অনাহার-অপুষ্টি-বেরোজগারি-অর্থাভাব-ঋণের বোঝা-দাঙ্গা চাপিয়ে দিয়ে লাশের পর লাশের ওপর পা রেখেই যারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, সেই ‘অঘোরীবাবা’-রাই হটাত মানুষের মৃত্যুতে এত চিন্তিত ! দূর-দূর প্রান্ত থেকে পাচার করে আনা শ্রমিকদের শুষে-পিষেই যারা নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, সেই সরকার-কর্পোরেট-মিডিয়া ত্রয়ীই আচমকা পরিযায়ী শ্রমিকদের যন্ত্রণায় আকুল ! রবি ঠাকুরের কথায় বলা যায় : “এদের ভাবনার জন্যই ভাবনা হয়”। স্বাভাবিকভাবেই এই ত্রয়ীর কাছে রীতিমতো মস্তিষ্ক বন্ধক না দিয়ে থাকলে তাদের এই ‘কুমীরের কান্না’-য় যে কেউ সহজে ভুলবে না, তা বলাই বাহুল্য। আর সেজন্যই ‘করোনা’ রোগটির বিজ্ঞানসম্মত মোকাবিলার বদলে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর মন্ত্র আর ‘মাস্ক’-এর মাদুলি চাপিয়ে দেওয়া হল আইন করে; প্রত্যেকের নিজ ঘরকেই ‘যন্তর-মন্তর’ বানিয়ে দিয়ে ‘বোকাবাক্স’-এর মাধ্যমে চালানো হল ব্যাপক ‘মগজধোলাই’। কিছুটা রোগের ভয়ে আর কিছুটা আইনের ভয়ে জনগণ মেনে নিল সবকিছু। সরকার-কর্পোরেট-মিডিয়া ত্রয়ীর সৃষ্ট এই ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর কাছে আপাতত আত্মসমর্পণ করলো জনতা, গোটা দুনিয়ার দেশে দেশে।
আমাদের দেশে ঠিক যেমন ২০১৬-এ ‘নোটবন্ধী’-র সময় ‘কালাধন’ ছিল অজুহাত, সেদিন যখন আমরা তা বলেছিলাম, মানতে চাননি প্রায় কেউই, কিন্তু আজ যা সকলের কাছে পরিষ্কার, ঠিক তেমনই আজকের এই ‘লক্-ডাউন’-এর জন্য ‘করোনা’ হল এক অজুহাত, যদিও এবার ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে তা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এ হেন অজুহাতের পিছনে আসল কারণটি কী, তাই-ই ব্যখ্যা করার চেষ্টা করছি আমরা। প্রথমত, করোনার প্রেক্ষিতে ‘লক্-ডাউন’-এর ফলে অর্থনীতি কি চরম সংকটে পড়ে গেছে এবং ফলত দেশ-দুনিয়াকে আবার এই খাদের থেকে তুলে আনতে জনসাধারণকে আর একটু কষ্ট স্বীকার করতেই হবে, এই প্রচারই এখন তুঙ্গে নিয়ে আসার জন্য মরিয়া এই সরকার-কর্পোরেট-মিডিয়া ত্রয়ী। কিন্তু আমরা যদি এই লক্-ডাউনের ঠিক প্রাক্কালে অর্থনীতির হালটা কেমন ছিল তা একবার মনে করি ?
বিশ্বব্যাপী কর্পোরেটদের আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা আইএমএফ-এর তাত্ত্বিক গীতা গোপীনাথ গত ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই তাঁর একটি প্রবন্ধে দাবী করেছিলেন যে, গোটা দুনিয়া জুড়ে স্টক-ভারসাম্যহীনতা, তথা ঋণদাতা দেশগুলির উদ্বৃত্ত ও ঋণগ্রহীতা দেশগুলির ঘাটতি, বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তার পরিমাণ বিশ্ব-জিডিপির প্রায় ৪০%, এবং ফলে বিশ্ব-অর্থনীতি গভীর সংকটের গহ্বরে প্রবেশ করছে [১]। এর ছয়মাসের মাথায় ২০১৯-এর ডিসেম্বরে তিনি আরও দুই অর্থনীতিবিদের সাথে যৌথভাবে আরেকটি প্রবন্ধে দাবী করেন যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে [২]। এই একই সময়ে, আই.এম.এফ.-চীফ ক্রিষ্টালিনা জর্জিয়েভা জানান যে, গভীর অর্থনৈতিক সংকটে গোটা বিশ্ব-অর্থনীতি নিমজ্জিত হতে চলেছে, যার সবচাইতে খারাপ প্রভাব পড়তে চলেছে ভারত ও ব্রাজিলে। এইসময়ে ভারতের অটোমোবাইল শিল্পে লক্ষাধিক কর্মী ছাঁটাই চলতে থাকে, গুদামকে গুদাম গাড়ি ডাঁই হয়ে পড়ে থাকবার ছবি উঠে আসে সংবাদপত্রে (উল্লেখ্য, ২০১৯-এর জুলাই মাসের মধ্যেই আমাদের দেশে গাড়ী শিল্পে ২ লক্ষ ৩০ হাজার কর্মী এবং গাড়ির পার্টসের শিল্প থেকে ১০ লক্ষ কর্মী ছাঁটাই হয়ে গিয়েছিলেন); এফএমসিজি (নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য) মার্কেটে বিক্রির হারও ব্যাপক ভাবে কমে যায়। অথচ এসময় ভারতে ‘সেন্সেক্স’ পৌঁছোয় তার সর্বকালীন উচ্চতায়, ৪০ হাজার পয়েন্টের ওপর (চিত্র-১)।
একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় বিশ্বের তাবড় অর্থনীতির দেশগুলোয়। গীতা গোপীনাথ-এর দেওয়া তথ্যেই [২] দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৮-র শুরু থেকে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিল্পোৎপাদন ও বিশ্ববাণিজ্য দুয়েরই ব্যপক পরিমাণ পতন ঘটেছে (চিত্র-২), কিন্তু বিশ্বব্যাপী শেয়ার বিক্রির পরিমাণ দুনিয়ার মোট জিডিপি-র ৯০%-এর ওপর থেকেছে (তথ্যসূত্র : World Bank)। এই ‘কন্ট্রাডিকশন’-ই গভীর অর্থনৈতিক সংকট হাজির করেছে।
এখন দুটি বিষয় আমরা তুলে ধরবো : এক, এটি ২০১৮-১৯-এ আচমকা উপস্থিত হওয়া কোনও দুর্ঘটনা নয়, এমনকি ২০০৮-এর সংকটের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের জন্যও নয়, বরং নয়াউদারবাদের যুগে বিশ্ব-পুঁজিবাদী অর্থনীতি যে রূপ নিয়েছে, এটি তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম; এবং দুই, এই সময় এর থেকে সাময়িক উদ্ধারের জন্য পুঁজিবাদের আবশ্যিক ভাবে কী কী প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
নয়াউদারবাদের অর্থনীতির একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্যই হলো, প্রথমত উৎপাদনের থেকে শেয়ারে বেশি বিনিয়োগের ঝোঁক, এবং দ্বিতীয়ত, শেয়ার বাজারে ‘বাস্তব স্টক’-এর থেকে ‘কাল্পনিক স্টক’-এ (যা এখনও অব্দি উৎপাদনই হয়নি) বেশি বিনিয়োগের প্রবণতা [৩]। এর ফলে ‘স্টক বিক্রি’-র সাথে ‘বাস্তব উৎপাদন’-এর কোনও সঙ্গতি থাকে না এবং শেয়ার বানিজ্যের বেশিরভাগটাই (প্রায় পুরোটাই) চলে ঋণ মারফত। এধরণের স্টকের দাম, কেবল সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয় বলে যেকোনোও ‘আর্বিট্রারি’ মান অব্দি পৌঁছে যেতে পারে, যা এমনকি বাস্তব জিডিপির মানকেও ছাপিয়ে যেতে পারে, আর যাচ্ছেও। আর স্বাভাবিকভাবেই তার পরেই নামছে বড় বড় অর্থনৈতিক ধ্বস। নিচে (চিত্র-৩) আমরা জিডিপি-র শতাংশ হিসাবে ‘স্টক বিক্রি’-র পরিমাণ লেখচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছি, যেখানে বিশ্বের দেশগুলিকে ভাগ করা হয়েছে উচ্চ আয় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউকে, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি), উচ্চ-মধ্য আয় (চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল ইত্যাদি), নিম্ন-মধ্য আয় (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, কেনিয়া ইত্যাদি) ও নিম্ন আয় (নেপাল, সিরিয়া প্রভৃতি)-এর ভিত্তিতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের দেশগুলির সকলের মিলিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
