এবছরের শুরুতে জানুয়ারী মাসে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগেই কেন্দ্রের বিজেপি-সরকার ঘোষণা করেছিল আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সাধারণ নাগরিকদের জন্য ১০% সংরক্ষণের কথা, আর এবার সেই কেন্দ্রীয় আইন হুবহু মেনে নিয়েই রাজ্যের তৃণমূল সরকার এই ব্যবস্থায় সিলমোহর দিল। এই রাজ্যে সংরক্ষণের বাইরে থাকা ৫২% আসনের ১০% আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া সাধারণ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর এই সংরক্ষণকে সিলমোহর দেওয়া হয়। তৃণমূল সরকারের পরিষদীয় মন্ত্রী এবং দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই আইনের সপক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্তি দেন যে এই আইন চালু হলে সাধারণ শ্রেণির আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ চাকরির ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে।

কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে সাম্প্রতিক কমল নাথ নেতৃত্বাধীন মধ্য প্রদেশও একই পথে হেঁটেছে। ব্যাতিক্রমী অবস্থানে কেবল তামিল নাড়ু। পশ্চিমবঙ্গের সরকারের এই সিদ্ধান্তকে রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সবাই স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেন, অন্যদিকে সিপিআই(এম)-নেতা এবং বাম-পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী একধাপ এগিয়ে জানান যে, অনেক আগেই এই বিষয়টি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। আসলে এই ১০% সংরক্ষণ-এর সর্বতোভাবে পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বাম-কংগ্রেস সকলেই। রক্তক্ষরণ হতে হতে রক্তশূণ্যতার দিকে যেতে থাকা সিপিআই(এম) এর আগেও জানুয়ারীতে কেন্দ্রীয় সরকারের সংরক্ষণের প্রস্তাবের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁদের পলিটব্যুরো সদস্য পিণরাই বিজয়নও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। 

কেন্দ্রীয় সরকারের সংরক্ষণের এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, আট লক্ষ টাকার নীচে যাদের বার্ষিক আয় তাঁরা এই সংরক্ষণের আওতায় আসবেন। অর্থাৎ মাসে যে পরিবারের গড় আয় প্রায় ৬৫,০০০ টাকা তারাও এই সংরক্ষনের সুযোগ লাভ করবেন। এবার প্রথম প্রশ্নই হলো, মাসে যে পরিবারের আয় ৬৫,০০০ টাকা তাঁরা কি সত্যিই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া? এহেন প্রশ্নের পরেই যে প্রতিপ্রশ্ন আসবে তা হলো সংরক্ষণের আওতায় থাকা তফশিলী জাতি এবং উপজাতির এমন অনেক পরিবারই তো আছে যাদের মাসিক আয় ৬৫,০০০-এর বেশী– তবে তাঁরা কেন সংরক্ষণের আওতায় আসবেন? এহেন প্রশ্নের জবাবে অবতারণা করতে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের একটি তথ্য, যেখানে বলা হচ্ছে যে ভারতের ৮০% মানুষের দৈনিক খরচ করার ক্ষমতা গড়ে ৫০ টাকারও কম। অর্থাৎ, তাদের পরিবারপিছু দৈনিক আয়ের পরিমাণ ২২৫ টাকা এবং মাসিক আয়ের পরিমাণ ৬,৭৫০ টাকা (ভারতে গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ধরা হয় ৪.৫ জন)। আর যেখানে পরিবারপিছু মাসিক ন্যূনতম আয় হওয়া উচিৎ ১৮,০০০ টাকা, তার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫%-এরও বেশী ভারতবাসী। সহজ অঙ্ক কষেই এসব বের করা যায়। ফলে যদি সত্যিই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়, তাহলে তো ৯৫% মানুষ, যাদের আয় মাসে ১৮,০০০ টাকার কম তাঁদের জন্য ৯৫% আসন সংরক্ষণ করতে হয়! অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করতেই হয় তাহলে এটাই তো হওয়া উচিৎ। ফলে অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূরীকরণের নামে এই ১০% সংরক্ষণ যে একটা ডাহা ভাঁওতা তা এর থেকেই বোঝা যায়।

তফশিলী জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর জাতি, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য সংরক্ষণকে ধরে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের পরিমাণ এখন ৪৯.৫% (পশ্চিমবঙ্গে তা ৪৮%), এবার নতুন করে এই সংরক্ষণকে চালু করতে হলে আগে প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন। কারণ ১৯৯২-এর সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ি ৫০%-এর বেশী সংরক্ষণ করা যাবে না (নয়া সংরক্ষণনীতি অনুযায়ী সরকারী চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের পরিমাণ কেন্দ্রে ৫৯.৫% ও রাজ্যে ৫৩.২%) এবং সাংবিধানিক দিক থেকে অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা সংরক্ষণের একমাত্র নির্ণায়ক একক হতে পারে না। আর সংবিধান সংশোধন করতে গেলে লোকসভার দুই-তৃতীয়াংশ এবং রাজ্যসভার দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদদের দিয়ে আইন পাশ করাতে হবে। ফলে পুরোটাই একটা ‘জুমলা’ বলে গলা ফাটিয়েছিল বিরোধীরা। সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল গুজরাটের উচ্চবর্ণের পাতিদার-নেতা হার্দিক পটেল বিজেপি সরকারের এই সংরক্ষণের নীতিকে ভোটের ‘গিমিক’ বলেছিলেন। কিন্তু ভোট রাজনীতির হাতিয়ার ব্যাতিরেকে এই সংরক্ষণ আর কিছুই নয়।

আসলে অর্থনীতির প্রশ্নকে ভাসিয়ে যে বিষটি হাওয়া করে দেবার চক্রান্ত হচ্ছে তা হল, ‘উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ’। যে উচ্চবর্ণের মানুষ শতসহস্র বছর ধরে নিম্নবর্ণের মানুষকে পিষে মেরেছে, ছায়া মাড়াতে দেয়নি, দিনের বেলা রাস্তায় বের হতে দেয়নি, তাদেরকে উচ্চবর্ণের পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার করার কাজে লাগানো হয়েছে, অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছে, আজ সেই উচ্চবর্ণকে সংরক্ষণ দেবার অর্থই হলো নিম্নবর্ণের মানুষের উপর উচ্চবর্ণের এই নিষ্পেষণকেই খারিজ করে দেওয়া। প্রতিটা ‘ভোটবাজ’ রাজনৈতিক দলই যে আসলে উচ্চবর্ণের ‘ভ্যানগার্ড’-এ পরিণত হয়েছে, তা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান দেখলেই ক্রমে স্পষ্ট হয়। যার জন্য ঐতিহাসিকভাবে উচ্চবর্ণের দল বিজেপির আনা সংরক্ষণের এই প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে সংসদে ৩২৩-৩ ভোটে পাশ হয় সংরক্ষণ বিলটি! আর উচ্চবর্ণের এই আচরণ থেকেই বোঝা যায়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেগুলি আগেও তাদের ক্রীড়ানক ছিল এবং আজও তাই আছে, তার লেশমাত্র পরিবর্তন হয় নি।

উচ্চবর্ণের এই কর্তৃত্ব যে সমাজে স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরোলেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি তার সবথেকে বড় প্রমাণ হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রোহিত ভেমুলা থেকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরস্বতী কেরকাট্টা। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্রেফ দলিত বা আদিবাসী পরিচয়ের কারণে প্রতি মুহুর্তে তাদের কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হতে হয়। এতবছর নিম্নবর্ণের জন্য সংরক্ষণ থাকা সত্ত্বেও একজন তফশিলী জাতি বা উপজাতির মানুষ, যার যথেষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে, তাকেও তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে অপারগ আমাদের ভারতীয় সমাজ। প্রতিমুহুর্তে নিম্নবর্ণের সংরক্ষণের কোটায় সুযোগ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের হরেদরে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তারা আসলে ‘কোটার-মাল’; সুযোগ নয় দাক্ষিণ্যই তাদের প্রাপ্য। কিন্তু হেনস্থাকারীদের এটা মাথায় থাকে না যে এই সংরক্ষণ কেবল প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোয়ালিফায়িং পয়েন্টটা কমিয়ে দেয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ক্ষেত্রে তার পরেও কোয়ালিফাই বা পাশ তো করতেই হবে। ফলে, উচ্চবর্ণের এহেন আচরণ যে কেবল শিক্ষাঙ্গণে সীমাবদ্ধ তাই নয়, সমাজের সর্বত্র উচ্চবর্ণীয় কর্তৃত্বের সংস্কৃতির সাথে আপোস করতে করতে নিম্নবর্ণের মানুষেরাও যেন ধাতস্থ হয়ে গেছেন।

আমাদের দেশের বর্ণ-ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পশ্চাদপদ নিম্নবর্ণের জন্য সংরক্ষণই-ই কি যথেষ্ট? না। কৃষিনির্ভর গ্রামীন ভারতে আজও দেশের সিংঘ-ভাগ জমির মালিকানা আছে উচ্চবর্ণের বৃহৎ চাষী বা জমিদার, জোতদারদের হাতে। আর অন্যদিকে ভাগচাষী, বর্গাদার বা ছোটচাষীদের বেশীরভাগ মানুষ দলিত বা নিম্নবর্গের মানুষ। সংরক্ষণের সাথে সাথে দেশে ভূমি সংস্কারের কথা থাকলেও তা আজও আকাশকুসুম স্বপ্ন। কারণ একই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিদের প্রাধান্য। আর পঞ্চম তফশিলভুক্ত আদিবাসী এলাকাগুলির অবস্থা তো আরো শোচনীয়। প্রতি মুহুর্তে কর্পোরেট হাঙর আর খনি মাফিয়াদের চক্রান্তে জল-জঙ্গল-জমিন থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে তাদের। প্রায় ১১ লক্ষ পঞ্চম তফশিলভুক্ত এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী আজ উচ্ছেদের শিকার। পুনর্বাসনের নামে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বাসভূমি। সবথেকে বড় কথা, নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য এই সংরক্ষণ কেবল সরকারী ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। নয়াউদারবাদের জমানায় যেখানে গোটা দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে পরিষেবাক্ষেত্র, সর্বত্রই কর্পোরেট পুঁজি কর্মসংস্থানকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে, সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা কোথায়? ঢালাও বেসরকারীকরণের ফলে নিম্নবর্ণের মানুষদের সুযোগ এমনিতেই সীমাবদ্ধ। ‘কোটা নেই, কোটা নেই’ বলে দিনের পর দিন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি কলেবড়ে বেড়ে চলেছে, যেখানে পড়ার বা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়াই যেন নিম্নবর্ণের পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে ধৃষ্টতা।

তাহলে তফশিলভুক্ত জাতি ও উপজাতিদের মধ্যে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকাদের সংরক্ষণ দেওয়া কি সমাধান? এক্ষেত্রেও উত্তর হল ‘না’। মাথায় রাখা দরকার যে এই সংরক্ষণ করা হয়েছে বর্ণ বৈষম্য জনিত সামাজিক নিপীড়নে জর্জরিত নিম্নবর্ণের মানুষকে সুযোগ করে দিতে। তাছাড়া,  আর্থিক অবস্থান নিরপেক্ষভাবেই নিম্নবর্গের জনগণ শিক্ষা বা চাকরী ক্ষেত্রে বঞ্চিত। তারা উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি ও পরিবারতন্ত্রের দাপটে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রেও পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে তারা পিছিয়ে। এমনকি, পাঠ্যক্রমের বিষয়ও উচ্চবর্ণের দ্বারা নির্ধারিত; সেখানেও নিম্নবর্গ কোণঠাসা। অন্যদিকে, যেখানে দেশের প্রায় ৯০% বেশী মানুষের মাসিক আয় ১ লক্ষ টাকাও নয়, সেখানে ৮ লক্ষ টাকা উপার্জনকারী মানুষকে ‘পিছিয়ে পড়া’ বলাটা চিটিংবাজি ছাড়া কিচ্ছু নয়। উচ্চবর্ণের মানুষের সংরক্ষণের মাধ্যমে যেটা করা হচ্ছে তা এককথায় ভিখারির ঝোলায় ডাকাতিরই নামান্তর।

আম্বেদকর নিম্নবর্ণের উত্তরণের প্রশ্নকে দেখেছিলেন তার বাহ্যিক উপসর্গের নিরিখে অর্থাৎ একসাথে খাওয়া, বিবাহ ইত্যাদির ভিত্তিতে। পুঁজিবাদ বর্ণ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে টিকে থাকতে পারে। অল্প সংখ্যক ব্রাহ্মণের বেতন বৃদ্ধি করে, বৃহদাংশের শুদ্রদের মজুরি কমিয়ে রেখে মুনাফার পাহাড় তৈরি করে চলে পুঁজিপতিরা। ফলে, শ্রমিকদের ট্রাস্টিদের এই ব্যবস্থা মজবুত করতে গান্ধী ‘কাস্ট’-কে বাঁচিয়ে রেখেই বর্ণ বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। সেদিক থেকে দেখলে, আম্বেদকর তাঁর অবস্থানের দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন। আজ ‘কাস্ট’ একটা পরম্পরা হিসেবে দেখা দিলেও তার সূচনা হয়েছিল পারম্পরিক শ্রম বিভাজন হিসেবে। কাজ করার যোগ্যতা নির্ধারণ বা কর্মক্ষেত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে পারিবারিক পেশাকেই বেছে নিতে বাধ্য করার এই সামাজিক চাপের ভিত্তি হল একটি ধারণা যে মানুষের যোগ্যতা বা উত্তরণ পশুদের মত তার পূর্বপুরুষের দ্বারাই নির্ধারিত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে মানুষের তার পূর্বপুরুষের সঙ্গে সময়, পরিবেশ ও অন্যান্য উপাদানগত ব্যবধানের কারণে যোগ্যতা, মানসিক অবস্থান বা চিন্তাধারার দিক থেকে দ্বন্দ্বও থাকে। এক্ষেত্রে, ফ্রয়েডের ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’-এর তত্ত্ব একটি উদাহরণ। সময়ের সাথে সাথেই পারম্পরিক শ্রম বিভাজন পরিণত হয় পারম্পরিক সম্পত্তি সম্পর্কে। আজকের দিনেও ‘ইন্টার-কাস্ট’ বিবাহ একটি সামাজিক ট্যাবু কারণ বিবাহের সঙ্গে সম্পত্তি সম্পর্ক জড়িত। এই জটিলতার মাঝে, মার্ক্সবাদীরা ‘কাস্ট’-এর মধ্যে শ্রেণীকে খুঁজেছেন সম্পত্তি প্রশ্নের নিরিখে।

সংরক্ষণ এবং ভূমি সংস্কারকে নিম্নবর্ণের উত্তরণের সহায়ক হিসেবে ধরা নেওয়া হয় কিন্তু তা পূর্ণরূপে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য যথেষ্ট নয়। পাট্টায় পাওয়া জমি পিতা থেকে পুত্রের হাত হয়ে পারিবারিক হস্তান্তরের এই নেটওয়ার্ক তৈরি করে নতুন বর্ণ ব্যবস্থা। কর্মক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। ফলে, আজকের দিনের উদ্ভূত বর্ণগুলির মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, উকিল প্রভৃতি। তাছাড়া, সম্পত্তি সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই উদ্ভূত সাংস্কৃতিক আধিপত্য ফুটে ওঠে সমগ্র সমাজে। উদাহরণ স্বরূপ, সংরক্ষণের সুযোগ পাওয়া নিম্নবর্ণের পরিবারও উচ্চবর্ণের সাংস্কৃতিক আধিপত্য গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গ্রেডেড ইনিকুয়ালিটি’। ফলে, সমকাজে উচ্চবর্ণের সমতুল্য বেতন, বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ, জমির দাবীর সাথে সাথে দরকার নিম্নবর্ণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উত্তরণ। কমিউনিস্ট বিপ্লবী বি.টি. রণদিভে নিম্নবর্ণকে কৃষক সভা বা ট্রেড ইউনিয়নের মত শ্রেণী সংগঠনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিম্নবর্ণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উত্তরণের লক্ষ্যে বৃহৎ আন্দোলন সংগঠিত করা যায়নি। বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘কাস্ট’-এর প্রশ্নে আলাদা গণসংগঠন বানানো যেতেই পারে কিন্তু তার সকল সদস্যদের অন্যান্য শ্রেণী সংগঠনগুলিতে যোগ দিয়ে সমদাবীর অবস্থানে আসাও প্রয়োজন। বৈষম্যের অবসান আমূল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। অধিকার অর্জনের এই লড়াই শোষিত ও নিপীড়িতদের সংযুক্ত মোর্চা গঠন ছাড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এই মোর্চার নেতৃত্বে থাকুক মেহনতী জনগণ, বিশেষত এগিয়ে থাকা মজদুর শ্রেণী। 

 

 

 

 

কিংশুক চক্রবর্তী পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের সদস্য। 

 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *