গত ১৪ই জুন ভারতীয় ইউনিয়নের পার্লেমেন্টে ‘ক্যাবিনেট কমিটি অন সিক্যুরিটি’-র নেতৃত্বে লাগু হলো ‘অগ্নিপথ স্কীম’। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য সেনাবাহিনীতে কন্ট্র্যাকচুয়াল কর্মী, থুড়ি কন্ট্র্যাকচুয়াল ‘জান-দেনেওয়ালা’, নিয়োগের এই স্কীম চারবছরের চুক্তিতে সতেরো থেকে একুশ বছরের তাজা নওজওয়ানদের নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত, সেনাবাহিনীর ‘নন-অফিসার’ পদগুলিতে, যার পোশাকি নাম ‘অগ্নিবীর’। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে বেতন হবে যথাক্রমে ৩০০০০, ৩৩০০০, ৩৬৫০০ ও ৪০০০০ টাকা যার থেকে যথাক্রমে ৯০০০, ৯৯০০, ১০৯৫০ ও ১২০০০ টাকা মিলিয়ে চারবছরে কর্পাস ফাণ্ড বাবদ কাটা হবে ৫.০২ লাখ টাকা। চারবছর পার হলে নিযুক্তদের মধ্যে ২৫ শতাংশের সেনাবাহিনীতে স্থায়ী চাকরী মিলবে। বাকী ৭৫ শতাংশের জুটবে নিজেদের জমানো ‘কর্পাস ফাণ্ড’ ও ভারত সরকার থেকে পাওয়া সমপরিমাণ অর্থ মিলিয়ে সুদ সমেত মোট ১১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকার এককালীন অবসরপ্রাপ্তি-ভাতা [১]। এই নিয়েই দেশজুড়ে গত এক হপ্তায় এক তোলপাড় কাণ্ড, বিশেষত বিজেপি ও এনডিএ-শরিক শাসিত দুই রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে। সেখানে সরাসরি ট্রেন জ্বালিয়ে বিক্ষোভকারীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন এই নতুন নিয়মের, যার চাপে ইতিমধ্যেই ‘অগ্নিবীর’-দের নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ২১ থেকে বাড়িয়ে ২৩ করা হয়েছে [২]। বিজেপির নিজস্ব গড়েই এমন হুলুস্থুল দেখে তথাকথিত ‘বিজেপি-বিরোধী’-রা লাফালাফি জুড়েছেন যুবসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত বিজেপি-বিরোধী বিক্ষোভের আনন্দে। আর মেইনস্ট্রীম বামেরা স্রেফ নাকিকান্না জুড়েছেন এই মর্মে যে, মাত্র চারবছরের এই কন্ট্র্যাকচুয়াল চাকরীতে প্রায় পাইকারি রেটে নিযুক্ত সেনাদের পেশাদারিত্বের অভাব হবে, যা দেশের সুরক্ষার জন্য ভারীই মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা এই প্রকল্পটিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করবো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এবং মেপে দেখবো যে অগ্নিপথের আগুনের আসল জ্বালানিটা আসছে কোত্থেকে!
নিছকই ‘পলিসি’ নাকি আড়ালের ‘ছক’!
অগ্নিপথ স্কীমের আড়ালে যে অর্থনৈতিক মিতব্যয়ীতার পরিকল্পনাই রয়েছে, তা বেতনের অঙ্ক আর অবসরের পর আমৃত্যু পেনশনের বদলে এককালীন ভাতার ঘোষনাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন একটি স্কীম আমদানীর যে আর কোনও কারণই হতে পারেনা, একান্ত বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা তো বটেই, এমনকি খোদ বিজেপি-সরকারের ইকোনমিক-স্ট্র্যাটেজিস্টরাও তা অস্বীকার করবেন না। কিন্তু নেহাৎ-ই কি এগুলো ‘বিজেপি-সরকারের নেওয়া’ ব্যয়সঙ্কোচ নীতিরই প্রতিফলন? নাকি এর পিছনে রয়েছে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক সাধারণ প্রবণতা! সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে দেশের অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে কন্ট্র্যাকচুয়াল কর্মসংস্থানের অভূতপূর্ব বৃদ্ধির সাম্প্রতীক ঘটনাগুলিকে।
প্রথমত, নয়াউদারবাদের আওতায় গোটা দুনিয়া জুড়ে উন্নত ও উন্নয়ণশীল সমস্ত ধরণের অর্থনীতির অঞ্চলেই কন্ট্র্যাকচুয়াল বা ইনফর্মাল শ্রমিকের (অর্থাৎ, যাঁদের কাজের কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই [৩]) সংখ্যা একটি ব্যপকতর প্রবণতা নিয়ে চলছে (চিত্রঃ১)। আমাদের দেশের শ্রমশক্তি সংক্রান্ত তথ্যের [৪, ৫] দিকে তাকালে দেখা যায় যে, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯০% ও অকৃষিজ ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির ৮৫% রয়েছন ইনফর্মাল শ্রমিক হিসেবে।
চিত্র ১: ইনফর্মাল শ্রমশক্তির পরিমান (মোট শ্রমশক্তির শতাংশের বিচারে)
তথ্যসূত্রঃ আইএলও [৫]
উপরের গ্রাফটিতে দেখা যাচ্ছে যে, দুনিয়ার (তথ্যটি ১২৯-টি দেশের উপর নেওয়া, যারা দুনিয়ার মোট অর্থনীতির ৯০% দখল ক’রে আছে) সিংহভাগ শ্রমশক্তিই আজ ইনফর্মাল ধরণের, যার মান ৬২%। পাশাপাশি, দুনিয়ার সিংহভাগ অর্থনৈতিক অঞ্চলেই আজ ইনফর্মালিটি দখল করেছে সিংহভাগ, যেখানে নিম্ন-মধ্য ও নিম্ন আয়ের অঞ্চলগুলিতে ইনফর্মালিটি প্রায় পুরো শ্রমক্ষেত্রকেই গিলে ফেলেছে (যথাক্রমে ৮৫ ও ৮৮ শতাংশ)। অন্যদিকে, কর্মসংস্থান ও কর্মসুরক্ষার পরাকাষ্ঠা হিসেবে খ্যাতিমান উচ-আয়ের অঞ্চলগুলিতেও দেখা যাচ্ছে যে শ্রমশক্তির এক পঞ্চমাংশের দখল নিয়েছে ইনফর্মাল ধরণের শ্রম।
এর প্রধান কারণই হলো— এক, পুঁজির নয়াউদারবাদী দশায় শ্রমের উদ্বৃত্ত বিনিয়োগের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে এক ক্ষেত্র থেকে অন্য ক্ষেত্রে (শ্রমনিবিড় থেকে পুঁজিনিবিড় উৎপাদনক্ষেত্রে, কৃষি থেকে শিল্পে, উন্নয়ণশীল থেকে উন্নত কিংবা অনুন্নত থেকে উন্নয়ণশীল ও উন্নত অর্থনৈতিক অঞ্চলে) স্থানান্তরিত হয়, পণ্য বিনিময়ের মাপকাঠি ‘মূল্য’ থেকে ‘দাম’-এ রূপান্তরের এক জটিল নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে। এবং দুই, শ্রমিকের শ্রমশক্তি, যা নিজে একটি পণ্য, তারও আজ বিনিময় হচ্ছে মূল্যের বদলে দামেই, যা ঠিক হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ধরণের শ্রমের বিশিষ্টতা অর্জনে ব্যয়িত পুঁজি ও সময়ের ভিত্তিতে। এটাই আজকের শ্রমদাতাদের ভাগ করেছে দুই অংশে— একদিকে, সংখ্যায় নগন্য তথাকথিত স্কিল্ড (?) শ্রমিক/কর্মচারী, যাঁদের উপার্যন গগনচুম্বী, আর অন্যদিকে অগুণতি নুন আনতে পান্তা ফুরানো “আনস্কিল্ড” দেগে দেওয়া মজুর/শ্রমজীবি। সংগঠিত ক্ষেত্র হোক বা অসংগঠিত, প্রথম বর্গের সিংহভাগটাই নিযুক্ত আছে “কুলীন” শ্রমিক হিসেবে, আর অন্যদিকে এই দুই ক্ষেত্রেরই অগুনতি ইনফর্মাল শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত আছেন শ্রমিক বা শ্রমজীবিদের “শূদ্র” অংশটি।
দ্বিতীয়ত, পাব্লিক সেক্টর বা সরকারী ক্ষেত্র সম্পর্কে মূলধারার কমিউনিষ্ট-নাম্নী পার্টিগুলি, একটি বিকৃত তথ্য পেশ ক’রে থাকে। ভাবখানা এমন যেন ওগুলি কোনও বিশেষ ও পবিত্র অর্থনীতিতে চলে, ধনতন্ত্রের পুতিগন্ধ তাতে নেই! রাষ্ট্রটা বুর্জোয়া, তাই পাব্লিক হোক বা প্রাইভেট, সব সেক্টরেই যে পুঁজিবাদটাই চলতে বাধ্য, সে সত্যকে এঁরা ‘উপরওয়ালার’ ইচ্ছেয় চেপে দেন। মজা হলো সেই উপরওয়ালাদের-ই দেওয়া তথ্য কিন্তু সোচ্চারে প্রমাণ করে যে বেসরকারী উৎপাদনসংস্থা বা শিল্পক্ষেত্রে যা ঘটছে, সরকারী বা পাব্লিক সেক্টরেও ঘটছে তারই অনুরূপে, এমনকি বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে আরও দ্রুত গতিতে ! ভারত সরকারের ডিপার্ট্মেন্ট অব পাব্লিক এন্টারপ্রাইজের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে এদেশে কেন্দ্র-সরকারী ক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কন্ট্র্যাকচুয়াল ও ইনফর্মাল শ্রমিক/ কর্মচারীর সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ৮৬% ও ১৭৮%, যেখানে ওই একই সময়ে কেন্দ্রসরকারী সংস্থাগুলিতে স্থায়ী কর্মসংস্থান বা ফর্মাল এমপ্লয়মেন্ট কমেছে ২৫% [৬]। কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে দেশের সরকারী সংস্থাগুলিতে ২০০৪ থেকে ২০১৯-র মধ্যে দেড় দশকে ইনফর্মাল শ্রমশক্তির বৃদ্ধি (মোট শ্রমশক্তির নিরিখে) একটি স্বাভাবিক প্রবণতায় গিয়ে ঠেকেছে। নীচে সেই তথ্য তুলে ধরা হলোঃ
চিত্র ২: ভারতে পাব্লিক সেক্টরে শ্রমশক্তির ইনফর্মালিটির হার
সূত্রঃ পিএলএফএস [৭]
পাব্লিক সেক্টরে রাজ্যে ও কেন্দ্রে সরকারী চাকরীর নামে চুরি-জোচ্চুরি, ঘুষখোরি, স্ক্যাম, আদালত, পুলিশ, সিবিআই— সবমিলিয়ে যে ‘কেওটিক কেচ্ছা’ প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়, তা-ই এইসব তথ্যের বাস্তবতাকে হাতেনাতে তুলে ধরে।
তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদের যুগ, যা কিনা যুদ্ধবাজীরই যুগ, তার নয়াউদারবাদী দশায় যুদ্ধ নিজেই পরিণত হয়েছে একটি অর্থনীতিতে। যুদ্ধাস্ত্র নির্মান থেকে যুদ্ধের জিগির ও তার ফলপ্রসু হওয়ার সম্ভাবনা সবকিছু নিয়েই শেয়ার বাজারের ফাটকাখেলার এই যুগে, তাই স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধও আত্মপ্রকাশ করে একটি উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে, ইণ্ডাস্ট্রি হিসেবে— যুদ্ধাস্ত্র নির্মান, যুদ্ধজিগির, এবং এমনকি খোদ যুদ্ধই যার অন্যতম প্রধান উৎপন্ন! ফলে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগকে আর দেখা চলেনা নিছকই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের একটি সংস্থা হিসেবে; বরং, এটি আত্মপ্রকাশ করছে ক্রমশই নয়াউদারবাদী ব্যবস্থার আওতায় ওয়ার-ইণ্ডাস্ট্রির একটি সিস্টার কন্সার্নের মত, যুদ্ধের যাবতীয় ক্যম্পেইন, পরিকল্পনা এবং বৌদ্ধিক ও মানবসম্পদ জনিত উপাদান যোগানের একটি সংস্থা রূপে। ‘প্রতিরক্ষা’ যে একটি ইণ্ডাস্ট্রিই মাত্র, তার অন্যতম একটি প্রমাণ আমরা দেখতে পাবো এতে বিনিয়োগের ধরণ থেকে। ২০০১ সাল থেকেই এদেশে প্রতিরক্ষায় ১০০% বিদেশী বিনিয়োগের রাস্তা সাফ করা হয় [৮], এবং ২০২০ সাল থেকে সেই বিনিয়োগের ৭৪% অব্দি অটোম্যাটিক রুটে করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা তার আগে পর্যন্ত ছিলো ৪৯% [৯]।
চতুর্থত, প্রতিরক্ষা খাতে যেখানে প্রতিবছর গড়ে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজারেরও বেশী ক’রে সেনার নিয়োগ হয়ে আসছে (চিত্রঃ৩), সেখানেই ২০১৯-এর পর থেকে গত দু বছরে নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ!
চিত্র ৩: পাঁচ বছরে ভারতীয় সেনায় নিয়োগের চিত্র
সূত্রঃ ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক [১০]
অথচ, ২০১১ থেকে ২০২০-এর মধ্যে প্রতিরক্ষাখাতে একবগগাভাবে খরচ বেড়েছে ২.৩ থেকে ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা (চিত্রঃ৪)।
চিত্রঃ সামরিক খাতে ব্যয় (বর্তমান ইউএস ডলারে)
সূত্রঃ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক
দেশের পাব্লিক সেক্টরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ফর্মাল শ্রমশক্তি দখল ক’রে রেখেছে যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র [১২], সেখানেই গত দু’বছর নিয়োগ বন্ধ রেখে, অগ্নিপথ স্কীমের আওতায় বিপুল কম মাইনে ও কোনওপ্রকার সামাজিক সুরক্ষা-বিহীন কন্ট্র্যাকচুয়াল নিয়োগ আসলে পুঁজিবাদের এক সহজাত প্রবৃত্তিকে তুলে ধরে— যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপায়-উপকরণে খরচ বাড়ানো ও একইসাথে শ্রমশক্তির পিছনে খরচ কমানোর ঐতিহাসিক প্রবণতা। প্রসঙ্গতঃ, মার্কস আজ থেকে দেড়শ বছর আগেই একে “অরগ্যানিক কম্পোজিশন অব ক্যাপিটাল” বলে চিহ্নিত করে তার ক্রমে বেড়ে চলার গতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু, প্রতিরক্ষাক্ষেত্রের এই আচমকা নড়েচড়ে বসা, ‘বিনিয়োগ’ বাড়ানো, অথচ ‘নিয়োগ’-এর কমতি, আসলে সাম্প্রতীক সময়ে এই ক্ষেত্রের ব্যপক বিস্তারের সম্ভাবনাকে সূচিত করে। কয়েকমাস আগে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থেকে এইমুহুর্তে চীন-তাইওয়ান সংঘাত, যাকে শিরোমণি করে G-7-এর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কুক্কুর-নিনাদ, আর অন্যদিকে ভারতীয় বাজারের গগণচুম্বী ইনফ্লেশন, ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলে তো বটেই, এমনকি বিশ্ব-অর্থনীতির প্রধান প্রধান স্টেকহোল্ডারদের মধ্যেও আগামীদিনে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার যে ইঙ্গিত দেয়, অগ্নীপথ স্কীম আসলে তার একাধিক দ্যোতকের একটি।
উপরের এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নয়াউদারবাদের আওতায় একদিকে বিপুল বেতনের স্বল্প সংখ্যক উদ্বৃত্তভোগী শ্রমিক/কর্মচারী আর অন্যদিকে বিপুল সংখ্যার নামমাত্র মজুরীর কন্ট্র্যাকচুয়াল ও ইনফর্মাল শ্রমিকের যে প্রবণতা গোটা দুনিয়াজুড়ে সমস্ত উৎপাদনক্ষেত্রেই দেখা দিয়েছে, সরকারী উৎপাদনক্ষেত্রগুলিও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। প্রতিরক্ষা-মন্ত্রক, যাকে দেখানো হয় এক মহান দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী সুড়সুড়ির স্তম্ভ হিসেবে, সেটিও আজ নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে একটি উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবেই, ওই একই নিয়ম মেনেই। আর তাই-ই তার দরকার বিপুল সংখ্যার স্বস্তার ‘কন্ট্র্যাকচুয়াল লেবার’, যার গাল ভরা নাম হয়েছে ‘অগ্নিবীর’ ¾ ঠিক যেন “কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন”। পাশপাশি, এটা অত্যন্ত গুরুতর যে, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিরক্ষা বিভাগ জাতীয়-সুরক্ষার সাথে যুক্ত, এবং তাই আবহমানকাল ধরেই যেখানে নিয়োগ চলেছে কড়া নজরদারি আর অত্যন্ত ‘যোগ্যতার’ মাপকাঠিতে (অন্তত বুর্জোয়া ব্যবস্থা সাধারণ-অর্থে যেভাবে যোগ্যতা মাপে), সেখানেই এমন ঢালাও নিয়োগ অদূর ভবিষ্যতে এই সেক্টরের ব্যপক বিকাশেরই ইঙ্গিত দেয়। ফলে, অতি শীঘ্রই যে যুদ্ধপরিস্থিতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে চরম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে চলেছে, তা তো আজ সতঃস্পষ্ট!
অতঃপর বিরোধীতার ‘বুলি’-আনো!
‘শূণ্য’ অথবা ‘এক’, ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’, ‘বিজেপি’ অথবা ‘তৃণমূল’— এই বাইনারী লজিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠিত নাম হলো “বুলিয়ান লজিক” ¾ চলতি কথায় “ডিজিটাল”। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরেও আসলে চলছে এই ‘বুলিয়ানীকরণ’ তথা ‘ডিজিটাল’ দেশ গঠন ! গোটা দেশের যেকোনও সরকারী চাকুরিক্ষেত্রে নিয়োগের চিত্র যে নিতান্তই করুন, তা বলার অপেক্ষাই রাখেনা। ভারতে, যেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রের মোট নিযুক্তির পরিমান দেশের মোট শ্রমশক্তির ১০%-এরও কম, সেখানে এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রসরকারী সংস্থায় নিযুক্ত শ্রমশক্তির পরিমান ১৯৯৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রের মোট শ্রমশক্তির ১২.৪% থেকে ৮%-এ নেমেছে একবগ্গাভাবে! এমতাবস্থায় প্রশ্ন ওঠে যে, এই পরিমাণ বেকারত্বের জমানায় স্রেফ প্রতিরক্ষাতেই কনট্র্যাকচুয়াল বিনিয়োগ নিয়ে কেনো আচমকা এত বিক্ষোভ-বিদ্রোহ, তাও আবার শাসকদলেরই গড় যে-সব রাজ্য, সেখানেই! প্রশ্ন ওঠে, শান্তিপূর্ণভাবেই সংগঠিত কৃষক-আন্দোলনকে ভেঙ্গে চুরমার করতে যে কর্পোরেট-তোষী বিজেপি সরকার পুলিশ-মিলিটারি-মিডিয়া কোনও কসুর বাকী রাখলোনা, দিল্লীতে সংগঠিত এন-আর-সি ও সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যে বিজেপি সবরকম ঘৃণ্য অত্যাচার চালালো, আন্দোলনকারীদের মরতে অব্দি হলো, সেই বিজেপি খোদ যোগীর উত্তরপ্রদেশে ট্রেন-জ্বালানোর পরেও বিক্ষোভকারীদের নিয়ে বিশেষ কিছুই করলো না! কেনো? মোট কথা, এই চরম “আগুনখোর বিদ্রোহ”-এ যে কোথাও কোনও যুবদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আদৌ ছিল না, পুরোটাই স্পন্সর্ড্, তা বলাই বাহুল্য।
এইখানেই রাজনীতির আসল খেলাটা খেলে খেলছে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া”-র “বুলিয়ান লজিক”! লোকসভা ভোটের আর বাকী মাত্র ২২ মাস। তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিয়েই ’২৪-এর মহাসংগ্রামের প্রাক-প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সংগ্রামটা হবে কার সাথে কার? বিজেপি বনাম কে? দেশে বিজেপির বিরোধী ব’লে পরিচিত আ-পদ-নখ-শির দুর্নীতিগ্রস্ত, দূর্বৃত্তিপ্রবণ, সাম্প্রদায়িক ও নয়াউদারবাদের প্রত্যক্ষ কারিগর তৃণমূল কংগ্রেস থেকে জাতীয় কংগ্রেস, মুলায়ম থেকে এম.কে স্তালিন, লালু থেকে চন্দ্রশেখর ¾ সবাই ¾ কোনও একটিও দল কি আছে যাদের বিজেপির সাথে কোনও পলিসিগত ফারাক আছে ! বা যারা বিজেপির সাথে নেতা বিনিময় চুক্তিতে নেই ! বা (এক-দুজন বাদে) বিজেপির সাথে জোটে কখনও ছিল না ! অন্যদিকে, মেইনস্ট্রীম বামেরা, এমনকি “জংলী ও জঙ্গি” নামধারী বামেরাও, তাঁদের সমস্ত নীতি-আদর্শ ও রাজনৈতিক সততাকে ত্যাগ ক’রে দক্ষিনী-প্রভুদের শ্রীচরণেই স্বর্গসন্ধান করছেন তদের সাথে সবরকমের জোটপর্ব সেরে। ফলে, জনগণের অ্যাজেণ্ডায় সংগঠিত আন্দোলন আজ ক্রমেই হয়ে উঠছে একটি অলীক কল্পনা। আর যেখানেও বা তা হচ্ছে, তার পিছনে সংগঠিত কোনও পপুলার পার্টি থাকছে না, বরং থাকছে অসংখ্য ছোট ছোট সংগঠন, পার্টি ও রাজনৈতিক শক্তি, যেমনটা সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে দেখা গেছে। এই যে আন্দোলনের আদর্শগত নেতৃত্বের অভাব, তা-ই জন্ম দিচ্ছে একটা একপাক্ষিক রাজনীতির, যাতে বিরোধী ব’লে কিছুই নেই। ‘বিরোধিতা’ আসলে আজ ‘সহায়তা’। কিন্তু হায় অলঙ্ঘনীয় নিয়তি ! যখন সবাই কর্পোরেটের ভৃত্য, ঠিক তখনই এবং ঠিক তার ফলেই, ভয়ঙ্কর এক ফাঁপরে পড়ে এইসবকটা দলকে চালায় যে কর্পোরেট শিবির, তারা নিজেরাই। কেননা, নির্বাচনের নামে শেয়ারের বাজারে যে বিশাল অঙ্কের ফাটকা খেলা হয়, তার মানেটাই থাকে তখন, যদি কোনও বিরোধের জায়গা থাকে, বিরোধী শক্তি থাকে, সম্ভাবনার দোলাচল থাকে। ডেরিভেটিভ ট্রেডিং-এর এই খেলায় “বুলি” লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে পোরা যাবে তখনই যদি জেতা আর হারা নিয়ে একটা সম্ভাবনার খেলা থাকে! যাতে বুলিয়ান-এর “শূন্য” আর “এক” দুয়েই টাকা ঢালার অপশন থাকে ! সেজন্যই এইসবকটা দলকে বিজেপির মেকি বিরোধীতার নাটক করতে হয়, তাদের তাদের কর্পোরেট-গোষ্ঠীর স্বার্থে। এটাই আসল গোটা রাজনীতিটাকে ‘বিজেপি’ বনাম ‘নো ভোট টু বিজেপি’-তে পোলারাইজ করার অর্থনৈতিক প্রকল্প।
এমতাবস্থায়, প্রয়োজনে মেকি আন্দোলনের নির্মানও করা জরুরী হয়ে পড়ে। অগ্নিপথ নিয়ে জ্বালাময়ী আন্দোলন ক’রে ট্রেন পুড়িয়ে, দুদিনে সবটা ঠাণ্ডা হয়ে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সব ‘বিরোধীর’ এককাট্টা হয়ে রামধনু জোট ও তার প্রার্থী দেওয়া এই ‘ডিজিটাল’ রাজনীতিরই প্রতিভূ। বিজেপির এদেশে প্রধান USP দুটোই— “হিন্দুত্ব” আর “দেশভক্তি”। কিন্তু রামমন্দির বানিয়ে ফেলার পর, কিংবা বাবরিতে ক্লিঞ্চিট পাওয়ার পর, হিন্দুত্ব দিয়ে খুব বেশী এগোনোর রাস্তা তার হাতে নেই। ফলে, কর্পোরেটদের জন্য তুরুপের তাস এখন দেশভক্তি। একদিকে বিজেপি দাবী জানাবে যে অসংখ্য সাধারণ যুবককে দেশভক্তের ভুমিকায় টেনে আনতেই তাদের আনা এই অগ্নিপথ স্কীম। অন্যদিকে, অবিজেপিরা বলবে, এই স্কীম আসলে দেশের সুরক্ষাকে লঘু ক’রে দেবে, যা আসলে দেশদ্রোহের কাজ। ফলে, ‘সাচ্চা দেশভক্ত কৌন’—এই হবে ’২৪-এর নির্বাচনের ফাটকার অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টরগুলির একটা। মাঝখান থেকে হাওয়া হয়ে যাবে এই স্কীমের আড়ালে ইনফর্মালাইজেশনের ব্যপক ষড়যন্ত্র, আসন্ন যুদ্ধপরিস্থিতির সঙ্কট, চরম বেকারত্ব আর গগণচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির কথা।
তাহলে উপায়?
গোটা আলোচনাটাকে চুম্বক করা যায় প্রধানত তিনটি সিদ্ধান্তেঃ এক, ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ ঠিক আর পাঁচটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরেরই মতো, যা আজকের নয়াউদারবাদী পুঁজির কেন্দ্রীয় প্রবণতাকে ছেড়ে চলতে পারেনা কখোনোই। অগ্নিপথ স্কীম মারফৎ ব্যপক ইনফর্মালাইজেশন ভারতীয় ইউনিয়নের এই নয়াউদারবাদী প্রবণতারই দ্যোতক মাত্র। দুই, প্রতিরক্ষায় এই পাইকারী হারে নিয়োগ আর গোটা দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধের ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে ভারতেরও যুদ্ধবাজীতে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এবং তিন, এই অগ্নিপথকে কেন্দ্র ক’রে দেশের কয়েক জায়গায় গজিয়ে ওঠা সরকার-বিরোধী আন্দোলন আসলে দেশভক্তি বা দেশপ্রেমের অ্যাজেণ্ডায় গোটা রাজনীতিকে বিজেপি বনাম ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র বাইনারীতে ভেঙ্গে দেওয়ার একটি পরিকল্পিত খেলা, যা আখেরে নির্বাচনী অর্থনীতিতে শেয়ার বাজারের ফাটকায় লাভের গুড় তুলে দেবে কর্পোরেটদের হাতে, আর রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করবে নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সংগঠিত লড়াইকে।
এমতাবস্থায়, দেশের তামাম মেহনতী জনতার জন্য একমাত্র পথ হলো এই ‘বিজেপি বনাম নো-বিজেপি’ ডিজিটাল রাজনীতিকে ভেঙ্গে নয়াউদারবাদ বনাম সাধারণ মেহনতী জনগণের পোলারাইজেশনকে শক্তিশালী করা। সুস্থ কর্মসংস্থান থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ জনগণের মৌলিক অধিকার দিতে অক্ষম এই নয়াউদারবাদী রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বিজেপি-ই আসুক বা তথাকথিত অবিজেপি কোনও শক্তি, মেহনতী জনগণের দুর্দশার রোজনামচায় তার কোনও প্রভাবই পড়বেনা। দেশের মেহনতী জনতাকে তাই তার হকের অধিকারের জন্য সবার আগে গড়ে তুলতে হবে এই ব্যবস্থাকে, নয়াউদারবাদকে খতম করতে চায় এমন এক বাহিনী, যে একদিকে তার দৈনন্দিন অধিকার রক্ষার সংগ্রামে যেমন নেতৃত্ব দেবে, তেমনই অন্যদিকে তার চূড়ান্ত মুক্তির লড়াইকেও দ্রুতই বলিষ্ঠ ক’রে তুলবে।
তথ্যসূত্রঃ
[৩] https://www.ilo.org/wcmsp5/groups/public/—ed_emp/—ifp_skills/documents/publication/wcms_734503.pdf
[৪] https://www.imf.org/-/media/Files/Conferences/2019/7th-statistics-forum/session-ii-murthy.ashx
[৫] https://www.ilo.org/wcmsp5/groups/public/—dgreports/—dcomm/documents/briefingnote/wcms_743146.pdf
[৬] https://dpe.gov.in/publication/pe-survey/pe-survey-report
[৭] Srivastava, R. (2019). Emerging dynamics of labour market inequality in India: Migration, informality, segmentation and social discrimination. The Indian Journal of Labour Economics, 62(2), 147-171.
[৮] https://pib.gov.in/PressReleaseIframePage.aspx?PRID=1739049
[৯] https://dpiit.gov.in/sites/default/files/pn4-2020_0.PDF
[১০]https://prsindia.org/policy/vital-stats/overview-central-government-employees
[১১]https://data.worldbank.org/indicator/MS.MIL.XPND.CD?locations=IN
[১২] https://prsindia.org/policy/vital-stats/overview-central-government-employees