লেখচিত্রের ‘পিক’-গুলিই বাস্তব উৎপাদনের সাপেক্ষে ‘কাল্পনিক স্টক’-এর মাত্রাহীন ভাবে বেড়ে ওঠা ও তার অব্যাবহিত পরেই ধ্বস নামাকে চিহ্নিত করছে। প্রথমত, এই সংকট প্রায় ৮ বছরের চক্রে আসতে দেখা যাচ্ছে, যেমন ১৯৯০-৯২, ২০০০-০১, ২০০৮-০৯, ২০১৫-১৬; দ্বিতীয়ত, প্রথমে উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে দেখা দিয়েছে, তার পর উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে, যা নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে একই রকম কিন্তু কম প্রভাব ফেলেছে; তৃতীয়ত, ২০০৮ থেক ’১৬-র মধ্যে সংকটের প্রধান কেন্দ্র উচ্চ আয় থেকে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে; এবং শেষত, এই সময় উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে ধ্বস নামার পরেও ‘স্টক বিক্রি’-র নিম্নসীমা জিডিপি-র থেকে বেশি থেকে গিয়েছে।
আসলে ঋণ-নির্ভর অর্থনীতির এই ব্যবস্থায় ‘স্টক বিক্রি’ আর ‘বাস্তব উৎপাদন’-এর এহেন অসঙ্গতির মাঝখান থেকেই মুষ্টিমেয় একদল জুয়াচুরির রাঘব বোয়াল তাদের ‘কন্ট্যাক্ট’ আর ‘ইনফরমেশন’-এর জোরে গোটা দুনিয়ার রাজনীতি-অর্থনীতির হাঁড়ির খবর হাতে নিয়ে এই ফাটকায় ব্যাপক মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছে। সমস্যাটা হচ্ছে তখন যেই ঋণ শোধের সময় তথা ‘ম্যাচিওরিটি ডেট’ এসে উপস্থিত হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত উৎপাদন, ফাটকার ফলে তৈরী হওয়া কাল্পণিক উৎপাদনের সাথে মিলতে পারছে না; ফলে ধারদাতার প্রাপ্য ‘অ্যাসেট’টি হয়ে যাচ্ছে ‘নন-পারফর্মিং’, তথা ‘এনপিএ’। এটি দু’একটি নীরব মোদী-মেহুল চোকসির ব্যাপার নয়, বরং গোটা দুনিয়া জুড়েই এই একই পরিস্থিতি। নিচের লেখচিত্রটিতে আমরা এই সব বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের দেশগুলির জিডিপি-র সাপেক্ষে প্রাইভেট সেক্টরকে দেওয়া ঋণের তথ্যটি তুলে ধরলাম (চিত্র-৪)।
স্পষ্টতই, আমেরিকা ও ইউরোপের উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে প্রাইভেট সেক্টরকে দেওয়া এই ঋণের পরিমাণ ’৮০-র দশকেই তাদের জিডিপি-কে ছাপিয়ে গিয়েছিল আজ যা প্রায় ১৫০%, চীন-রাশিয়া-ব্রাজিলের মতো দেশগুলোয় ২০০৮-এর পর থেকে (২০০৮-এর সংকটের প্রভাব এদের ওপর কম ছিল) এই ঋণ দেওয়া ব্যাপক হারে বেড়ে জিডিপি-কে পার করে ফেলে এবং ক্রমে ক্রমে আমেরিকা-ইউরোপের হারেকে ছুঁতে চলেছে। ভারতের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলিতে এই ঋণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে; আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ২০১৬-র সংকটের পর ঋণের পরিমাণ এক লাফে অনেক খানি বেড়ে এঁদেরকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।
এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায় ২০২৪ সাল নাগাদ পরবর্তী চরম সংকটটি আছড়ে পড়তে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ : এক, সংকটের বৃহৎ চক্রগুলির (প্রায় ৮ বছর) মাঝেও অন্তর্বর্তীকালীন সংকট দেখা দিতে পারে (চিত্র-৩-এ ২০০৮ ও ’১৬-র মাঝে ’১০-এর সংকট লক্ষ্য করুন); আর দুই, ২০১৬-র সংকটের পর উচ্চ আয়ের দেশগুলির সাথে গোটা বিশ্বেরও ‘স্টক বিক্রি’-র নিম্নসীমা জিডিপি-র প্রায় সমান থেকে গেছে। ফলে সংকটের চক্রের সাথে সাথে বিশ্ব-অর্থনীতি একটি স্থায়ী সংকটের আবহে প্রবেশ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব-পুঁজিবাদের সামনে কী কী রাস্তা খোলা থাকতে পারে ?
প্রথমত, পুঁজিবাদের সমস্ত সংকটই অতি-উৎপাদনজনিত, অর্থাৎ, মাল বেচে উঠতে না পারা থেকে সৃষ্ট। ফলে ছোটখাটো পরিস্থিতিতে উৎপাদন বন্ধ করতে কারখানা ‘লক্-আউট’ করে সে সামাল দেয়, কিন্তু সংকট বড় আকার নিলে ব্যাপক বিস্তৃত আকারে উৎপাদন বন্ধের প্রয়োজন, লক্-আউটের বদলে সেক্ষেত্রে চাই ‘লক্-ডাউন’। বিশেষত, ‘ফিন্যান্সিয়াল ইয়ার-এন্ডিং’-এর সময় এই উৎপাদন বন্ধ করা গেলে যে শুধু অতি-উৎপাদন কমানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তাই-ই না, সাথে মাল বেচার জন্য ‘সেল্’ দেওয়ার পরিবর্তে এমনকি জোগানের ‘আপাত-অভাব’ দেখিয়ে বেশি দামেও মাল বেচা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে ক’দিন (লক্-ডাউন চালুর) আগে যে গাড়ি-শিল্প এবং এফএমসিজি মাল বেচে উঠতে পারছিল না, বম্বে স্টক এক্সেঞ্জে তাদেরই শেয়ার প্রাইস আজ বাড়ছে হররোজ।
দ্বিতীয়ত, আজকের দিনে সংকট শুধু বাস্তব অতি-উৎপাদন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে না, কাল্পনিক স্টক-এর অতি-উৎপাদন থেকেও আর সেইটেই প্রধান। এই কাল্পনিক স্টক বিক্রির পরিমাণ শুধু চক্রাকার সংকট কালেই বাস্তবের ঊর্ধ্বে উঠছে না, এসময় ধ্বস নামার পরেও তা জিডিপি-র প্রায় সমপরিমাণ থেকেছে। ফলে সামগ্রিক ভাবে শেয়ার প্রাইস কমিয়ে ফেলা এই সংকটে এক অন্যতম প্রধান চাহিদা। দুনিয়ার দেশে দেশে ‘লক্-ডাউন’-এর ফলে শেয়ারে বিনিয়োগ এই সময় বেশ খানিকটা নেমে যাবে যা ভারসাম্য সৃষ্টিতে বেশ কিছুটা সাহায্য করবে বলেই বুর্জোয়ারা আশা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারসাম্যহীনতার কারণে ৪০ হাজার পয়েন্ট পেরিয়ে যাওয়া আমাদের দেশের ‘সেন্সেক্স’ লক্-ডাউনের ফলে এক ঝটকায় নেমে আসে ২৫ হাজারে।
তৃতীয়ত, শুধু উৎপাদনই নয়, উৎপাদিকা শক্তিকেও কমিয়ে ফেলতে হয় অতি-উৎপাদনের মহামারিতে। মনে রাখা প্রয়োজন, উৎপাদনে শ্রমিকই হল প্রধান উৎপাদিকা শক্তি এবং তাই ব্যাপক ছাঁটাই ছাড়া পুঁজিবাদের আর কোনও পথ থাকে না; এবং বর্তমান কাল্পনিক স্টকের যুগে সংকট থেকে মুখ তুলতে গেলে শ্রমিকের স্টকও কমিয়ে ফেলা একান্ত জরুরী। এজন্যই ‘মাইগ্রেটেড ওয়ার্কার’ ও ‘রিফিউজি’-র সংখ্যা কমাবার চেষ্টা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। আমেরিকায় ট্রাম্পের ‘অভিবাসন নীতি’ বা ভারতে মোদীর ‘এনআরসি’ এরই অংশ মাত্র। উল্লেখ্য যে বুর্জোয়া অর্থনীতির তত্ত্বে এই সব মানুষকে ‘মাইগ্রান্ট স্টক’ বলেই অভিহিত করা হয়। আমরা নিচে লেখচিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের জনসংখ্যার সাপেক্ষে ‘মাইগ্রেশন’-এর এই ‘স্টক’-এর তথ্য তুলে ধরলাম (চিত্র-৫)।
চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে অন্যান্য দেশ থেকে মাইগ্রেশন হয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ১৯৯০ থেকে ক্রমাগত বাড়তে থেকেছে যা আজ তাদের দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৫%। উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলিতে এটি সামান্য বেড়েছে আর আমাদের মতো অন্যান্য দেশে তা কমেছে। করোনার আবহে আমেরিকা ইউরোপ থেকে বিদেশিদের তাদের দেশে পাঠানোর এবং আমাদের তাদের এখনই ফেরত আনার যে হিড়িক তোলা হয়েছে, তা ‘শ্রমশক্তি’-র স্টকের এই চাহিদার সাথে অতীব সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে একটা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : একটা দেশের মধ্যেও অঞ্চল ভিত্তিতে উৎপাদন ও বাণিজ্যের নিরিখে উচ্চ আয়, উচ্চ-মধ্য, নিম্ন-মধ্য ও নিম্ন আয়ের ভাগ আছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে দিল্লী (রাজধানী), মহারাষ্ট্র (মুম্বাই বাণিজ্যিক রাজধানী), গুজরাত (আমেদাবাদ), কর্ণাটক (ব্যাঙ্গালোর) অন্যান্য রাজ্যের সাপেক্ষে কিছুটা আমেরিকা-ইউরোপেরই সমতুল্য। ফলে এখান থেকে ‘মাইগ্রান্ট স্টক’ কমানোটাও এই সংকটে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। এজন্যই এই সব এলাকার পরিযায়ী শ্রমিকদের তাদের ঘরে ফেরত পাঠানো সংকটে ডুবে থাকা পুঁজিবাদের জন্যও একান্ত জরুরী। এজন্যেই তো পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি মিডিয়ার আকস্মিক প্রীতি এবং সরকার-বিরোধী নির্বিশেষে অকস্মাৎ সবার চিন্তায় উদগ্রীবতা ! আমরা তো প্রশ্ন করতেই পারি, এখন যখন লক্-ডাউন তোলার প্রক্রিয়া শুরু করছেন, তাহলে এই লক্-ডাউনের শেষকালে এসে এঁদের বাড়ি ফেরানোর এত তাড়া কেন ? বা এঁদেরকে কর্মস্থানে সুরক্ষিত ভাবে রাখার বন্দোবস্ত করা হল না কেন ? তাঁদের যে যার রাজ্যে ফিরে গিয়ে ১০০ দিনের কাজে ঢুকতে বলা হচ্ছে কেন ? দিল্লী-মহারাষ্ট্র-ব্যাঙ্গালোর-আমেদাবাদ থেকে যে ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদেরকে নিজের রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে, মাইগ্রেশনে দেশে তৃতীয় স্থানে থাকা পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না কেন ? আসলেই এই শ্রমিকরা আপনাদের জন্য ‘মাইগ্রান্ট স্টক’ এবং সংকটে প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল থেকে তা ছেঁটে ফেলাই আপনাদের লক্ষ্য, একথা আজ জলের মতো স্পষ্ট !
চতুর্থত, এই সংকট-এর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি যে তা এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে অন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে, স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে চক্র থেকে চক্রে। এটা ঘটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে, যেহেতু ব্রেটন-উড্স্ সিস্টেমের পতনের পর থেকে বহির্বাণিজ্য আর ‘গোল্ড ষ্ট্যাণ্ডার্ড’-এ হয় না, হয় প্রধান কয়েকটি দেশের মুদ্রায় (ডলার, ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন), এবং ফলে এক দেশ থেকে এই মুদ্রাই অন্য দেশে বহন করে নিয়ে যায় সংকটের বোঝা। সেজন্য নিজের সংকটের বোঝা অন্য দেশে চালান করতে অথবা অন্যের সংকটের বোঝা নিজের দেশে বাড়িয়ে না তুলতে এই গভীর সংকট কালে ‘ট্রেড ম্যানিপুলেশন’ তাদের জন্য অপরিহার্য। সাম্প্রতিক অতীতে যে আমেরিকা-চীন ‘ট্রেড ওয়ার’ চলেছে, যা এখনও অব্যাহত, তা এরই দ্যোতক। করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর নামে আদতে এই বৈদেশিক বাণিজ্যকে ব্যাপক ভাবে ইচ্ছামতো টান বা ছাড় দেওয়ার কাজ চলতে দেখা যাচ্ছে এই সময়।
পঞ্চমত, পুঁজিবাদের সংকট ব্যাপকতার রূপ নিলে সে নিজেই নিজের উৎপাদিকা শক্তির ধ্বংস সাধন করে। তার জন্য বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ডেকে আনা থেকে শুরু করে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বা পরমাণু অস্ত্র নিক্ষেপ করে লক্ষাধিক জনগণকে খুন করতে সে পিছপা হয় না; ইতিহাসে তার সাক্ষ্য সে ইতিমধ্যেই রেখেছে। কিন্তু বিশ্বায়িত পুঁজি, ট্র্যান্স-ন্যাশনাল কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক শেয়ার হোল্ডিং-এর যুগে দেশে দেশে যুদ্ধ হাঁকা স্বাভাবিক ভাবেই তার শেষ অপশন। সুতরাং অন্য যেকোনও উপায়ে বিপুল সংখ্যক মৃত্যু তার উপকারই করবে। নতুন করোনা ভাইরাসটি ল্যাবরেটরিতে বানানোই হোক, বা তা প্রাকৃতিক মিউটেশনেই সৃষ্টি হয়ে থাকুক না কেন, এটি যে ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বের ৩ লক্ষাধিক (ঘোষিত তথ্য অনুযায়ী) মানুষের প্রান কেড়ে নিয়েছে, এবং পরোক্ষভাবে (স্বাস্থ্য পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও লক্-ডাউনের ফলে) আরও কত লক্ষ তা এখনও অজানা, তাতে পুঁজিবাদ যে তার সংকটমোচনের আশা দেখছে, তা বলাই বাহুল্য। অথচ করোনার ফলেই যেন এই সংকট, এমন কথা প্রমাণের জন্য মরিয়া সে।
শেষত, এসবের ফলেও পুঁজিবাদ তার সংকট থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ এসবই, ক্যান্সারের সিম্পটম চাপা দেওয়ার পথ্য মাত্র, ক্ষয়রোগে সে আরও দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু করোনাদেবীর পূজার নামে জনগণের ঘাড়ে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর নামাবলী জড়িয়ে দিয়ে যে ‘সোশ্যাল ডারউইনিজ্ম্’-এর ভাইরাসটির ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর, গভীর থেকে গভীরতর সংক্রমণ করে ফেলতে সক্ষম হল পুঁজিবাদ, তা আগামীদিনের আরও গভীর সংকটে তার হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
ফলে সাধারণ মানুষের জন্য এক বিভীষিকা হলেও ইতিমধ্যেই ঘোর সংকটে ডুবে যাওয়া বিশ্ব-পুঁজিবাদের জন্য এই বিশেষ সময়ে আবির্ভূত হওয়া ‘করোনা’ আশীর্বাদই বটে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকটের সকল দায় এই ‘অতিমারীর প্রকোপ’ বলে চালাবে তারা, আর অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের কাজ কেড়ে নিয়ে যে কিয়দাংশের জন্য কাজ রাখবে, সেখানে চালাবে অকল্পনীয় শোষণ, কাজের সীমা ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২-১৪ ঘন্টা ক’রে দিয়ে। ইতিমধ্যেই ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ লা এপ্রিল ২০২০-এর হিসেব মতো কেবল এই কোয়ার্টারেই হ্রাস পেতে চলেছে ৬.৭% শ্রমঘন্টা, যা কার্যত দুনিয়া জুড়ে ১৯ কোটি ৫০ লক্ষ পূর্ণ-সময়ের শ্রমিকের সাধারণ শ্রমঘণ্টার সমান। এই তথ্যই কি দুনিয়া জুড়ে যে কোটি কোটি মানুষের জন্য ছাঁটাই, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য-অনাহারের দিন আসতে চলেছে তার ন্যূনতম পরিসংখ্যান তুলে ধরছে না ? এর বাইরে রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোটি কোটি শ্রমিক আর ততোধিক অনাহারে থাকা খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষক। কারা এঁরা ? হারাবার আর কিছুই না থাকা সর্বহারার দল।
পরিশেষে শুধু এটুকু বলার, যে, ইতিহাস আমাদের দেখায়, পুঁজিতন্ত্রের সংকটের সমস্ত বোঝা-ই মালিকের দল শ্রমিকের উপর চাপিয়ে তাকে শুষে, পিষে, খুন করে নিজেরা বৈতরণী পার হতে মরিয়া হয়ে ওঠে, শ্রমিক শ্রেণীর দিকে তাক করে রাখে হাজার হাজার বন্দুকের নল; কিন্তু তারই সাথে সে পথ করে দেয় আরেক সম্ভাবনাকে, বন্দুকের সে নল উল্টে তার দিকেই ঘুরিয়ে দেওয়ার, মেহনতী জনতার সচেতন, সংগঠিত ও পরিকল্পিত প্রয়াস মারফৎ, যা পরিণতি পেতে পারে সমাজে মেহনতীরাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে; কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো যেমনটা বলেছেন : “গভীর সংকট মহান সমাধানের পথ খুলে দেয়”।
অরিত্র বসু ও বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের সদস্য
সূত্র :
[১] https://blogs.imf.org/2019/07/17/rebalancing-the-global-economy-some-progress-but-challenges-ahead/
[২] https://blogs.imf.org/2019/12/18/2019-in-review-the-global-economy-explained-in-5-charts/
[৩] Basudev Nag Chowdhury, “Neoliberalism: No reformist solution to its crisis”, https://www.jabardakhal.in
Ups and down in share market depends upon the following.
1. Fundamentals of the company
2. Future business planning like expansion or diversification.
3. Market sentiment
Now the future of share market is bleak following covid 19.
সংকট মোকাবিলায় তৈরি থাকতে হবে সবের অভিভাবক হিসেবে কাজ করছেন না কোনো দলই, ক্ষমতা আছে ফেক ,, এখনও ক্ষমতা আছে জেনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও রাজনৈতিক দল গুলো বোকা বাক্স তে বন্দী মানুষ গুলোকে আরও বোকা বানিয়ে যাচ্ছে, না খেতে পাওয়া নিরপরাধ মানুষ গুলোকে খুন করছে ইনডাইরেক্ট ভাবে, আমি জানি না এর সুরাহা কবে হবে ক্ষমতার অপব্যবহার কবে বন্ধ হবে আর কবে মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে আরম্ভ করবে,,, অভিভাবক যদি ঠিক না হন তাহলে মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে বন্দী থাকা ছাড়া আর কোন পথ আমার চোখে পড়ছে না।।