cover image

নতুন করোনা ভাইরাস-এর থেকে সংঘটিত কোভিড-১৯ রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারির আকার ধারণ করায় আধুনিক বিজ্ঞান সত্যিই ঠিক কতটা এগোতে পেরেছে এই প্রশ্নটি কিন্তু নতুন করে সকলের মনেই হাজির হয়েছে। সাথে “বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ” জাতীয় এক যুগ আগের ‘স্কুল-লেভেল-ডিবেট’গুলিও আবার বিচ্ছিন্ন ভাবে দানা বাঁধছে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী ‘বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা’ (বা ‘হু’)-এর নির্দেশিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছেন এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে, পুলিশ-প্রশাসন ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা তার স্বার্থে যেভাবে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, এবং সর্বোপরি সমস্ত দেশের অধিকাংশ (প্রায় সকল) জনগণ যেভাবে এসব লাগু করতে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তা যে আমাদের যুগে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা, তা স্বীকার করতেই হবে।

ঠিক কী কী ভাবে এগুলি ঘটলো ? চীনদেশের ইউহান প্রদেশে প্রথম রোগটি ধরা পড়ার পর বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জাজান যে এর আগের ‘সার্স’, ‘মার্স’ বা বসন্তকালের করোনা ভাইরাসগুলির থেকে একটু পৃথক এই নতুন করোনা ভাইরাসটি, যার সংক্রমণের ক্ষমতা অনেক বেশি, কিন্তু মারণাত্মক ক্ষমতা বেশ খানিকটা কম, যদিও বয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বেশি। ‘হু’ জানায় যে কাশি বা হাঁচির সময় ‘ড্রপলেট’-এর মাধ্যমে এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হয়, তাই ‘সার্জিকাল’ বা ‘এন-৯৫’ মাস্ক পরলে এই সংক্রমণ আটকানো যাবে। একই সাথে মানুষে মানুষে মেলামেশা বন্ধ করা দরকার। আর সেই ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি (আমাদের দেশেরও) চালু করল ‘লক-ডাউন’, বাধ্যতামূলক করল ‘মাস্ক’-এর ব্যবহার এবং মিডিয়া প্রচার করল ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর বানী। তার পর থেকে এই সময়ে গোটা দুনিয়ায় করোনার সংক্রমণ, যা ধরা পড়েছে, ৪০ লক্ষের বেশি এবং মৃতের সংখ্যা ঘোষিত ভাবে প্রায় ৩ লক্ষ। সংক্রমণ ও মৃত্যু দুইই আজও বেড়েই চলেছে। এখনও করোনার ‘ওষুধ’ আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু মিডিয়া মারফত প্রচার হয়ে চলেছে তার জন্য ‘ভ্যাকসিন’ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা, ‘ওষুধ’-এর নয়।

এবারে আসা যাক কতগুলি প্রশ্নে।

এক, ‘হু’-এর তথ্য অনুযায়ী, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৯-এ চিনের ন্যাশনাল হেল্‌থ্‌ কমিশনে এই অজানা নিউমোনিয়াটি (মাত্র ২৭ টি কেস, ৭ টি সিরিয়াস) রিপোর্ট করা হয়, এবং ১২ দিনের মধ্যে (১২ই জানুয়ারি, ২০২০) বিজ্ঞানীরা এই নতুন করোনা ভাইরাসের গোটা জিনগত তথ্য (জিনোম সিকোয়েন্স) ‘হু’-এর হাতে তুলে দেন। (বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি, কিন্তু ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা নিজেই একটি প্রশ্ন, যদিও সে প্রশ্ন আমরা এখানে রাখছি না)। এর পর ২০শে জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ২৪শে জানুয়ারি ফ্রান্সে, ২৮শে জানুয়ারি জার্মানিতে, ২৯শে জানুয়ারি ইতালিতে, ৩০শে জানুয়ারি ভারতে এবং ৩১শে জানুয়ারি রাশিয়া, স্পেন ও ইউকে-তে এই রোগ ধরা পড়ে (যে দেশগুলিতে এখন রোগীর সংখ্যা ব্যাপক আকার নিয়েছে, তাদের কথাই বলা হল)। যেহেতু মানুষে মানুষেই সংক্রমণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে কোনও সংক্রমণের তেমন খবরই নেই ! জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কি কোনও দেশের মানুষ কোনও দেশে যাননি? কিন্তু দেখা গেল হটাতই সংক্রমণ বাড়ছে বলে ঘোষণা করে (কোনও নির্দিষ্ট তথ্য ছাড়াই) মার্চের তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহ (অর্থাৎ ফিনান্সিয়াল ইয়ার এন্ডিং)-এ এসে এরা সবাই একের পর এক লেগে গেল লক্‌-ডাউন করতে ! নতুন ভাইরাসটি কি তবে এই সব দেশে (যারা প্রত্যেকেই এতদিন গভীর অর্থনৈতিক সংকটে ডুবে যাচ্ছিল) ফিনান্সিয়াল ইয়ার এন্ডিং-এই সংক্রমিত হয় ? ভাইরাসটি অর্থনীতিতে বেশ পাকা মনে হয় ! দেড় মাস যেতে না যেতেই এই নতুন অর্থবর্ষে এখন আবার “এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে” ব’লে লক-ডাউন তোলবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এরা সবাই !

দুই, সংক্রমণ চূড়ায় কখন উঠবে তাতেও কি ভাইরাসটি রাষ্ট্রনেতাদের পারমিশন মেনে চলছে ? ভারি রাষ্ট্রপন্থী ও আজ্ঞাবহ তো এই ভাইরাস ! প্রশ্ন হল, আজ যতটা সংক্রমণ হয়েছে বলা হচ্ছে, তার সত্যতা কতটুকু ? উদাহরণস্বরূপ, এখন অব্দি ভারতে ০.১%-এর টেস্ট করা হয়েছে, ১% বা ১০%-এর টেস্ট করা হলেও একই সংখ্যক রোগী হতেন কি ? আজ যত করোনা আক্রান্ত, ফেব্রুয়ারিতেই যে তা বা তার থেকে বেশি ছিল না তার প্রমাণ কী ? তখন তো টেস্ট করাই হয়নি ! বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য আমরা নিচে এদের কয়েকটি দেশের (যাদের তথ্য পাওয়া গেছে) টেস্টিং ও আক্রান্তের হার লেখচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরলাম (তথ্যসূত্র : https://ourworldindata.org/)।

দেখা যাচ্ছে যে এই সবকটি দেশেই টেস্টিং যে ভাবে বাড়ানো হয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা ঠিক সেই ধারা অনুসরণ করেই এগিয়েছে এবং যত বেশি টেস্ট করা হয়েছে, যেমন প্রতি ১০ লক্ষে ১০ হাজার (অর্থাৎ ১%) বা তার বেশি, ততোই টেস্টিং পিছু আক্রান্তের হার নির্দিষ্ট হতে থেকেছে। উদাহরণস্বরূপ, (চিত্র (d)) ফ্রান্সে যখন যখন প্রতি ১০ লক্ষে ১ হাজারেরও কম টেস্টিং করা হচ্ছিল (মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত), তখন ১০০-৫০০ টেস্ট পিছু একজন করে রোগী ধরা পরছিল; কিন্তু যখন টেস্টিং-এর হার বাড়িয়ে প্রতি ১০ লক্ষে ১০ হাজারের কাছে আনা হল, তখন প্রতি ৫ টি টেস্টে একজনের রোগ ধরা পড়েছে, এবং এই হার স্থির হয়ে গেছে (স্যাচুরেট করেছে)। সব কটি দেশের ক্ষেত্রেই (চিত্র (a), (b) ও (c)) এই একই ঘটনা লক্ষ করা যাবে। অনুরূপ ভাবে ভারতের চিত্রটিও নিচে তুলে ধরা হল। ভারতে টেস্টিং-এর হার এখনও প্রতি ১০ লক্ষে ১ হাজারের কাছাকাছি এবং প্রতি ২৫ টি টেস্ট পিছু ১ জন রোগী ধরা পড়ছে। প্রথমত, যদি একে ‘স্যাচুরেশন’ বলেই ধরা হয়, তবে ১ হাজারের জায়গায় ১০ হাজার টেস্ট করালে ৫০ হাজার আক্রান্তের তথ্যটি আজকের তারিখেই ৫ লক্ষ হতে পারতো; দ্বিতীয়ত টেস্টিং হার মাত্র ১ হাজার হওয়ায় এই ২৫ সংখ্যাটি ‘স্যাচুরেশন’ নাও হতে পারে যা ১০ হাজার টেস্টিং হারের জন্য অন্য দেশগুলির মতো আরও কমে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে আক্রান্তের সংখ্যা আরও ভয়ানক বেশি হতে পারে।

অথচ টেস্টিং হারের কথা ব্যাতিরেকেই দাবী করা হচ্ছে আক্রান্তের হার নাকি ‘কন্টেনমেন্ট’-এর মাধ্যমে পালটানো যাবে, অথচ যা আজ অব্দি কোথাও হয়নি। ভারতের ক্ষেত্রে টেস্টের হার এতই কম যে এর ভিত্তিতে কিছুই অনুমান করা বিজ্ঞানসম্মত নয়, এবং কেবল এটুকুই বলা যায় যে, “আক্রান্তের হার ২৪ ঘণ্টায় এত’শ” জাতীয় তথ্য আর কিছুই না, কেবল অত’শ মাত্র টেস্ট করা হয়েছে বলেই। সুতরাং এখনও যে অমুক মাসের তসুক সপ্তাহে “পিক উঠবে” বলে দাবী করা হচ্ছে, তার কোনও ভিত্তিই নেই। প্রকৃত ‘পিক’ ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েও থাকতে পারে বা অন্য কোনও সময়েও উঠতে পারে, কিন্তু এমন টেস্টিং হার থাকলে কেবল তা হবে আমার-আপনার এবং চিকিৎসকদের অজান্তেই।

তিন, রোগটি সংক্রমণ হচ্ছে কাশি-হাঁচির সময় ‘ড্রপলেট’-এর মাধ্যমে, এই মর্মে ‘হু’ পাঁচটি বিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশিত ‘পেপার’-কে রেফার করেছে। ঘটনা হল এর একটিতেও এমন তো কিছু দেখানো হয়ইনি, উপরন্তু এর একটিতেও ‘ড্রপলেট’ শব্দটিও পর্যন্ত নেই ! ‘হু’-কে এই মিথ্যাচার করতে হল কেন ? ‘ড্রপলেট’ নাকি ‘এরোসল’ (বাতাসে ভাসমান আরও হালকা জলকণা)-এর মাধ্যমে, কিভাবে হচ্ছে এই সংক্রমণ তা নিয়ে চলল বিজ্ঞানীদের লড়াই, আর পিছনে চলল ‘সার্জিকাল’/‘এন-৯৫’ মাস্ক-এর কোম্পানিগুলির শেয়ার হোল্ডারদের জুয়াচুরি। একদিকে ‘হু’ বলল সাধারণ মানুষের এমন মাস্ক পরার দরকার নেই, আর অন্যদিকে আমেরিকার সিডিসি বলল কাপড়ের মাস্কও চলবে সাধারনের জন্য; আর তার পিছনে ছুটল আমদের মতো কত দেশ ! আমেরিকা বলে কথা ! ওরা নিজের দেশের লোককে বাঁচাতে না পারলেও ওদের কথাই মেনে চল। অন্তত এটুকু তো পরিষ্কার যে এর ফলেই ‘হানিওয়েল’ বা ‘3M’-এর মতো ‘সারজিকাল মাস্ক’-এর একচেটিয়া থেকে শুরু করে কাপড়ের মাস্কের ব্যবসারও রমরমা চলল গোটা দুনিয়া জুড়ে। অথচ, এর আগের করোনা ভাইরাসগুলির থেকে এই নতুন ভাইরাসটির সংক্রমণের হার যে ব্যাপক বেশি, গুণগত ভাবেই আলাদা, তা তো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল শুরুতেই ! গুণগত ভাবে আলাদা বিষয়কে একই তত্ত্ব দিয়ে জোর করে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে যাওয়া কি বিজ্ঞানের কাজ ? আলদা আর কী কী বিষয় এর পিছনে থাকতে পারে তা খোঁজাই হল না ? (কিছু বিজ্ঞানী সে প্রশ্ন তুলেছিলেন কিন্তু বিশেষ পাত্তা পাননি)। পরিণাম ? এত লক-ডাউন আর মাস্ক ফেরি করেও লক্ষাধিক মৃত্যু (যদিও নির্লজ্জ ইতরের মতো নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে এঁরা বলবেন, ওইটা না করলে আরও মরতো) ! সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় একটি ‘পেপার’-এ কিছু বিজ্ঞানী (Yuan Liu ও অন্যান্য) ভীত কণ্ঠে (লেখার ধরণটা তেমনই) প্রকাশ করেছেন যে, যে ‘এরোসল’-এ ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে পারে তা এমনকি ১০ ন্যানোমিটারও হতে পারে (এন-৯৫ কয়েকশো ন্যানোমিটার পর্যন্ত সামান্য কিছু কণা আটকাতে পারে)। যা তাঁরা বলে ওঠার সাহস দেখাতে পারেননি, তা হল কোনও মাস্কই যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে তো সেখানে যে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তা এমনকি রুমালও হতে পারে, বেড়ালও হতে পারে, চন্দ্রবিন্দুও হতে পারে ! উল্লেখ্য, যেখানে ভাইরাসটি প্লাস্টিকের ওপর তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, সেখানে এই মাস্ক এবং লক-ডাউন (যার ফলে সব কিছুই প্লাস্টিকের কভারে কেনাবেচা চলছে) কী কী ফল দিতে পারে, তার হিসাবে করা হয়েছে কি ? অন্যদিকে মানুষের দেহে কোন প্রাণী থেকে রোগটি এসেছে (বাদুড় ও মানুষের মধ্যবর্তী স্তরে) তা আজও অজানা; যদি সেই প্রাণীটি বিশ্বায়িত ব্যবসার সাথে যুক্ত কিছু হয়ে থাকে, তবে তো সেও সংক্রমণের অন্যতম কারণ হতে পারে !

চার, এই নতুন করোনা ভাইরাসজাত রোগটির প্রকোপ যেখানে এখনও রোজ বেড়েই চলেছে, এবং আজ পর্যন্ত এর ওষুধ যেখানে আবিষ্কৃত হয়নি, সেখানে মিডিয়ায় প্রতিদিন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবীটির উদ্দেশ্য কী ? যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা জানি না এবং রোজ আরও আরও সংক্রমণের খবর আসছে, সেখানে ওষুধ আবিষ্কারের বদলে ভ্যাকসিন তৈরির প্রসঙ্গ আগে আসে কী করে ? তবে কি ওষুধ আবিষ্কারের আশা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে ? যাদের রোগ হয়েছে তারা চুলোয় যাক ! না কি ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, কেবল বাজারে আসবার আগে বিজ্ঞাপন চলছে ? পৃথিবীর সকল ভ্যাকসিন-এর একচেটিয়া ব্যবসা যে বিল গেটস-এর মতো মুষ্টিমেয় কর্পোরেট মালিকের দখলে, তা আর কার না জানা ? বিপরীতে ওষুধ যতক্ষণ আবিষ্কার হয়নি, ততোক্ষণ মানুষের প্রকৃত হাতিয়ার তো তার নিজের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা ! তার জন্য প্রয়োজন তো পেট ভরে দু’বেলা পুষ্টিকর খাদ্য, ভিটামিন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ইত্যাদি; লক-ডাউনে মানুষের এসব জোটা সম্ভব !

পাঁচ, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লুক মন্টেগ্নার, যিনি এইচ.আই.ভি. (এইডস-এর জন্য দায়ী ভাইরাস)-র আবিষ্কর্তা, তিনি যখন দাবী করছেন ভাইরাসটি ল্যাবরেটরিতে বানানো, তখন তা বিরুদ্ধ বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করবার বদলে তাকে চেপে দেওয়া হচ্ছে কেন ? ‘হু’-এর পরিচালনায় যে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চিনের (সবচেয়ে নতুন) মতো একাধিক BSL-4 ল্যাবরেটরিতে দীর্ঘদিন ধরেই এমন ভাইরাস (করোনা সহ অন্যান্য) নিয়ে গবেষণা চলছে, তা তো অজানা নয়। (সংক্রমণের ‘ড্রপলেট’ তত্ত্বের রেফারেন্স-এর মতো) মিথ্যাচার থেকে শুরু করে এই ঘটনা তো ‘হু’-কে সম্পূর্ণ প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে !

এই প্রশ্নগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা কোনও মত রাখছি না। এই সকল প্রশ্নের উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না, সময় হয়ত উত্তর বয়ে আনবে। কিন্তু যে কারণে প্রশ্নগুলি করা, তা আদতে করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নয়; বরং এর প্রাদুর্ভাব আমাদের সমাজের বিজ্ঞানচেতনা সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলি তুলে এনেছে সেই প্রসঙ্গে; “বিজ্ঞানীরা বলছে”, “হু বলছে”, “সরকার বলছে” বা “খবরে বলছে”, সুতরাং বিনাপ্রশ্নে তা পালন করা প্রসঙ্গে।

বিজ্ঞানী যা বলছেন, তাই-ই কি বিজ্ঞান ? যদি তা হয়, তবে বিজ্ঞান ‘বিজ্ঞান’ নয়, ‘ধর্ম’। স্পেশালিষ্ট-এর গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করতে বলছি না, তবে তাও যদি বিনাপ্রশ্নে মেনে চলা হয়, তাহলে স্পেশালিষ্ট-কেও ধর্মগুরুই বানানো হয়, বিশেষত যদি স্পেশালিষ্ট তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করে কিছু বলেন। এক্ষেত্রে ঘটনাটা সম্পূর্ণ তাই-ই। বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত না সংক্রমণের প্রকৃত পদ্ধতি খুজে পেয়েছেন, না ওষুধ আবিষ্কার করতে পেরেছেন। তাঁদের এই অক্ষমতারই নাম “সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং”। কিছুই যখন পারিনি, তখন সবাই দূরে দূরে থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচো ⚊এই হল এর সারকথা। এ হল আধুনিক ধর্মের শ্লোক ⚊ ব্যাখ্যা নেই, সমাধানও নেই, তবু মানতে হবে, এই তো ধর্ম ! ভাবুন তো, আজ থেকে শতাধিক বছর আগে যখন প্লেগ-কলেরা-যক্ষ্মার মতো মহামারি হতো, তখনও রোগীকে একঘরে করা হতো, আর সবাইকে তাদের থেকে দূরে থাকা, নিজেকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে বাঁচার উপদেশ দেওয়া হতো; মধ্যযুগীয় সেই বর্বরতাকেই আজ ফিরিয়ে আনা হয়েছে আধুনিক জমকালো নাম দিয়ে : “সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং”; শুধু ‘উপদেশ’-এর বদলে আজ ‘নির্দেশ’। কিন্তু নাম বদলালেও পরিণাম তো একই। তাই এই “সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং” মানুষকে বর্বর পশুতেই পরিণত করল; কোথাও রোগীকে, কোথাও চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে, কোথাও গর্ভবতীকে বা কোথাও সদ্যজাত শিশুসহ মাকে এলাকা ছাড়া করল ‘আধুনিক ধর্মভীরু’ মানুষেরা ! … ভুল … পশুরা !  

আসলে আধুনিক ধর্ম হল ‘প্রতিষ্ঠানপন্থা’; হিন্দুধর্ম, ইসলাম, খ্রিস্ট বা বৌদ্ধ ⚊ সব ধর্মের ঊর্ধ্বে এই ধর্ম। যা ‘প্রতিষ্ঠা’ পেয়েছে, বিনাপ্রশ্নে তার প্রতিটি বাক্য মেনে নেওয়া, এই ‘আপাত-বহিঃশক্তি’-ই আজকের ঈশ্বর। উদাহরণস্বরূপ, আমরা সচেতন ভাবেই বিজ্ঞানী মন্টেগ্নার-এর পরিচয়ে ‘নোবেলজয়ী’ শব্দটি উল্লেখ করেছি, কিন্তু সেজন্যই তাঁর কথা সব ঠিক এমনটা নয়, আমরা তাঁর বিরুদ্ধ যুক্তি দাবী করেছি, এইটেই বিজ্ঞান। নোবেলজয়ীর কথা, অতএব নিশ্চয়ই ঠিক, এই মনভাব ‘কথা’-টির পিছনে নয়, ‘নোবেল’-এর প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্ধ ভাবে ছোটা, এবং ‘ধর্ম’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিপুল অর্থের ভাতা আর সুযোগ-সুবিধার প্রাচুর্যে ভরে ওঠা বিজ্ঞানীরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজ নিজেদের ধর্মগুরু বানিয়ে তুলেছেন, এবং বিজ্ঞানের ‘জার্গন’ (দুর্বোধ্য ভাষা)-গুলি তাঁদের সংস্কৃত ভাষা মাত্র, জনগণের জন্য যা কেবল “অং-বং-চং”। এই ‘বিজ্ঞান’, তার সাথে ‘বিজ্ঞানের সংঘ’ (যেমন ‘হু’), তার পাশে ‘মগজধোলাই যন্ত্র’ (তথা মিডিয়া, সোশ্যাল ও আন-সোশ্যাল উভয়ই), তাদের সহযোগিতার জন্য সদা-উন্মুখ প্রশাসনিক আমলা ও সরকারি লেঠেল বাহিনী, সবে মিলে ‘আধুনিক রাষ্ট্র’-ই হল আজকের ‘আধুনিক পৃথিবীর ধর্ম’; তার ‘মন্ত্র’ “সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং”, আর ‘মাদুলি’ হল ‘মাস্ক’ : “গলায় ঝোলাও আর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও”।

অথচ বিজ্ঞান চরিত্রগত ভাবেই ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ ! বিজ্ঞানের যেকোনো একটি আবিষ্কার সেই সময় পর্যন্ত যা ‘প্রতিষ্ঠিত সত্য’, তাকে ভেঙ্গে দেয়। সেই বিজ্ঞানেরই ‘প্রতিষ্ঠার’ ভরকেন্দ্রে অবস্থান করার ঘটনাই আজ বিজ্ঞানের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ; বিজ্ঞানের ‘ধর্ম’ হয়ে ওঠাই তার সবচেয়ে বড় বিপদ। এই প্রবন্ধের সব প্রশ্ন আসলে এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই। বিজ্ঞানকে তার মূল দর্শনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই আজ সময়ের দাবী, যা দাবী করে : “Doubt Everything”.

কমরেড বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের আহ্বায়ক

প্রচ্ছদ সৌজন্যেঃ
পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেড কালচারাল ইউনিট

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *