জেএনইউ-তে সাম্প্রতিক আক্রমণ প্রসঙ্গে এই সংক্ষিপ্ত লেখাটির অবতারণা। যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্লস হোস্টেলে ঢুকে বিজেপির (অভিযোগ তেমনটাই) দুষ্কৃতিরা মুখ ঢেকে মারধর চালিয়েছে, সংবাদ মাধ্যমে তা দেখে দেশের সমস্ত প্রান্তের মানুষেরই ক্ষোভ ফেটে বেরিয়েছে। নিজেদের রক্ষণশীলতা কাটিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন বহু মানুষ। এই প্রবণতা খুবই পজিটিভ্‌ একটা ধারার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি জন্ম সাথে যন্ত্রণাও বয়ে আনে। সে সম্পর্কে সতর্ক না হলে অঙ্কুরেই বিনাসের সম্ভাবনাও থাকে। সেই প্রঙ্গেই এই লেখা। জেএনইউ-এর ঘটনার অব্যাবহিত পরেই শীর্ষ বাম নেতারা তো বটেই, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, এমনকি পরের দিনই তৃণমূল নেতৃত্বও ছুটে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আর ঠিক এখানেই মনে পড়ে যাচ্ছে ‘কমরেড’ কানাইয়া কুমারের কথা।

জেএনইউ-এর ছাত্র সংসদের সভাপতি থাকাকালীন কানাইয়া কুমার সহ তিন ছাত্র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে। “কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি” স্লোগানই ছিল প্রধান অভিযোগ। প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল দেশপ্রেমের চা-এ চুমুক দিয়ে সকলেই মেতে উঠবে এঁদের কড়া শাস্তির দাবীতে। ঘটনা কিন্তু সেপথে এগোল না। দেশের ব্যাপকতম যুবসমাজ উল্টে কানাইয়া কুমারের কার্যত ফ্যান হয়ে উঠলেন। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় সেসময়ে দেখেছি, যেমনটা আমাদের পশ্চিমবাংলায় বেশিরভাগই মনে করেন যে হিন্দিভাষী মানেই বিজেপির সমর্থক, ঠিক তার বিপরীতে বেশীর ভাগ হিন্দিভাষী যুবক কানাইয়াকে তাঁদের হিরো বলে অভিহিত করছেন। গোটা দেশ জুড়ে এই বিপরীত স্রোতটাই সরকার-প্রশাসন-আদালতকে বাধ্য করে তাঁদের রেহাই দিতে।

কিন্তু এর পর থেকেই সামনে আসতে থাকল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। যে সংগ্রামী বামপন্থী বক্তব্য থেকেই এই ‘কানাইয়া কুমার’-এর জন্ম, এখন তার থেকে শত যোজন দূরে তাঁর বক্তৃতা। ইতিমধ্যেই মিডিয়ায় তিনি সেলিব্রেটির জায়গা অর্জন করেছেন। কর্পোরেট মহলের আয়োজিত অনুষ্ঠানেও বক্তা হিসাবে প্রধান আকর্ষণ রূপে উপস্থিত হয়ে কিছু পুঁজিপতির বাহবা গেয়েছেন। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে তুলে ধরার পরিবর্তে কংগ্রেসকে তুলে ধরাই তাঁর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলা যায়। পশ্চিমবাংলায় এসে একাধিক সমাবেশে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে বামেদের জোটের প্রস্তাব করেন তিনি। বিহারে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে বহুমূল্য হুটখোলা গাড়িতে চেপে প্রচার সকলেরই নজর কেড়েছে। বলা বাহুল্য যে এরাজ্যের আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়া কংগ্রেস বনে যাওয়া বাম নেতাদেরও এমন বিলাসবহুল গাড়ি চড়ে বেড়াতে দেখা যায়নি কখনও। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে, যে “কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি” স্লোগান কানাইয়া কুমার নামক একজন ছাত্রকে গোটা দেশের সকলের মুখে ফেরা ‘কানাইয়া কুমার’ বানিয়েছিল, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা খারিজের সময় সেই কানাইয়া কুমারের নির্লজ্জ নীরবতা এবং কিছু পাস কাটানো বুলি মাত্র পেল দেশের জনতা।

বোঝা গেল, আসলে দেশের বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশ্যে কর্পোরেটের ‘খুড়োর কল’-এর সামনে ঝোলানো লোভনীয় এক খাদ্যটি মাত্র ‘ছিল’ ‘কানাইয়া কুমার’। ‘যেটি’-কে সামনে ঝুলিয়ে দেশের জনগণকে যেদিকে খুশি যত ইচ্ছা মাইল ছোটানো যায়। এই বাক্যগুলিতে তাই আমরা ‘আপনি’-সূচক শব্দচিহ্নগুলি সরিয়ে দিলাম। আর যাই হোক একটা ‘খাদ্যপণ্য’-কে তো আর ‘আপনি’ বলা যায় না। একথা আজ জলের মতো পরিষ্কার যে তাকে নিছক জেলে ভরে হিরো বানানো আসলে কর্পোরেট মহলেরই অ্যাজেন্ডা ছিল। আর সরকার–বিরোধী পক্ষ–বিপক্ষ নামে পলিটিকাল পার্টিগুলির মাধ্যমে দেশের জনগণের জন্য রইল : “একটি মুরগি দুটি কান, হয় ‘দেশপ্রেম’, নয় ‘আজাদি’ স্লোগান”।

কিন্তু আজকের মন্দার ধাক্কায় দেশের দামী দামী গাড়ির মতোই ‘কানাইয়া কুমার’-এরও চাহিদায় টান পড়েছে। নয়াউদারবাদের যুগ, কালকের জিনিসের চাহিদা আজ আর থাকে না, আজ আবার একটা নতুন চাই। আজ তাই আর একটা ‘কানাইয়া কুমার’ চাই তাদের। খোঁজ চলছে, সবচেয়ে বেশি সেই কারখানায়, যারা নিত্য নতুন বকরার জোগান দিতে পারে।

এ কথাগুলি বলার সাথে সাথে আরও যেটা বলা দরকার, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি, ২০১১ থেকে ’১৬ পুলিশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পশ্চিমবাংলার কলেজে কলেজে তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতিরা কালো কাপড়ে মুখ না ঢেকেই প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রদের যেভাবে মেরেছে, তার তুলনায় জেএনইউ-এ এই আক্রমণ নিতান্ত শিশু। কেউ সুবিধাবাদীর মতো এপ্রশ্নে মৌনতা নেবেন, কেউ কেউ বলবেন এমন তুলনা করা অনুচিত, কিন্তু তাঁরাই এসব করবেন যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে তৃণমূল কংগ্রেসকে তুলে ধরতে চাইছেন। সত্য কথা সোজা হয়ে বলবার মতো শিরদাঁড়া যাঁদের নেই। স্বপন কোলেকে কিভাবে দিনের বেলায় কলেজ থেকে তাড়া করে খুন করেছিল তৃণমূল তা মনে পড়ে? তথ্য দিলে উদাহরণের লিস্ট বেড়েই চলবে, তাই একান্ত নিজের চোখে দেখা কয়েকটা বিষয় তুলে ধরছি। যেমন নিজের কলেজেই দেখেছি তৃণমূলী গুণ্ডারা ছাত্রের মুখে চার ইঞ্চি মোটা বাঁশ দিয়ে মারল, বাঁশ ভেঙ্গে গেল, মুখ রক্তাক্ত। ব্যক্তিগত দুটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলব। ২০১৪ সাল; SFI-এর এক নির্বাচিত ছাত্র-প্রতিনিধিকে তৃনমূলী দুষ্কৃতিরা কলেজ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ডেরায় রেখে মুখ হাত সব ফাটিয়ে দিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশের সামনে মুচলেখা লেখাচ্ছে : “কাল পদ থেকে ইস্তফা দেব” – “ঠিক আছে”; “কাল SFI থেকে ইস্তফা দেব” – “ঠিক আছে”; “কাল তৃণমূলে যোগ দেব” – “না। কোনও মতেই না”। অথচ এঁদেরকেই তৎকালীন SFI রাজ্য নেতৃত্ব তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনা, সেই সময়েই একটি কলেজের এক ডিপার্টমেন্টের সকল ছাত্রছাত্রীদেরকে তৃণমূলী দুষ্কৃতিরা যেভাবে মেরেছিল, তা বর্ণনা করা কঠিন। তাঁদের মধ্যে এক ছাত্রের (সে ক্যাম্পাসের SFI নেতা ছিল) পিঠে চারটে কাঠের চেয়ার ভেঙ্গেছিল ওরা। কল্পনা করতে পারেন যে তিনি তারপরেও বেঁচেছিলেন এবং আত্মসমর্পণ করেননি। তারপর তাঁদেরই নামে পুলিসে কেস করে তৃণমূল। এমনকি ওই ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের কেসও এর সাথে জুড়ে দেয় তারা। মাত্র ক’দিন আগে (ভেবে দেখুন পাঁচ বছর পর) রবিবার মাঝরাতে ওই ছাত্রকে পুলিস তুলে নিয়ে যায় ওই কেসকে সামনে রেখেই। পরের দিন আদালত থেকে তিনি বেল পান। এই তৃণমূলকেই বিজেপি-র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথায় তুলে নাচছে ‘আনন্দবাজার’-এর মতো কর্পোরেটদের পা-চাটা খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলগুলি। ক’দিন আগে পর্যন্ত তারাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিকে নিয়ে লাফাচ্ছিল।  

কথাগুলি এই কারনে উল্লেখ করলাম যে এরকম ভয়াবহ আক্রমণে পশ্চিমবাংলায় না বাম নেতাদের টিকিটুকুও দেখা গেছে, না মিডিয়ার, না দীপিকাদেবীদের। এগুলি এরাজ্যে একটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আসলে গরীব নিম্নবিত্ত ফ্যাটফেটিয়ে ইঞ্জিরি বলতে না পারা সাধারণ কলেজের ছাত্রছাত্রী তো ! তাঁদের বাজার-দর, কি মিডিয়ার টিআরপি-র পক্ষে কি রাজনীতির অকশন মঞ্চে, বড়ই কম। বিপরীতে জেএনইউ নিয়ে এত হইচই আসলে এই সব মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর পিছনে থাকা কর্পোরেটদেরই চাহিদা। খুড়োর কলে ঝোলানোর জন্য খাদ্যপণ্যের চাহিদা। শিক্ষার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে এলিট প্রতিষ্ঠানটিকে বেছে নেওয়াই তাদের মাস্টার স্ট্রোক।

রাজনৈতিক ভাবে একে ঠিক কোন অভিমুখ দেওয়া হবে তা নিয়ে খেলা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ঘটনার দিন SFI-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক যখন বলছিলেন ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইয়ের কারনেই এই আক্রমণ, ঠিক তখনই সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলছেন হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডায় এই আক্রমণ। আসলে উনি বোঝেন যে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন বললে কংগ্রেসের সাথে জোট, তৃণমূলের কাছাকাছি আসার চেষ্টা, সব প্ল্যানে জল ঢেলে দেওয়া হবে, কারন এ তো তাদেরও পলিসি। বিজেপিও চায়, কর্পোরেট মহলও চায়, হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাতেই সবাই মুখ খুলুক, পথে নামুক, তাহলে অর্থনৈতিক মন্দায় যে ব্যাপক ছাঁটাই চলছে, আরও ভয়াবহ ছাঁটাই দিন গুনছে, তা পর্দার আড়ালেই থেকে যাবে; মানুষের গভীর ক্ষোভ থেকে যে খিদে তৈরি হচ্ছে, লড়াইয়ের খিদে, লড়াইয়ের নেতা পাওয়ার খিদে, এখান থেকে বরং সেই খাদ্যপণ্যটি তৈরি হোক, ক’দিন পরে আমরা তাকেও আবার খুড়োর কলের সামনে ঝুলিয়ে দেব।

শেষ কথা, ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং এমনই আরও কতশত অসাম্যবিরোধী ইস্যুতে আন্দোলনরত জেএনইউ-এর ছাত্র কমরেডদের রক্তিম অভিনন্দন, কমরেড ঐশী সহ যাঁরা মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন তাঁদের তো বটেই, বাকিরা যাঁরা রক্তাক্ত হতে প্রস্তুত, তাঁদেরকেও অগ্রিমভাবে। আসা করব নিজেদেরকে কর্পোরেটদের চাহিদা মতো ‘একটি’ কানাইয়া কুমার বনে যেতে দেবেন না।

লাল সেলাম।

আর ‘একটি’ কানাইয়া কুমার চাই ???

বাসুদেব নাগ চৌধুরী

পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেড

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *