পুঁজিবাদী অর্থনীতি সম্পর্কে কার্ল মার্কস-এর বিশ্লেষণ যে কতখানি অভ্রান্ত ছিল সে বিষয়ে কথাবার্তার একটি চল গত শতক থেকেই রয়ে গেছে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও পুঁজিবাদের যে বিজয়গাথা রচনার চেষ্টা হয়েছিল, তাও কিন্তু পুঁজি সম্পর্কিত মার্কসের বহুল-প্রচারিত ব্যাখ্যাটিকে খণ্ডন করে নয়, বরং কিছুটা পাশ কাটিয়ে। কিন্তু ২০০৮-এর সংকটের পরেই মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’ বইটির বাজার চাহিদা আবার যে হারে বাড়তে লাগলো, তাতে আমাদের প্রতিষ্ঠিত ‘কমিউনিস্ট’-রা রিহ্যাব সেন্টার থেকে আবার বেরোবার একটা আশা দেখলেন; কিন্তু ভাবখানা আদতে এরকম : “দেখো দেখো, বিধর্মীরাও আমাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ছে, আমাদের ধর্ম এখনও জিন্দা আছে”। কিন্তু বাবুমশাইরা, এভাবে তো জিহাদ আসবে না, নাম জপেই ত্রিকাল কেটে যাবে ! কারণ আসলে আপনারা সবাই মনে-প্রাণে ভালোভাবেই জানেন এবং মানেন যে আজকের শোষণ ব্যবস্থার যে রূপ আপনারা প্রত্যক্ষ করছেন, আর ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’-র যে পাঠ আপনারা পড়েছেন, পড়াচ্ছেন, তা সম্পূর্ণ সমান্তরাল, কেউ কাউকে না ছুঁয়ে বয়ে চলেছে। আপনাদের কথাতেও তাই উঠে আসে “ওটা তত্ত্বগতভাবে ঠিক, আর এটা বাস্তব”! আর যে প্রশ্নে ঐ ‘তত্ত্ব’ আর এই ‘বাস্তব’ আপনারা না চাইলেও হুবহু মিলে যায়, শুধু সেটুকুই বাধ্য হয়ে বলেন : এক, পুঁজিবাদ মানেই দারিদ্র্য-বেকারত্ব, আর দুই, পুঁজিবাদ তার নিজের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেই যা ডেকে আনবে সংকট। আর গোদাভাবে মার্কসের এই দুইটি চরণ আলতো করে ছুঁয়েই আপনারা ‘কমিউনিস্ট’ নামের দায় সারেন। 

অন্যদিকে বুর্জোয়া অর্থতত্ত্ববিদরা তো গত দেড়শ বছর ধরেই মার্কসকে খণ্ডন করতে মরিয়া; লাগাতার যুক্তির ঘাড়ে যুক্তি চাপিয়ে তাঁরা নতুন নতুন হাতুড়ে তত্ত্ব হাজির করেছেন আর বাস্তব ততবার তাঁদের গালে সপাটে চপেটাঘাত করে তাঁদের দৈন্য প্রমাণ করেছে।

কিন্তু আদতে যে প্রশ্নগুলি আজ কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ভিতর থেকে বিঁধছে, সেগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে কিন্তু সংগ্রামকে এক’পা-ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাকে পেরিয়েই যেতে হবে আমাদের। তার মধ্যে প্রধান প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এবং আপাত-স্ববিরোধী প্রশ্নগুলি হল :

এক, যাঁদেরকে সাধারণভাবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণী বলা হয়, সেই সংগঠিত শ্রমিকদের বড় অংশই আজ যথেষ্ট বেশি পরিমাণের মজুরী পান (যেমন ভারতে মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা থেকে এক-দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত)। এঁরা কি সর্বহারা শ্রেণী ? এঁরা কি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করছেন ? মেশিনের প্রোডাক্টিভিটিই কি তাঁদের শ্রমের মূল্য এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে ? এঁদের মতোই উচ্চ-আয়সম্পন্ন অধ্যাপক-চিকিৎসক-উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের শ্রেণীগুলোকেই বা কীভাবে দেখব ?

দুই, আমাদের দেশে তো বটেই এমন কি গোটা দুনিয়া জুড়েই আজ যে বিপুল সংখ্যক স্বনিযুক্ত শ্রমিক ও অন্যান্য ক্ষুদ্র উৎপাদকদের একটা শ্রেণী তৈরি হয়েছে, তাদের সাথে পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের কোনও সম্পর্ক আছে কি ? কারণ এঁরা কোনও ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন না, সুতরাং কোনও উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টিও করছেন না !

তিন, আমাদের মতো দেশে যেখানে ছোট মালিকানার কৃষিজমিরই সংখ্যাধিক্য, ‘লার্জস্কেল ফার্মিং’ যেখানে খুবই কম হয়, ফলে প্রোডাক্টিভিটি এত কম, সেখানে পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ আদৌ আছে কি? থাকলে তার বৈশিষ্ট্যই বা কী ?

চার, কর্পোরেট মালিকদের জমি-হাঙর বনে যাওয়ার কারন কী ? জমির কেনা-বেচায় যে বিপুল টাকা ওড়ে তার সাথে কোনও উদ্বৃত্ত মূল্যের বা শোষণের সম্পর্ক আছে কি ?

এই প্রবন্ধকে আমরা সীমাবদ্ধ রাখব এই প্রধান প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার মধ্যে, এবং তা করব মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই। উল্লেখ্য যে, এই প্রশ্নগুলি ছাড়াও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আজকের ফাটকা কারবারের যুগে যেখানে কোনও উৎপাদন ছাড়াই টাকা খাটিয়ে টাকা তোলা যাচ্ছে, বিপুল মুনাফা কামানো যাচ্ছে, সেখানে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’-টি আর খাটে কি ? কোনও উৎপাদনের মজুরী-শ্রম ছাড়াই তো এই মুনাফা আসছে ! তাহলে একে আর শোষণ-ব্যবস্থাও বলা যায় কি ? এই বিষয়ে আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব না, তার জন্য প্রয়োজন একটা পৃথক পরিসর। আজকের শোষিত শ্রেণীগুলিকে চিহ্নিত করা এবং তাদের ওপর আজকের শোষণের স্বরূপটিকে উন্মোচিত করাই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

এখন প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে যেটা আমাদের উল্লেখ করতে হবে, তা হল মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদকে সাধারণত ‘মূল্যের তত্ত্ব’, বা আর একটু ভেঙ্গে বললে, ‘উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির তত্ত্ব’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু মার্কসের তত্ত্ব ‘মূল্য’ অথবা ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি’-র মধ্যেই থেমে থাকেনি, পুঁজিবাদের বিকাশের ধারায় কিভাবে ‘মূল্য’ ‘দাম’-এ রূপান্তরিত হয়েছে এবং ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের বণ্টন’ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এবং ইতিহাসগতভাবেও। এই সুবিপুল কাজ সম্পর্কে কোনও বিশদ আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু আজকের প্রধান প্রধান প্রশ্নগুলির সমাধান মিলবে কেবল এই অংশের মৌলিক দিকটির মধ্যেই। সেজন্যই সময়ের সাথে সাথে পুঁজিবাদী শোষণ-ব্যবস্থার এই বিকাশের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাদের দিতে হবে, বিকাশের যে ধারার ভিত্তিতেই কেবল আজকের শোষণের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত ‘মূল্য’-এর ‘দাম’-এ রূপান্তরের মার্কসীয় তত্ত্বটিকে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা নানা যুক্তিতে খণ্ডন করেছেন গত একশো বছর ধরে, এবং তথাকথিত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদরাও গোদাভাবে তাঁদের হ্যাঁ-এ-হ্যাঁ মিলিয়ে চলেছেন। এঁদের জোড়াতালি দেওয়া প্যাঁচ-পয়জারগুলিকেও নাঙ্গা করব আমরা। এবং মার্কসের এই অনবদ্য তত্ত্বের আরও বিকাশই যে আজকের নতুন পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটাই এই প্রবন্ধে দেখানো হবে, যা আমাদের বর্তমান প্রস্তাবনাটির মূল কথা।

।।এক।।

‘ক্যাপিটাল’ বইটিতে মার্কস ইতিহাস ঘেঁটে দেখান যে সমাজে পুঁজিবাদ আসবার আগেই পণ্য-ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, কার্যত মধ্যযুগেই। এসময় মানুষ তার নিজের তৈরি করা পণ্যটিকে (C) বিনিময় করতো অন্য আরেকজনের তৈরি করা অন্য কোনও পণ্যের (C’) সাথে; অর্থাৎ পণ্যমাত্রেরই যেমন আছে একটা ‘ব্যবহার-মূল্য’, তেমনি তার সাথে আছে একটা ‘বিনিময়-মূল্য’। এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেসময় এই পণ্য বিনিময়ের একমাত্র মাপকাঠি ছিল পণ্যটি তৈরি করতে গড়ে এই মানুষদের যতোটা ‘শ্রম’ বা ‘শ্রম-সময়’ লেগেছে সেইটেই। ফলে এই ‘শ্রম’ বা ‘শ্রম-সময়’-ই পণ্যের ‘বিনিময়-মূল্য’ বা চলতি কথায় ‘মূল্য’ এবং এই বিনিময় চলত সমানে সমানে (একই পরিমাণ ‘শ্রম’ বা ‘শ্রম-সময়’-এর ভিত্তিতে)। এই যুগটাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে CC’ হিসাবে; এইটেই তখন সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় চরিত্র। এসময়ও মুদ্রার প্রচলন ছিল, কিন্তু তা কেবল যারা দেশে-বিদেশে বাণিজ্য করতো সেইসব ট্রেডারদের মধ্যে। এর পর ক্রমে মুদ্রা ঢুকে পড়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে; একজন পণ্য (C) তৈরি ক’রে তা অন্যকে বিক্রি করে এই মুদ্রার (M) বিনিময়ে, এবং সেই মুদ্রা দিয়ে আবার অন্য কারোর থেকে অন্য পণ্য (C’) কেনে। অর্থাৎ এযুগের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় CMC’। এসময়েও এই বিনিময় চলত সমানে-সমানে একই পরিমাণ ‘শ্রম’ বা ‘শ্রম-সময়’-এর ভিত্তিতে। কিন্তু এযুগে মুদ্রা, বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে ওঠায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা সকল প্রকার পণ্যের কোনও না কোনও পরিমাণের মূল্যকে প্রকাশ করে; ফলে তা হয়ে ওঠে গুণগতভাবে সীমাহীন, কিন্তু পরিমাণগত ভাবে সীমিত; এবং তার এই বৈশিষ্ট্যই মানুষের মধ্যে মুদ্রা মজুত করবার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এর মধ্যে দিয়েই আসে পরবর্তী পুঁজিবাদের যুগ, যেখানে শুরু হয় মুদ্রার (M) বিনিময়ে পণ্য কিনে তা থেকে নতুন পণ্য (C) উৎপাদন ক’রে তা বিক্রি ক’রে বেশি মুদ্রা (M+M) আয় করার ব্যবস্থা; অর্থাৎ MCM+M। কিন্তু পণ্য কেনাও হয়েছে তার ‘শ্রমমূল্য’-এ, বিক্রিও হচ্ছে ‘শ্রমমূল্য’-এ, অর্থাৎ সমানে সমানে, তাহলে এই যে বৃদ্ধি (△M), তথা মুনাফা, তা আসছে কোথা থেকে?

একজন পুঁজিপতি মালিক মোট যে পুঁজি (M) বিনিয়োগ করে, তার দুটি অংশ : এক, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণের জন্য কনস্ট্যান্ট ক্যাপিটাল (MC), এবং দুই, শ্রমিকদের মজুরী বাবদ ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল (MV); অর্থাৎ M=MC+MV। কিন্তু তা দিয়ে উৎপাদিত পণ্যটির ‘বিনিময়মূল্য’ হল M+M, অর্থাৎ বিনিয়োগের থেকে △M পরিমাণ বেশি। কিন্তু কেনা সমানে-সমানে (শ্রমমূল্যে), বেচা সমানে-সমানে (শ্রমমূল্যে), তবে এই ‘বেশি’-টা পাওয়ার জন্য শ্রমিকদের থেকে মজুরীর বিনিময়ে পুঁজিপতি কিনলটা কী ? তা নিশ্চয়ই এমন এক পণ্য, যা নিজে যতটা শ্রমের খরচে তৈরি হয়, নিজের শ্রম খরচ করতে পারে তার চেয়ে বেশি ! এটিই মার্কসের যুগান্তকারী আবিষ্কার। শ্রমিকদের থেকে পুঁজিপতি যে পণ্যটি কেনে তা তাদের ‘শ্রমশক্তি’ (‘শ্রম’ নয়), তাদের খাটবার ক্ষমতা (খাটুনি নয়), যা দিয়ে ইচ্ছেমত কম-বেশি খাটানো যেতে পারে। এই ‘খাটবার ক্ষমতার’ বিনিময়ে শ্রমিক যে মজুরী পায় তা দিয়ে সেইটুকু জিনিসপত্র কেনা যায় যাতে করে পরের দিন আবার ঐ ‘খাটবার ক্ষমতা’ নিয়েই সে ফিরে আসে কারখানায়। মজুরী হল ‘শ্রমশক্তি’-র ‘বিনিময়-মূল্য’ যা দিয়ে শ্রমিকের নিজের খরচ চলে। আর এই ‘শ্রমশক্তি’-র ‘ব্যবহার-মূল্য’ হল কারখানায় উৎপাদনে শ্রমিকের দেওয়া ‘শ্রম’, যা আবার এই কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ‘বিনিময়-মূল্য’-এ যুক্ত হয়। অর্থাৎ মানুষের ‘শ্রমশক্তি’ হল এমন এক জিনিস যা নিজে যতো ‘মূল্য’-এর পণ্য ব্যবহারে সৃষ্টি হয়, তার চেয়ে বেশি ‘মূল্য’-এর পণ্য সৃষ্টি করতে পারে, এবং এই বাড়তিটাই হল পুঁজিপতির মুনাফা। এহল শ্রমিকের সৃষ্টি করা ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ (MS) যা ভোগ করে পুঁজিপতি। উদাহরণস্বরূপ, একটা রেস্টুরেন্টের যে রাঁধুনি ও তাঁর পরিবার নিজেরা রাতে সামান্য ভাত-ডালটুকু খান, তিনিই সারাদিন অনেক বেশি ‘মূল্য’-এর বিরিয়ানি তৈরি করতে পারেন ও করেন, এবং মূল্যের এই ফারাকই রেস্টুরেন্ট মালিকের মুনাফা।

আর তাই, এহেন প্রতিটি ব্যক্তি-পুঁজিপতির একমাত্র চিন্তার বিষয় কতো বিনিয়োগে (MC+MV) কতো মুনাফা (MS), তাই সে শ্রমিককে যতো মজুরী দেয় তার তুলনায় যতোটা বেশি সম্ভব খাটিয়ে নিতে চায়; MV (মজুরী)-র তুলনায় MS (উদ্বৃত্ত মূল্য)-কে, অর্থাৎ ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের হার’-কে, যতোটা সম্ভব বাড়িয়ে তুলতে চায়। তার জন্যই যৎসামান্য মজুরীর বিনিময়ে তারা শ্রমিককে দিয়ে ১০-১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করায়। এরই বিরুদ্ধে গোটা দুনিয়ার শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে জানকবুল লড়াই দিয়েছিলেন যা ‘মে-দিবস’-এর সংগ্রাম হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছে। কিন্তু এর ফলে কাজের ঘণ্টার সীমা বেধে যাওয়ায় পুঁজিপতিরা বাধ্য হল যন্ত্রপাতির আরও উন্নতি ঘটাতে, যাতে একই সময় কাজ করিয়ে বেশি পণ্য তৈরি করা যায়, যাতে একই মজুরীর বিনিময়ে অনেক বেশি মুনাফা তোলা যায়। এই উন্নত যন্ত্রপাতির মাধ্যমেই তারা MV–র তুলনায় MS–কে ‘আপেক্ষিক’ ভাবে বাড়ানোর বন্দোবস্ত করে। এর ফলে আবার MV (ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল)-র তুলনায় MC (কন্সট্যান্ট ক্যাপিটাল)-কে বাড়ানোর, অর্থাৎ শ্রমিকের উপর বিনিয়োগের থেকে যন্ত্রপাতির উপর বেশি বিনিয়োগের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। বলা যেতে পারে গোটা পুঁজিবাদের ইতিহাসটাই এই শ্রমিকের তুলনায় যন্ত্রপাতির ওপর বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে ঝোঁকের ইতিহাস।

এখন ধরা যাক দুটি ইন্ডাস্ট্রির প্রথমটিতে শ্রমিকের উপর বিনিয়োগের তুলনায় যন্ত্রপাতির ওপর বিনিয়োগ (MC/MV) দ্বিতীয়টির থেকে বেশি। এর থেকে শুরু হয় একটা টানাপড়েন : একদিকে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের হার’ (MS/MV) যদি একটির থেকে অন্যটিতে বেশি হয়, তাহলে নিজেদের ওপর শোষণ কমাতে শ্রমিকরা সেই দিকে চলে যেতে চাইবে যেখানে এই হার কম, বা আন্দোলনের মাধ্যমে তা কমিয়ে আনতে চাইবে; অন্যদিকে বিনিয়োগ প্রতি মুনাফা, তথা ‘মুনাফার হার’ (MS/(MC+MV), যদি একটির থেকে অন্যটিতে বেশি হয় তাহলে পুঁজি সেইদিকে চলে যেতে চাইবে। এই টানাপড়েন থেকেই এই দুটি অনুপাতই, ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের হার’ এবং ‘মুনাফার হার’, একটা গড় সামাজিক মানের প্রায় সমান হওয়ার দিকে যায়। আর এরই ফলে পণ্য বিনিময়ের মাপকাঠি ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরিত হয়। চলতি কথায় ‘মূল্য’ ও ‘দাম’ একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও মার্কস-এর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে এদের পার্থক্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি সরল উদাহরণের সাহায্যে আমরা বিষয়টি তুলে ধরছি। ধরা যাক, দুটি ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকটির মোট বিনিয়োগ ১০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রথমটিতে যন্ত্রাদিতে বিনিয়োগ ৮০ কোটি ও শ্রমিকের মজুরী বাবদ বিনিয়োগ ২০ কোটি; আর দ্বিতীয়টিতে যন্ত্রাদিতে বিনিয়োগ ৬০ কোটি ও শ্রমিকের মজুরী বাবদ বিনিয়োগ ৪০ কোটি টাকা। যদি ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের হার’ হয় মোটামুটি গড়ে ১০০%, তাহলে প্রথম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ ২০ কোটি এবং দ্বিতীয় ইন্ডাস্ট্রিতে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রথমটির পণ্যের মোট ‘মূল্য’ ১২০ কোটি এবং দ্বিতীয়টির ১৪০ কোটি টাকা, যেখানে উভয়েরই মোট বিনিয়োগ ১০০ কোটি।

অতএব ‘মূল্য’ হিসাবে ‘মুনাফার হার’ প্রথমটির ক্ষেত্রে হবে ২০% এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ৪০%। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রথমটি থেকে বিনিয়োগ চলে যেতে চাইবে দ্বিতীয় ইন্ডাস্ট্রিতে। এজন্যই ‘গড় মুনাফা হার’ (এক্ষেত্রে ৩০%) অনুযায়ী যার যার পণ্যের ‘দাম’ নির্ধারিত হবে, এবং সেইটেই হবে বিনিময়ের মাপকাঠি, আগের মতো আর ‘মূল্য’ নয়। যেমন এক্ষেত্রে উভয়েরই পণ্যের মোট ‘দাম’ হবে ১৩০ কোটি টাকা করে, যদিও প্রথমটির ‘মূল্য’ ১২০ কোটি এবং দ্বিতীয়টির ১৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথমটির ‘দাম’ তার ‘মূল্য’-এর থেকে বেশি, অন্যদিকে দ্বিতীয়টির ‘দাম’ তার ‘মূল্য’ থেকে কম, যাতে ‘মুনাফার হার’ হয় একই (৩০%)। আবার দুটি ক্ষেত্রের সমস্ত পণ্যের মোট ‘দাম’ তাদের মোট ‘মূল্য’-এর সমান (এক্ষেত্রে ১৩০+১৩০=১২০+১৪০=২৬০ কোটি টাকা)। সুতরাং দ্বিতীয় শিল্পক্ষেত্র (যাকে শ্রমনিবিড় বলা যেতে পারে)-এর শ্রমিকদের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’-এর ভাগ পাচ্ছে প্রথম শিল্পক্ষেত্র (যাকে তথাকথিত ভাবে পুঁজিনিবিড় বলা যায়) নিজেদের মধ্যে কোনও প্রত্যক্ষ উৎপাদন বা বাণিজ্য-ভিত্তিক সম্পর্ক ছাড়াই।    

অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে বলা যায়, বিভিন্ন আলাদা আলাদা উৎপাদন-ক্ষেত্রে ‘গড় মুনাফা হার’-এর ভিত্তিতে নির্ধারিত পণ্যের ‘দাম’ তাদের নিজেদের ‘মূল্য’-এর থেকে আলাদা, কোথাও বেশি কোথাও কম, কিন্তু উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রের সমস্ত পণ্যের মোট ‘দাম’ তাদের মোট ‘মূল্য’-এর সাথে অভিন্ন। এখন আর, একটি কারখানা বা একটি উৎপাদন-ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ কেবল তাদের পুঁজিপতি মালিকই করায়ত্ত করছে না, গোটা সমাজের সকল শ্রমিকের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ সমস্ত পুঁজিপতিরা মিলে করায়ত্ত করছে, এবং যার যার বিনিয়োগের অনুপাতে মুনাফা ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন একটি কারখানা বা একটি উৎপাদন-ক্ষেত্রের পুঁজিপতি মালিক কেবল তার শ্রমিকদেরকেই শোষণ করছে না, গোটা পুঁজিপতি শ্রেণী গোটা শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করছে। আরও বলা যায় যে শ্রমনিবিড় শিল্প থেকে পুঁজিনিবিড় শিল্পে, ছোট বিনিয়োগ-ক্ষেত্র থেকে বড় বিনিয়োগ-ক্ষেত্রে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ তথা ‘সারপ্লাস’ ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগের ভিত্তিতে।

।।দুই।।

পুঁজিবাদের বিকাশের বাস্তবতা সম্পর্কে মার্কসের এই অনবদ্য তত্ত্বটিকেই খারিজ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল বুর্জোয়া অর্থনীতির সেবাদাসেরা। ‘ক্যাপিটাল’-এর তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। এঙ্গেলস তাদের উত্তরে বইটিতে সংযোজনী দিয়েছিলেন, যাতে তাদেরকে গালে চড় মেরে বোঝানো হয়েছিল বললেও ভুল হয় না। তারা সাময়িক ভাবে মুষড়ে পড়লেও আক্রমণ কিন্তু থেমে যায়নি। এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর বুর্জোয়া অর্থনীতি আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বীজগণিত কষে মার্কসের এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠে। আজ একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই আক্রমণ তারা চালাচ্ছে। দুঃখের বিষয় যে মার্কসবাদীদের তরফ থেকে এর উত্তর তো দেওয়া হয়ই নি, বরং প্রতিষ্ঠিত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদরা বকলমে বুর্জোয়াদের যুক্তিগুলিই স্বীকার করে নিয়েছেন। লেনিনও এ বিষয়ে তাত্ত্বিক সংগ্রাম চালিয়েছিলেন (তুগান-ব্যারনস্কির যুক্তির বিরুদ্ধে) যদিও তা মার্কসবাদীদের তরফ থেকে খুব একটা প্রচার পায়নি। আর বিশেষ করে পল সুইজির হাত ধরে মার্কসবাদীরা বুর্জোয়া যুক্তির সামনে কার্যত আত্মসমর্পণই করলেন। কিন্তু আজকের পরিস্থিতির বিশ্লেষণে এই তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম এবং আমাদের প্রস্তাবনাটিও তার ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই। তাই মার্কসের ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এই প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া যুক্তির প্রসঙ্গে আমাদের মতটি তুলে ধরা একান্ত জরুরী।

আমরা এখানে এল. ভন বড়কিউয়িজ-এর যুক্তিটি তুলে ধরব কারণ গত একশো বছর ধরে সকল বুর্জোয়া ও প্রতিষ্ঠিত ‘মার্কসবাদী’ অর্থনীতিবিদেরাই এই বক্তব্যের সারমর্মকে ধরেই নিজেদের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন মার্কসের ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরের তত্ত্বটিকে খারিজ করতে। বড়কিউয়িজ মার্কসের দেওয়া একটি গাণিতিক উদাহরণকেই সামান্য সংখ্যাগত অদলবদল করে তুগান-ব্যারনস্কির মডেলটিকে ব্যবহার করে মার্কসকে খণ্ডন করেছেন। মার্কসের উদাহরণটি (বড়কিউয়িজ-এর সংখ্যাগত অদলবদলসহ) নিচের টেবিল দুটিতে দেওয়া হল। এখানে পাঁচটি আলাদা উৎপাদন-ক্ষেত্র ধরে নেওয়া হয়েছে যেখানে কনস্ট্যান্ট ক্যাপিটাল MC (যন্ত্রাদির ওপর বিনিয়োগ) ও ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল MV (শ্রমিকের উপর বিনিয়োগ)-এর অনুপাত আলাদা আলাদা [যেমন ৮০:২০, ৭০:৩০, ৬০:৪০, …]; আবার একবারের উৎপাদনে শ্রমিকদের খাটবার ক্ষমতা পিছু যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল ইত্যাদির যতোটা খরচ হয়েছে (fMC), সেটাও আলাদা আলাদা [যেমন ২০:৫০, ৩০:৫০, ৪০:৫২, …]। উদ্বৃত্ত মূল্যের হার গড়ে ১০০% ধরে নেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে টেবিল-১-এ ‘মূল্য’ ও টেবিল-২-এ ‘দাম’-এর হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।

টেবিল-১-এ দেখা যাচ্ছে, যদি পণ্যগুলি তাদের ‘মূল্য’-এ বিনিময় হতো, তবে এই আলাদা আলাদা উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলিতে মুনাফার হার হতো আলাদা আলাদা [যেমন ২০%, ৩০%, ৪০%, …]; কিন্তু টেবিল-২ থেকে দেখা যাচ্ছে যে গড় মুনাফা হার অনুযায়ী বিনিয়োগ পিছু মুনাফা ধরে নিয়ে ‘দাম’ নির্ধারণ করা হলে [যেমনটা আগে দেখানো হল] প্রতিটি আলাদা উৎপাদন-ক্ষেত্রে মুনাফা হার (২২%) হয় অভিন্ন।

প্রথম উৎপাদন-ক্ষেত্রের পণ্যের ‘মূল্য’ (৯০)-এর থেকে তার ‘দাম’ (৯২) বেশি, আবার দ্বিতীয় উৎপাদন-ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টো (যথাক্রমে ১১০ ও ১০২)। সবকটি উৎপাদন-ক্ষেত্রের যোগফলে ‘মূল্য’ ও ‘দাম’-এর পার্থক্যটি ঘুচে যায়। মার্কস দেখান যে এভাবেই সমাজে গড় মুনাফা হার গড়ে ওঠে যাতে করে পুঁজিপতি মালিকেরা মুনাফা তুলে নিয়ে যায় যার যার বিনিয়োগের জোরে, সমাজের মোট পুঁজিতে যার যার বিনিয়োগের পরিমাণের অনুপাতে।

গাণিতিকভাবেও সম্পূর্ণ মিলে যাওয়া এই হিসাবে এক বাস্তব অসঙ্গতি আছে বলে দাবী করেন বড়কিউয়িজ। তুগান-ব্যারনস্কির দেখানো পথেই (আসলে তুগান-ব্যারনস্কি এটা ধার করেছিলেন মার্কসের থেকেই (ক্যাপিটাল, খণ্ড-২), যদিও অনেকটা আনাড়ি ভাবে) বড়কিউয়িজ এই উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলিকে পুঁজিবাদী উৎপাদনের তিনটি মৌলিক শাখায় ভাগ করেন: শাখা-১, যা উৎপাদন করে উৎপাদনেরই উপায়-উপকরণগুলি, তথা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি; শাখা-২, যা উৎপাদন করে শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণপোষণ-এর জন্য জিনিসপত্র; এবং শাখা-৩, যা উৎপাদন করে পুঁজিপতিদের ভোগের সামগ্রী। সরলীকরণের জন্য এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে যে সমাজে মোট এই (উপরোক্ত) পাঁচটি উৎপাদন-ক্ষেত্রই আছে এবং একটি সরল পুনরুৎপাদনের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে (যেখানে উদ্বৃত্ত মূল্যের সবটাই পুঁজিপতি ব্যক্তিগত ভোগের পিছনে ব্যয় করে, উৎপাদন বাড়াবার জন্য লাগায় না)।

এখন বড়কিউয়িজ দেখাচ্ছেন, টেবিল-১-এ লক্ষ করলে দেখা যায় যে, উৎপাদনক্ষেত্র-৩ ও –৪-এর পণ্যের মোট ‘মূল্য’ (১৩২+৭০=২০২) যন্ত্রাদি-কাঁচামালের জন্য সবকটা উৎপাদনক্ষেত্র মিলে মোট যতোটা বিনিয়োগ করেছে (২০২) তার সমান। সুতরাং ধরা যায়, এই দুটি উৎপাদনক্ষেত্র সকল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি-কাঁচামাল বানায়, অর্থাৎ এরাই শাখা-১। একই ভাবে উৎপাদনক্ষেত্র-১ ও –৫-এর পণ্যের মোট ‘মূল্য’ (৯০+২০=১১০) সকল উৎপাদনক্ষেত্রের মোট ‘ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল’ (১১০)-এর সমান; অতএব ধরা যেতে পারে যে তারা শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণপোষণ-এর জন্য জিনিসপত্র বানায়, অর্থাৎ শাখা-২। আর ঠিক একই ভাবে ধরা যায় উৎপাদনক্ষেত্র-২ হল এক্ষেত্রে শাখা-৩, যে উৎপাদন করে পুঁজিপতিদের ভোগের সামগ্রী যার মোট ‘মূল্য’ (১১০) সকল উৎপাদনক্ষেত্রের মোট ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ (১১০)–এর সমান।

এই অবস্থায় বড়কিউয়িজ দেখাচ্ছেন যে, যদি ‘দাম’-এর দিক থেকে বিষয়টিকে দেখা হয় (টেবিল-২), তাহলে সমস্ত উৎপাদনক্ষেত্রের সকল শ্রমিকরা মোট ‘মজুরী’ যেখানে পাচ্ছে ১১০, সেখানে তাদের ও তাদের পরিবারের ভরণপোষণ-এর জন্য জিনিসপত্রের মোট ‘দাম’ ৯২+৩৭=১২৯, অর্থাৎ বেশি; সেক্ষেত্রে একদিকে শ্রমিকরা নিজেদের সম্পূর্ণ ভরণপোষণ করতে পারবে না, অন্যদিকে উৎপাদনক্ষেত্রের শাখা-২ তাদের পণ্যের সবটা বেচে উঠতে পারবে না। একই ঘটনা অন্য দুটি শাখাতেও হবে। সুতরাং এইক্ষেত্রে এই ‘দাম’-এর তত্ত্বগত মডেলটি ফেল করছে। এবং যা একটি বিশেষ ক্ষেত্রে ফেল করছে, তা কখনও একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব নয়।

কি আশ্চর্য যুক্তি ! প্রথমত, যে যুগে পণ্য বিনিময়ের মাপকাঠি ‘মূল্য’ নয়, বরং ‘দাম’, সে সময়ে বড়কিউয়িজ উৎপাদনের শাখাগুলিকে (যেমন উৎপাদনক্ষেত্র-১ ও –৫ পড়ছে শাখা-২-এ) চিহ্নিত করলেন উৎপাদনক্ষেত্রের পণ্যের ‘দাম’ দিয়ে নয়, উল্টে ‘মূল্য’ দিয়ে ! এর চেয়ে সহজবোধ্য কিছু হতে পারে যে, যখন ‘দাম’-এর ভিত্তিতে বিনিময় হচ্ছে, তখন গাণিতিক বিচারেও, উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদনক্ষেত্র-১ ও –৫, যাদের পণ্যের মোট ‘দাম’ ৯২+৩৭=১২৯, যা শ্রমিকদের মোট মজুরী (১১০)-র থেকে বেশি, তা কখনই কেবল শাখা-২-এর পণ্য তৈরি করতে পারে না ! সেক্ষেত্রে এই দুই উৎপাদনক্ষেত্র একত্রে শাখা-২ ছাড়াও নিশ্চয়ই অন্য শাখার পণ্য তৈরি করছে। অন্য উৎপাদনক্ষেত্রগুলির জন্যও এটা সমান ভাবে সত্য। যা যেমন খুশি ধরে নিয়ে একটা অঙ্ক কষলেই তা বিজ্ঞান হয়ে যায় না, যা ধরা হচ্ছে তার বাস্তবতা থাকা চাই। এটি আদতে শিশুপাঠ্যের মতোই সরল, যে, যখন ‘মূল্য’-এর বদলে ‘দাম’-এ বিনিময় চলছে, তখন যেক্ষেত্রে ‘মূল্য’-এ নয়, বরং ‘দাম’-এ মিলবে, কেবল তার ভিত্তিতেই কোন্‌ কোন্‌ উৎপাদনক্ষেত্র কোন্‌ শাখায় পড়তে পারে তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব, উল্টোটা নয়। আর বড়কিউয়িজ-এর এহেন অপযুক্তির পিছনেই কিনা একশো বছর ধরে ছুটলেন বুর্জোয়া পণ্ডিত ও তাঁদের পা-চেটে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ’-রা !  

দ্বিতীয়ত, এ তো গেল গাণিতিক যুক্তির কথা। কিন্তু আদতে বাস্তব সত্য হল এই যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কোনও শাখার বা সবকটিরই এমনকি সব পণ্য সকলে কিনতে পারবে এমনটা কখনই হয়নি, হতে পারে না, হবে না। কারন উৎপাদনের ইনপুট-এর মোট মূল্য বা মোট দাম (M) যা কেনার ক্ষমতা হিসাবে মানুষের কাছে আছে, আউটপুট-এর মোট মূল্য বা মোট দাম (M+M) পুঁজিবাদে সবসময়েই তার থেকে বেশি (△M)। ফলে সব বেচতে না পেরে প্রতি বছর ‘চৈত্র সেল’ তো তাদের দিতেই হয়, উপরন্তু ‘অতি-উৎপাদনের’ এই সংকট ‘মহামারি’-র আকার ধারণ করলে, অন্য কোনও ‘প্যান্ডেমিক’-কে শিখণ্ডী খাড়া করে ‘ইয়ার-এন্ডিং’-এ ‘লক্‌-ডাউন’ চালাতেও বাধ্য হতে পারে সে। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তেই মার্কস দেখিয়েছিলেন : “এই সব সংকটের ফলে এক মহামারির প্রাদুর্ভাব হয়, সেটা আগের সকল যুগে অসম্ভব বলে ভাবা হত – অতি উৎপাদনের মহামারি। হঠাৎ সমাজ যেন এক সাময়িক বর্বরতার পর্যায়ে ফিরে যায়; মনে হয় যেন বা এক দুর্ভিক্ষে, এক সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বন্ধ হয়ে গেল জীবনযাপনের সমস্ত জোগান, শিল্প আর বাণিজ্য যেন ধ্বংস হয়ে গেল; কিন্তু কেন ? কারণ, সভ্যতা হয়েছে বড্ড বেশি, জীবনযাপনের উপকরণ অত্যধিক, অনেক বেশি হয়ে গেছে শিল্প, অনেক বেশি বাণিজ্য।

তৃতীয় বিষয়টি একটু গভীর এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে আগের অংশে দেখলাম, CC’, CMC’, MCM+M, মূল্য দাম, এই ভাবে অর্থনীতির যুগের ক্রম-বিবর্তন হয়েছে, মনে রাখা প্রয়োজন যে গোটা সমাজের সর্বত্রই কিন্তু একসাথে সেই একই বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে পড়েনি। প্রত্যক্ষ পণ্য বিনিময়ের যুগে যখন অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল CC’, তখনও সমাজে এমন প্রান্তিক অংশ ছিল যারা বিনিময় প্রথা চালাতই না (পৃথিবীর দেশে দেশে এখনও এমন উপজাতির মানুষ আছেন যারা বিনিময় করেন না); আবার ট্রেডাররা সেই সময়েই CMC’ তথা মুদ্রা-প্রথা চালাত, যদিও খাপছাড়া ভাবে। একই ভাবে এর পরবর্তী যুগে কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য যখন CMC’, তখনও প্রান্তিক ভাবে CC’-প্রথা চলছে (উল্লেখ্য, এখনও ভারতের গ্রামে কয়েক’ কুনকো ধান বা কয়েক পেটি ফলের বিনিময়ে (দাদনে) জমি লিজ দেওয়া হয়, যার মধ্যে মুদ্রা নেই); আর অন্যদিকে ট্রেডারদের মধ্যে MCM+△M-প্রথা চালু হয়ে গেছে, যদিও সুসংহত ভাবে নয়। পরের পুঁজিবাদের যুগেও কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য যখন MCM+△M তখনও CMC’ এমনকি CC’ প্রথাও প্রান্তিক ভাবে প্রচলিত থেকেছে। অর্থাৎ ইতিহাসের ধারায় প্রতিটি যুগই নিজের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে তার আগের যুগের ক্ষয়িষ্ণু অবশেষ এবং পরের যুগের অপরিণত ইঙ্গিত প্রান্তিক ভাবে বহন করে চলেছে। উপরন্তু পুঁজিবাদের যুগে এক দীর্ঘ সময় জুড়ে কেবল প্রান্তিক ভাবেই নয়, কেন্দ্রীয় MCM+△M ব্যবস্থাটি নিজেই আগের যুগের CMC’ ব্যবস্থাটিকে সাথে নিয়েই চলেছে। ‘ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খণ্ডে মার্কস বিষয়টি অনবদ্য ভাবে ব্যাখ্যা করেন। পুজিপতি মালিকের জন্য ব্যবস্থাটা MCM+△M, অর্থাৎ মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য কিনে নতুন পণ্য বানিয়ে বেশি মুদ্রার বিনিময়ে তা বেচা; কিন্তু তারই শ্রমিকরা যে নিজের ‘শ্রমশক্তি’ (C) বে’চে তার বিনিময়ে মজুরী (M) নিয়ে তা দিয়ে সংসার চালাবার জিনিসপত্র (C’) কিনছেন, তাঁদের জন্য ব্যবস্থাটা তখনও CMC’, অর্থাৎ আগের যুগের বৈশিষ্ট্য। ঠিক এই একই পদ্ধতিতে, মার্কস যখন ‘ক্যাপিটাল’ রচনা করছেন, যখন উৎপাদনের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিবর্তিত হয়ে গেছে মূল্যদাম-এ, তখনও শ্রমিকের বিক্রি করা পণ্যটি, তাঁর ‘শ্রমশক্তি’, আগের যুগের মূল্য-এর মাধ্যমেই বিনিময় হচ্ছে, অর্থাৎ তাঁর সংসার চালাবার খরচের সমান, সেখানে কোনও মুনাফার প্রশ্ন নেই। পুঁজিপতি যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল কিনছে ‘দাম’-এ, কিন্তু ‘শ্রমশক্তি’ কিনছে ‘মূল্য’-এ এবং এর যোগফল তার ‘ব্যয়-দাম’ (মার্কস সচেতন ভাবেই কোথাও ‘ব্যয়-মূল্য’ জাতীয় কোনও শব্দ ব্যবহার করেননি)। সুতরাং, এযুগে কনস্ট্যান্ট ক্যাপিটাল ‘দাম’ ও ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল ‘মূল্য’-কে প্রকাশ করছে এবং সেজন্যই টেবিল-১ ও টেবিল-২, দুটিতেই, এই দুইটির মান একই।

বলা বাহুল্য, এর পরবর্তী বিবর্তনেই আজকের যুগের প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে। 

                          

।। তিন ।।

আজকের দিনের পুঁজিবাদ সম্পর্কে যে প্রধান প্রশ্নগুলি উঠে এসেছে, তার উত্তর পেতে হলে আমাদের মার্কসের ব্যাখ্যা করা পুঁজিবাদের বিকাশের ধারার পরবর্তী বিবর্তনটিকে বুঝতে হবে। আগের অংশটিতেই আমরা দেখিয়েছি যে এই বিকাশধারার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রটি শ্রমিকশ্রেণীর নিজের পণ্যটি, অর্থাৎ তার ‘শ্রমশক্তি’, একই সাথে অর্জন করে না, বরং সে চলে তার পিছু পিছু। আর অন্যান্য প্রান্তিক অংশ চলে তারও পিছনে। ফলে পুঁজিবাদ যখন সেই যুগে প্রবেশ করল যার কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য মূল্যদাম-এ রূপান্তর, ‘শ্রমশক্তি’ তখনও ‘মূল্য’-এই বিনিময় হচ্ছে; মার্কসের ব্যাখ্যায় এই পর্যন্ত ধরা আছে, কারণ তখনও পর্যন্ত সেইটেই বাস্তব। কিন্তু পরবর্তী যুগে একই বিবর্তনের পথ ধরে ক্রমে ‘শ্রমশক্তি’-রও বিনিময়ের মাপকাঠি ‘মূল্য’-এর বদলে হয়ে ওঠে ‘দাম’, যা একইভাবে নির্ধারিত হয় বিনিয়োগের সাথে গড় মুনাফা হার অনুযায়ী একটা বাড়তি ধরে নিয়ে : যত বেশি বিনিয়োগ, ততো বেশি দাম – এই মানদণ্ডে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে যে অসংখ্য প্রকারের তথাকথিত ‘এক্সপার্টাইজ’ (আদতে শ্রমবিভাগ) তৈরি হয়েছে, তার হাত ধরেই এই বিবর্তন। এর থেকেই নতুন করে সংজ্ঞা দেওয়া হয় স্কিল্ড/ আনস্কিল্ড লেবারের। কোনও প্রকার বিশেষ ধরণের শ্রমের যোগ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে মোটেই এই সংজ্ঞা ঠিক করা হয়নি, বরং তা করা হয়েছে কোন্‌ প্রকার শ্রমশক্তি তথা স্কিল তৈরিতে কতটা বিনিয়োগ করা হয়েছে, হতে পারে অর্থের অঙ্কে বা সময়ের হিসাবে, তার ভিত্তিতেই।

আমরা একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব। যেমন, লখনউ-এর এক প্রত্যন্ত দোকানের বিরিয়ানি রাঁধুনির থেকে মুম্বাই-এর একটি প্রথম সারির রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি-শেফ-এর মজুরী কয়েকগুন বেশি, তা কি এঁর রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু বলে ? বরং বিপরীতটাই হয়ত সত্য (আমার ব্যক্তিগত মতে ‘হয়ত’-টা নেই) ! তাহলে বিষয়টি কী ? এই প্রথম সারির রেস্টুরেন্টের শেফ হওয়ার জন্য কোর্স করতে ডিগ্রী পেতে যে অর্থ খরচ করতে হয়েছে, এবং/অথবা যে বিশেষ সময় লেগেছে, তা আদতে একটা বিনিয়োগ হিসাবেই সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। আর তাই প্রথমজন যত ভাল রান্নাই করুন না কেন, তিনি আনস্কিল্ড লেবার, দ্বিতীয়জন স্কিল্ড। একই ভাবে একজন চা-শ্রমিক, যিনি চা-পাতা তোলেন, তাঁর সেই কাজের বিশেষ দক্ষতার কথা ভাবুন (তরাই/ পাহাড়ের নারী শ্রমিকরাই সাধারণত এই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন), শহরের কোনও বিশিষ্ট অধ্যাপক, চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার যা বিশ বছরেও অর্জন করতে পারবেন না। বিপরীতে পাহাড়প্রমাণ প্রতিকূলতা কাটিয়েও চা-শ্রমিকের সন্তান অধ্যাপক/চিকিৎসক/ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন এমন নজির কিন্তু অনেক আছে। এমন চা-শ্রমিকরা নাকি আনস্কিল্ড লেবার, আর অধ্যাপক/চিকিৎসক/ইঞ্জিনিয়াররা স্কিল্ড ! আসলে সংজ্ঞাটাই স্কিলের নয়, স্কিল তৈরির পিছনে বিনিয়োগের।

বিভিন্ন স্কিল তৈরির জন্য এই আলাদা আলাদা পরিমাণ বিনিয়োগের ফলেই একই পরিমাণ শ্রমশক্তির ‘দাম’ হতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং সেই অনুযায়ী মজুরী/মাইনেও; কারণ যত বেশি বিনিয়োগ, ততো বেশি দাম। যেমন এই চা-শ্রমিক আর সফ্‌ট্‌ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের কথাই ধরুন; প্রথমজনের বিপুল দক্ষতা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ কেবল পেট চালাবার মতো খরচটুকু, আর দ্বিতীয়জনের অতি-সাধারণ দক্ষতা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ শুধু পেট চালানো নয়, বরং ইঞ্জিয়ারিং পড়ার জন্য যাবতীয় খরচাপাতি, যা অর্থ এবং সময়ের অঙ্কেও বিশাল। সেজন্যই সুদক্ষ চা-শ্রমিকের রোজ যখন ১৪০ টাকা, সাধারণ সফ্‌ট্‌ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের মাসমাইনে তখন ৫০ হাজার টাকা।

ঠিক যেমন আগে দেখানো হয়েছে, পুঁজিনিবিড় শিল্পের পণ্যের ‘দাম’ তার ‘মূল্য’-এর থেকে বেশি এবং শ্রমনিবিড় শিল্পে তা কম, ফলে ‘দাম’-এর ভিত্তিতে বিনিময়ে প্রথমক্ষেত্র দ্বিতীয়ক্ষেত্রের ‘মূল্য’ থেকে ভাগ পায়, একই ভাবে, ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট-এর জন্য ইনভেস্টমেন্ট’-এর ভিত্তিতে শ্রমশক্তির ‘দাম’ নির্ধারিত হওয়ায় তথাকথিত ‘স্কিল্ড লেবার’রা, হোয়াইট কলার ওয়ার্কাররা, অধ্যাপক-চিকিৎসক-উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তথাকথিত ‘আনস্কিল্ড লেবার’-দের না পাওয়া ‘মূল্য’ থেকে ভাগ পান। এমনকি হতে পারে অনেক বেশি ‘মূল্য’-এর শ্রমশক্তির অনেক কম ‘দাম’, আর অনেক কম ‘মূল্য’-এর শ্রমশক্তির অনেক বেশি ‘দাম’, এমনকি তার নিজের ‘মূল্য’-এর থেকেও বেশি (সেক্ষেত্রে তাঁর শ্রমের কোনও শোষণই হচ্ছে না)। অর্থাৎ, তথাকথিত ‘আনস্কিল্ড’ লেবারের না পাওয়া ‘মূল্য’-এর ভাগ ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ‘স্কিল্ড’ লেবারের মজুরী/মাইনেতে; স্বাভাবিকভাবেই, তিনি আর তখন ‘উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী’ শ্রমিক/শ্রমজীবী নন, বরং ‘উদ্বৃত্তভোগী’। এরই ফলে, আগে যেমন সকল শ্রমিককেই শ্রেণীগতভাবে একটা সর্বহারা শ্রেণীর ছাতার তলায় ধরা হত, আজ কিন্তু তেমনটা সম্ভব নয়; আজ তারা ভাগ হয়ে গেছে অন্তত গোদাভাবে দুই শ্রেণীতে : ‘উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী’ এবং ‘উদ্বৃত্তভোগী’ শ্রমিক/শ্রমজীবী। প্রথমোক্ত অংশকেই আমরা আজ সর্বহারা শ্রেণী বলতে পারি; আর দ্বিতীয় অংশ থেকেই জন্ম নিচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে সুবিধাবাদ। সাম্রাজ্যবাদের শুরুর যুগে, যেমনটা লেনিন দেখিয়েছিলেন, এই দ্বিতীয় অংশটা সৃষ্টি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে, যাদেরকে লেনিন বলেছিলেন ‘কুলীন শ্রমিক’ বা ‘ঘুষ খাওয়া শ্রমিক’; আজ কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে এটা সকল দেশের অভ্যন্তরেই সৃষ্টি হয়ে গেছে, এটা একটা সাধারণ প্রবণতা যা এসেছে ‘শ্রমশক্তি’-র বিনিময়ের মাপকাঠি ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখা দরকার যে, এক, এটি কেবল কেন্দ্রীয় চরিত্র যার আশেপাশে আগের প্রবণতাগুলিও থেকে যায়; এবং দুই, মজুরী/মাইনে কখনই একটা ইস্পাতের মতো কঠোর নিয়মে বাঁধা থাকে না, তা সবসময়েই স্থিতিস্থাপক (যদিও একটা সীমার মধ্যে), এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির ওপর গুরুত্বপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ‘শ্রমশক্তি’ বিনিময়ের মাপকাঠি তার ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরিত হওয়া, ‘উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী’ এবং ‘উদ্বৃত্তভোগী’ শ্রমিক/শ্রমজীবী সৃষ্টি হওয়া, এগুলো নিয়ম ঠিক করে আসেনি, এসেছে আর্থসামাজিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে – সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠা একটা কেন্দ্রীয় দর্শনের পিছু পিছু – একটা সর্বব্যাপী মানদণ্ড অনুযায়ী : “যত বেশি বিনিয়োগ, ততো বেশি লাভ”।

এখানে বিস্তারিত ভাবে না হলেও সংক্ষেপে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে উৎপাদনের সাথে তার বাণিজ্যও একটা প্রচণ্ড গুরুত্ব অর্জন করার ফলে ‘প্রোডাক্টিভ ক্যাপিটাল’ ও ‘ট্রেড ক্যাপিটাল’ যেভাবে তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বসহ পৃথক ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পুঁজিবাদের বিকাশের আধুনিক পর্যায়ে ‘শ্রমশক্তি’-র বিনিময়ের ভিত্তি ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরিত হওয়ার ফলে সেও এক প্রচণ্ড গুরুত্ব অর্জন করেছে। আর তার পরিণামেই ‘কন্সট্যান্ট ক্যাপিটাল’ (যন্ত্রাদিতে বিনিয়োগ) এবং ‘ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল’ (শ্রমিকে বিনিয়োগ) দুটি পৃথক ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন, যদিও একই ভাবে তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বসহ। ‘ভ্যারিয়েব্‌ল্‌ ক্যাপিটাল’ (শ্রমিকে বিনিয়োগ)-এর এই পৃথক ক্ষেত্রে পরিণত হওয়াই আজ সর্বব্যাপী ‘ঠিকাপ্রথার’ জন্ম দিচ্ছে, যা ‘শ্রমশক্তি’-র ‘দাম’-এর মানদণ্ডে বিনিময়ের যুগে উত্তরণের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণাম।       

স্বনিযুক্ত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই মানদণ্ড কিন্তু আরও এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাঁরা তো কাউকে নিজের ‘শ্রমশক্তি’ বেচেন না; সরঞ্জাম কিনে তার সাথে নিজের শ্রম যুক্ত ক’রে নতুন পণ্য উৎপাদন ক’রে বিক্রি করেন; যে আয় হয়, তাই দিয়ে আবার নিজের সংসারের খরচ চালান। সহজ যুক্তিতে মনে হয় তাঁর জন্য ব্যবস্থাটা CMC’; অনেক অর্থনীতিবিদই একে প্রাক্‌-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করে রোজা লুক্সেমবার্গ-এর তত্ত্বকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে এরকম অংশকে লুটে নিয়েই পুঁজিবাদ কিভাবে প্রাক্‌-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপরেই টিকে থাকে। কিন্তু আজকের দিনে এমন স্বনিযুক্ত শ্রমিকরা তাঁদের পণ্য আদৌ শ্রমের মাপকাঠিতে বিক্রি করেন না। বরং যেসব সরঞ্জাম তাঁকে কিনতে হয়, তা তাঁর কাছে একটা ‘বিনিয়োগ’, এবং সামাজিক গড়পড়তা মুনাফা হার অনুযায়ী একটা বাড়তি ধরে নিয়েই তাঁর পণ্যের ‘বাজার দাম’ নির্ধারণ করেন (চাহিদা-জোগানের বিষয়টা এর ওপর একটা ‘ফ্লাকচুয়েশন’ মাত্র, তা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি না)। এই ‘মুনাফা’ তাঁর ‘শ্রমমূল্য’-এর থেকে কম হতে পারে, সাধারণভাবে তা-ই হয়, ফলে সৃষ্টি হয় একটা ‘সামাজিক উদ্বৃত্ত মূল্য’ যা ভোগ করে বড় বিনিয়োগকারীরা এক অপ্রত্যক্ষ উপায়ে। বিষয়টি একটা উদাহরণের সাহায্যে আমরা বোঝার চেষ্টা করব।

ধরা যাক, রাস্তার ধারের একটি চায়ের দোকানদার, যাঁর ৫০ কাপ চায়ের জন্য সরঞ্জাম পিছু খরচ ২০০ টাকা, আর সেই পরিমাণ চা তৈরির জন্য তাঁর ‘শ্রমমূল্য’ ৩০০ টাকা। তাহলে মোট চায়ের ‘মূল্য’ ২০০+৩০০=৫০০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কাপ ১০ টাকা। কিন্তু তিনি তাঁর ‘শ্রমমূল্য’-এর কথা মাথায় রাখেন না, রাখার উপায়ও নেই, তাঁর কাছে আছে কেবল ওই ২০০ টাকার হিসেব; সরঞ্জামের জন্য খরচ করা ওই ২০০ টাকাই তাঁর বিনিয়োগ; আর তিনি জানেন বাজারে এখন গড়পড়তা (ধরা যাক) ২৫% মুনাফা হার চলছে। সুতরাং তাঁর চায়ের ‘দাম’ হবে মোট ২০০+৫০=২৫০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কাপ ৫ টাকা। ‘মূল্য’ যেহেতু ১০ টাকা, ফলে এখন তিনি প্রতি কাপে ৫ টাকা কম পাচ্ছেন। তাহলে তা যাচ্ছে কোথায়? মূলত দুভাবে এটি শুষে নেওয়া হচ্ছে। এক, যে ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে ৫ টাকা কম দিয়ে চা কিনছেন, তিনি আবার যখন অন্য পণ্য কিনছেন, যা অনেক বেশি বিনিয়োগে তৈরি, ফলে ‘মূল্য’-এর থেকে ‘দাম’ বেশি, যেমন ধরা যাক কোল্ড ড্রিংক বা এমন অনেক কিছু, বা এমনকি ওই চা-বিক্রেতার থেকেই কেনা একটি সিগারেট, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে ওই টাকা তাদের ‘মূল্য’-এর থেকে বেশি হিসাবে চলে যাচ্ছে। আবার এই ক্রেতা অন্য কোনও পণ্য বিক্রি করলে একই পদ্ধতিতে ক্রমান্বয়ে একটা চেন-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই না পাওয়া ‘মূল্য’ তথা ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ গোটা সমাজে বণ্টন হয়ে যাচ্ছে যারা যার বিনিয়োগের ভিত্তিতে। দুই, ক্রেতা যদি কোনও কারখানা বা কর্মক্ষেত্রের শ্রমিক/শ্রমজীবী হন (বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেটাই সত্য), তাহলে এই ঘটনার সাথে যোগ হবে আর একটা বিষয়; এমন সমস্ত পণ্যের পিছনে এমন ক্রেতাদের খরচ তাদের ‘মূল্য’-এর থেকে কম হওয়ায় ঐ কারখানায়/কর্মক্ষেত্রে মজুরীর ন্যূনতম হার আরও নেমে যাবে যা দেবে তাঁদের মালিককে বাড়তি মুনাফা।

এভাবেই গোটা সমাজ জুড়ে এক জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্বনিযুক্ত শ্রমিককেও শোষণ করছে পুঁজি, তাঁর এই অর্থনীতিটি প্রাক্‌-পুঁজিবাদী বলে নয়, বরং পুঁজিবাদের মানদণ্ডটি তিনি গ্রহণ করেছেন বলেই : যত বেশি বিনিয়োগ, ততো বেশি লাভ। অবশ্য একা তিনি নন, ক্রেতাও ওই একই মানদণ্ড গ্রহণ করেছেন, তবেই কেনা-বেচা সম্ভব। এখানে মজার বিষয় হল, এই স্বনিযুক্ত শ্রমিক তাঁর ‘শ্রম’-এর মানদণ্ডে পণ্য বিক্রি করতে পারলে আদৌ তাঁর শোষণ হতো না, তাঁকে সর্বহারাদের দলে ফেলাও যেত না, ‘পুঁজি’-র মানদণ্ডে বিক্রি করার ফলেই তাঁর শোষণ চলছে, তিনিও ‘উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী’ সর্বহারার দলে ঢুকে পড়ছেন। বলা যেতে পারে, চেয়ে বা না চেয়ে, তিনি শ্রমিক থেকে যতটা খুদে/পেতি বুর্জোয়া হয়ে উঠেছেন, তা-ই তাঁকে ততো পরিমাণে সর্বহারার দলে ছুঁড়ে ফেলেছে।

অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে পুঁজির কাজ করার পদ্ধতিটি শিল্পের থেকে ভিন্ন। ‘ক্যাপিটাল’ বইটির তৃতীয় খণ্ডে মার্কস এ বিষয়ে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে মনে করেন এখানে মার্কস কেবল রিকার্ডোর ‘ডিফারেন্সিয়াল রেন্ট’ বা ‘পার্থক্যজনিত খাজনা’-র তত্ত্বটিকে সুসজ্জিত করেছেন। আবার অনেকে মনে করেন পাশ্চাত্যে যেহেতু কৃষির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই শিল্পপুঁজির বিকাশ ঘটেছে, তাই মার্কস ‘ক্যাপিটাল’-এ কৃষির বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর কোনটিই সঠিক নয়। মনে রাখা দরকার, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এঙ্গেলস ‘ক্যাপিটাল’ বইটির অধ্যায়গুলিকে কেবল পুঁজির বিশ্লেষণের স্বার্থেই সাজাননি, তা পুঁজির বিকাশকে বোঝানোর জন্য ইতিহাসক্রমিক ভাবেও সাজিয়েছেন। এবং এখানে কৃষির বিষয়টিকে রাখা হয়েছে সবার শেষে। প্রাক্‌-পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থার বিশ্লেষণ এর উদ্দেশ্যই নয়, এমনকি পুঁজিবাদের শুরুর যুগগুলিও নয়, বরং বিকশিত পুঁজিবাদের যুগে কৃষিব্যবস্থার স্বরূপই এখানে উন্মোচন করা হয়েছে। যখন ‘গড় মুনাফা হার’-এর ভিত্তিতে মূল্যদাম-এ রূপান্তরের যুগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সুদ-ভিত্তিক ব্যাংক পুঁজি অন্যতম গুরুত্ব অর্জন করেছে, তখন কৃষিতে পুঁজির কাজ করার প্রক্রিয়া এ বইতে ব্যাখ্যা করেছেন মার্কস। তার সবিস্তার বর্ণনা এ প্রবন্ধের আয়ত্তে নেই। কিন্তু সংক্ষেপে এটুকু বলা যেতে পারে, যে, শিল্পক্ষেত্রে যেমন পুঁজি ‘মালিক-শ্রমিক’ এই দ্বিমুখী শ্রেণী-সম্পর্ক সৃষ্টি করে, কৃষিক্ষেত্রে সেখানে পুঁজি তৈরি করে ‘জমিদার-পুঁজিপতি-শ্রমিক’ এই ত্রিমুখী শ্রেণী-দ্বন্দ্ব; মার্কস একে ‘ত্রিযোজী সূত্র’ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে প্রথম জন জমির মালিক যে তার জমি লিজ্‌ দেয়, দ্বিতীয় জন ‘ইনভেস্টর’ যে লিজ্‌ নিয়ে চাষের জন্য বিনিয়োগ করে, আর তৃতীয় জন ক্ষেতমজুর যিনি উৎপাদনে দেন তাঁর শ্রম। ক্ষেতমজুর ‘শ্রমশক্তি’-র ‘দাম’ পান তাঁর মজুরী হিসাবে, আর তাঁর ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ ভাগ হয়ে যায় ‘ইনভেস্টর’-এর ‘মুনাফা’ আর জমির মালিকের ‘লিজ্‌-এর ভাড়া’ (তথা রেন্ট)-এ। এক্ষেত্রে ‘ডিফারেন্সিয়াল’ (আপেক্ষিক) আর ‘অ্যাবসোলুট’ (অনাপেক্ষিক) দু’ধরণের ‘রেন্ট’ হতে পারে। মার্কস দেখিয়েছিলেন যে এই ‘রেন্ট’ আসেই সমাজে ‘গড় মুনাফা হার’-এর ভিত্তিতে মূল্যদাম-এ রূপান্তরের ফলেই, এবং জমিদারের পাওয়া এই অর্থ সাধারণত ঐ কৃষিক্ষেত্রে আর বিনিয়োগ হয় না, তা চলে যায়/যেতে পারে তাদের ভরণপোষণ সহ অন্য উৎপাদন ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য যে, জমিদার বা জমির মালিক থাকলে বা ‘লার্জস্কেল ফারমিং’ না হলে তা পুঁজিবাদই নয়, এ এক মস্ত ভুল ধারণা, যা আমাদের ও অন্যান্য দেশের অধিকাংশ কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদেরা বয়ে চলেছেন। আজকের দিনে আমাদের দেশে ছোট জমির আধিক্য বা লিজ দেওয়া জমির মালিকের ব্যাপক অস্তিত্ব কোনটাই কোনওভাবেই প্রাক্‌-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা সামন্ততন্ত্রকে দেখায় না; বরং তাদের কৃষিজাত দ্রব্যটি বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যেই তৈরি হচ্ছে, যা ‘পণ্য-ব্যবস্থা’-কেই তুলে ধরে। এবং (যেমন আগে দেখানো হয়েছে) বিনিয়োগের মানদণ্ডটিই এখানে কার্যকর।

এখানে উল্লেখ্য যে, ছোট কৃষিজমির ক্ষেত্রে উপরোক্ত তিনটি শ্রেণীর (জমির মালিক, ইনভেস্টর ও শ্রমিক) মানুষকে যে পৃথক পৃথক ব্যক্তিই হতে হবে, তা সবসময় নয়; একজন ব্যক্তি এদের মধ্যে যেকোনো দুটি বা এমনকি তিনটি শ্রেণীতেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কৃষক নিজের জমিতে নিজেই বিনিয়োগ করে মজুর রেখে চাষ করাচ্ছেন (কৃষক প্রথম দুই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত), বা মজুর অন্যের জমি লিজ্‌ নিয়ে নিজে চাষ করছেন (তিনি একত্রে ইনভেস্টর ও শ্রমিক), অথবা কৃষক নিজের জমি নিজে চাষ করছেন অন্যের থেকে ধার নিয়ে (কৃষক জমির মালিক ও শ্রমিক, কিন্তু ইনভেস্টর নয়), কিংবা হতে পারে কৃষক নিজের জমিতে নিজেই বিনিয়োগ করে চাষ করছেন (তিনটি শ্রেণীতেই তিনি পড়েন), ইত্যাদি। আমাদের দেশে এমন সব ধরণের কম্বিনেশনই দেখা যায়। এর বিষদ বিবরণ এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়। কিন্তু মূল যে কথাটা বলার, তা হল, এক, কৃষি-শ্রমিকের স্কিল তৈরিতে বিনিয়োগ পেট চালাবার খরচটুকু মাত্র হওয়ায় তাঁর ‘শ্রমশক্তি’-র ‘দাম’ তথা মজুরী ‘মূল্য’-এর নিচে থাকে, আর দুই, কৃষিক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ কম হওয়ায় ‘গড় মুনাফা হার’ অনুযায়ী মুনাফা ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’-এর থেকে কম; ফলে মজুরী হিসাবে ‘শ্রমশক্তির না পাওয়া মূল্য’ এবং মুনাফা হিসাবে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের না পাওয়া ভাগ’ কৃষি থেকে ‘সামাজিক উদ্বৃত্ত মূল্য’ হিসাবে চলে যায় বড় বিনিয়োগকারীদের হাতে, ‘দাম’-এ বিনিময়ের জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে (যেমনটা আগে দেখানো হয়েছে)। ফলে শুধু ক্ষেতমজুরেরাই নয়, খুদে কৃষকরাও কার্যত সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত হয়। এর কত রকমফের হতে পারে তা লেনিন ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’ বইটিতে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এখানে যেটা বলবার, কোনও প্রাক্‌-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসাবে নয়, বরং মূল্যদাম-এ রূপান্তরের যুগে বিকশিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসাবেই কৃষি আজ শিল্প ও পরিষেবাকে ‘এক্সট্রা সারপ্লাস’ বা ‘বাড়তি উদ্বৃত্ত’-এর জোগান দিচ্ছে।

এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবে এসে পড়ে ‘জমির দাম’-এর প্রশ্নটি। মার্কস ‘ক্যাপিটাল’-এ ব্যাখ্যা করেন, জমি তো মানুষের শ্রমের ফলে তৈরি হওয়া কোনও পণ্য নয়, তাহলে তার ‘মূল্য’ থাকতে পারে না, সেক্ষেত্রে ‘দাম’-ই বা এল কোথা থেকে ? আসলে নির্দিষ্ট একটা জমির উর্বরতা একই পরিমাণ অন্য জমির থেকে বেশি হলে সমান পরিমাণ পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ করলে দ্বিতীয়টির থেকে প্রথমটিতে বেশি ফসল উৎপন্ন হবে, ফলে ‘বাজার দাম’ থেকে আসবে মুনাফার ওপর একটা বাড়তি অর্থ – জমির মালিক শুধু মালিকানার কারনেই যা পায় (অ্যাবসোলুট রেন্ট), তার সাথে এই বাড়তিটাও (ডিফারেন্সিয়াল রেন্ট) লিজের ভাড়ায় যুক্ত হয়। সে এই উৎপাদনে কোনও পুঁজি বিনিয়োগ করেনি, শ্রম দেয়নি, দিয়েছে কেবল জমি (প্রকৃতির যে জিনিস সে নিজের দখলে রেখেছে মাত্র), আর বছর গেলে তারই জন্য পাচ্ছে একটা টাকা। এটা তার কাছে ব্যঙ্কে জমা রাখা একটা ডিপোজিটের থেকে পাওয়া সুদেরই সমতুল্য এবং এই তুল্যমূল্যই সৃষ্টি করে ‘জমির দাম’। ধরা যাক, এক জমির মালিক লিজের ভাড়া পায় বছরে ১০ হাজার টাকা আর গড়ে ব্যাংকের সুদ ৫%; সেক্ষেত্রে তার কাছে এই ১০ হাজার টাকাটা (২ লাখ টাকার ৫%) আসে যেন ব্যাঙ্কে রাখা ২ লাখ টাকার সুদ হিসাবে। সুতরাং তার ‘জমির দাম’ তথা ভ্যালুয়েশন হবে ২ লাখ টাকা। ফলে স্পষ্টতই মূল্যদাম-এ রূপান্তর এবং সুদ-ভিত্তিক ব্যাংক পুঁজির সর্বজনীনতা ব্যাতিরেকে ‘জমির বাজার দাম’ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ‘জমির বাজার দাম’ নিজেই জমিতে পুঁজির কার্যকারিতার একটা অকাট্য প্রমাণ। অবশ্য প্রতিটি জমি তার ‘বাজার দাম’-এই বিক্রি হবে এমন কোনও কথা নেই, নানা প্রকার পরিস্থিতির কারনে সম্পূর্ণ ভিন্ন দামে তা বিক্রি হতে পারে, ‘বাজার দাম’ কেবল জমির ‘ভ্যালুয়েশন’-কেই প্রকাশ করে।

‘জমির দাম’ সৃষ্টির এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারনেই জমিতে উৎপাদনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণও জমির দাম বদলে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকের সুদের হার পালটালে, বা সেচের খাল জমির কতটা কাছ দিয়ে যাচ্ছে, পরিবহণের ব্যবস্থা কীরকম, বাজার কতটা দূরে অবস্থিত ইত্যাদি বিষয় জমির দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলে; কারণ জমির উৎপাদনশীলতা ছাড়াও এগুলির ভিত্তিতেও একই পুঁজি ও শ্রম নিয়োগ করেও কে কতটা বেশি বা কম আয় করবে, ফলে কতটা বেশি বা কম তা জমির মালিকের কাছে যাবে, তা নির্ধারিত হয়। কৃষিজমি নয় এমন জমিরও ‘দাম’ একই ভাবে সেই জমিতে যে পণ্য তৈরি হয় তার ভিত্তিতে একই উপায়ে নির্ধারিত হয়। যেমন, কৃষিজমির উৎপাদনশীলতার মতোই বাড়ি তৈরির জমির ক্ষেত্রে ধারণক্ষমতা, খনির ক্ষেত্রে খননযোগ্যতা ইত্যাদি। সাথে ব্যাংকের সুদ, পরিবহণ, বাজার ইত্যাদি তো থাকেই। ফলে এই বিকশিত পুঁজিবাদের আওতায় জমি একটা ‘অ্যাসেট’-এ পরিণত হয়। এযুগে কর্পোরেটদের জমি দখলের তাড়না শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য যতটা, এই ‘অ্যাসেট’-টিকে হাতে পাওয়ার জন্য তার চেয়ে কম কিছু নয়। তারা যে জমি নেয় তার একটা অংশে শিল্প করে, অন্য অংশে ‘রিয়েল এস্টেট’ গড়ে তোলে। কোনও সময় শিল্পে লস হলেও ‘অ্যাসেট’ দেখিয়ে শেয়ার বাজার থেকে ব্যাপক অর্থ কামিয়ে নেওয়া যায়। এজন্যই এযুগে কর্পোরেটদের ‘জমি-হাঙর’ হয়ে ওঠাকে ‘পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন’ বা ‘প্রিমিটিভ অ্যাকুমুলেশন’ বলে ভাবাটা একটা চূড়ান্ত ভুল। ‘পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন’ হল প্রাক্‌-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ লুটের মাধ্যমে উৎপাদনের উপায়-উপকরণ সব কুক্ষিগত করতো পুঁজিপতিরা, সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু আজকের এই জমি দখল তার জন্য নয়, বরং মূল্যদাম-এ রূপান্তর এবং ফিন্যান্স ক্যাপিটাল-এর যুগে বিকশিত পুঁজিবাদ যে জটিল পদ্ধতিতে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’-এর ভাগ পাওয়ার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে, সেইটেতে ভাগ বসাবার জন্যই। এটি ‘আদিম সঞ্চয়ন’ নয়, বরং ‘পুজিতান্ত্রিক সঞ্চয়ন’, তাও ব্যাপক বিকশিত পুঁজিবাদী পথে। আধুনিক শেয়ার মার্কেটের সাথে এই ‘জমির দাম’ জড়িয়ে প’ড়ে আরও জটিল এক পরিস্থিতির জন্ম দেয়, যদিও সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করা যাবে না, আমরা আগেই উল্লেখ করেছি তার জন্য প্রয়োজন একটা পৃথক পরিসর।

শেষে সংক্ষেপে বলা যায়, প্রথমত, শিল্প-পরিষেবার মতো প্রত্যক্ষ পুঁজির ক্ষেত্রগুলিতে শ্রমিক শ্রেণী (বা শ্রমজীবী মানুষ) প্রধানত দুটি অংশে বিভাজিত হয়ে গেছে : উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী শ্রমিক/শ্রমজীবী (তথাকথিত আনস্কিল্ড) এবং উদ্বৃত্ত ভোগকারী শ্রমিক/শ্রমজীবী (তথাকথিত স্কিল্ড), যাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীটিকেই যথার্থ অর্থে ‘সর্বহারা’ বা ‘প্রলেতারিয়েত’ বলা যায়, আর দ্বিতীয় অংশের থেকে জন্ম নিচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে সুবিধাবাদ; দ্বিতীয়ত, স্বনিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণী তার খুদে/পেতি বুর্জোয়া অর্থনীতির কারণেই ‘সর্বহারা শ্রেণী’-র মতোই তৈরি করছে ‘সামাজিক উদ্বৃত্ত’ যা আজকের বিকশিত পুঁজিবাদের এক জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে করায়ত্ত করছে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণী; এবং তৃতীয়ত, একাধিক ভিন্ন শ্রেণীর রামধনু সৃষ্টি করা কৃষক-সমাজের বৃহত্তম অংশ, যারা উৎপাদনে শ্রম দেয়, সেই অংশ ‘সামাজিক উদ্বৃত্ত’ সৃষ্টি করে হয়ে উঠেছে ‘সর্বহারা শ্রেণী’-রই এক রূপ, আর অন্যান্য খুদে চাষি ও ছোট জমির মালিকেরা বিনিয়োগের ক্ষুদ্র পরিমাণের কারণেই ক্ষেতমজুরের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’-এর বড় অংশে কোপ খেয়ে হতদরিদ্র অবস্থায় পৌঁছেছে, এবং তার সাথে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতোই জমি-হাঙর কর্পোরেটদের লালসা এই শ্রেণীকে সর্বস্বান্ত করে ‘সর্বহারা’ বানিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। স্পষ্টতই, পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে শোষণের রূপ বদলাতে বদলাতে আগের শ্রেণী-সম্পর্ক ব্যাপক ভাবে বদলে গেছে আজকের নতুন পরিস্থিতিতে। এতকাল যাদেরকে ‘সর্বহারা শ্রেণী’ হিসাবে চিহ্নিত করে বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়েছে, বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠেছে, সেই শ্রেণীর বৃহত্তম অংশ ‘উদ্বৃত্তভোগী’ সুবিধাবাদী শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে; ফলে এই পার্টিগুলিও সুবিধাবাদের গাড্ডায় গিয়ে পড়েছে। একই সাথে শোষণের নতুন রূপ নতুন বিপ্লবী শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, ‘উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী’-দের দলে নতুন করে আরও ব্যাপক অংশকে টেনে এনেছে, বিপ্লবী শ্রেণীর আকারকে অভূতপূর্ব পরিমাণে বাড়িয়ে তুলেছে। এর ভিতের ওপরেই গড়ে তুলতে হবে আজকের পুঁজিতান্ত্রিক শোষণব্যবস্থার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ বিপ্লবী পার্টি, আর তারই হাত ধরে সুচিত হবে মার্কসবাদের নতুন জয়যাত্রা।

কমঃ বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের আহ্বায়ক

 

Similar Posts

4 Comments

  1. Tapan(তপন)Bhattacharya(ভট্টাচার্য)

    রচনাটি প্রনিধানযোগ্য,আরো তথ্য ও বিতর্কসূত্রে সমৃদ্ধ
    হওয়া দরকার ছিলো !

  2. মোটের ওপর গোদা দাগে যা ধারণা করতে পারতাম, তারই এমন যুক্তিনিষ্ঠ বস্তুগত অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ব‍্যাখ‍্যা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। আত্মবিশ্বাস বাড়ল – এই ভেবে যে ভাবনার জগতে ঠিক অবস্থানেই আছি, যদিও বাস্তবের রূপরেখা কী হতে পারে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

  3. এটা ক্যাপিটাল এর বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ।ঠিক রাস্তায় আছে।টসকায় নি।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বৌদ্ধিক শ্রমের ব্যাপারে বক্তব্য টা বোঝা গেল না।সেরকম ভাবে আলোচনা হয় নি। এই আলোচনা অর্থনৈতিক পরিসরের কিন্তু রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।এইজন্য যে বর্তমান সময় এর নানারকমের সামাজিক-আর্থিক শ্রেণী গুলোর বিপ্লবী চরিত্র,তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝার জন্য , তাদের সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থান জানার জন্যে।মোটের ওপর ভালো লাগল লেখাটি।আরও পড়তে চাই।

  4. “এই প্রশ্নগুলি ছাড়াও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আজকের ফাটকা কারবারের যুগে যেখানে কোনও উৎপাদন ছাড়াই টাকা খাটিয়ে টাকা তোলা যাচ্ছে, বিপুল মুনাফা কামানো যাচ্ছে, সেখানে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’-টি আর খাটে কি ? কোনও উৎপাদনের মজুরী-শ্রম ছাড়াই তো এই মুনাফা আসছে ! তাহলে একে আর শোষণ-ব্যবস্থাও বলা যায় কি ? এই বিষয়ে আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব না, তার জন্য প্রয়োজন একটা পৃথক পরিসর।”
    এমনিতেই অর্থনীতির বিষয়াদি বরাবরের নতোই আমার নিকট দূর্বোধ্য। তবে আপনার আলোচনাটা সেই তুলনায় অনেক সহজবোধ্য লেগেছে। এই বিষয়ে আপনার কোন আলোচনা অন্যত্র হলেও আছে কি? বা কখনো যদি করেন সঙ্গে ফ্রি লানসেরদের করা আয় ও ডাক্তার/প্রকৌশলীদের মোটা মাসিক আয় ও শ্রেনী হিসাবে তাদের অবস্থানটাও বলবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *