সারা দেশজুড়েই ঠিকা শ্রমিকদের প্রতি চলছে ব্যাপক ব্যাভিচার যা থেকে বাদ পড়ছে না বি. এস. এন. এল-এর মতো সরকার অধিগৃহীত জাতীয় সংস্থা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র আঞ্চলিক শিল্প কারখানাগুলি। এবং সেখানে শ্রমিক আন্দোলনকে বিপথগামী করে মালিকের সাথে মিলিতভাবে শ্রমিকদের প্রতারিত করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতার বোরেরা, দক্ষিণপন্থী শ্রমিক নেতারা। তারই নজির চোখে পড়ল যখন পূর্ব মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে ‘সুপ্রিম’-এর কারখানার শ্রমিকেরা নিজেদের প্রাপ্য মজুরির দাবীতে আন্দোলনের পথ গ্রহণ করলেন। এবং সেখানে নেতৃত্বে উঠে এলেন এমন কিছু নেতা যারা  ৪০০টাকা বরাদ্দ জেনেও ৩৫০ টাকা মজুরির দাবীতে আন্দোলন পরিচালনা করলেন এবং তার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরিকে কমিয়ে আনার চক্রান্ত চালালেন নতুন ঠিকাদারদের সাথে হাত মিলিয়ে।
 
 
পলিমারজাত পণ্য প্রস্তুতকারী সংস্থা সুপ্রিম-এর নারায়ণগড়ের কারখানায় গত ২৭শে জুন প্রাপ্য মজুরি না দেওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রায় দুই হাজারের অধিক শ্রমিক অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেন। টানা তিনদিন অবস্থান বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি চালান শ্রমিকেরা। বিগত ২০১৫ সাল থেকে সুপ্রিমের কর্মচারীদের পিএফ, এসআই শুরু হলেও ২০১৮ সালে থেকে তা কার্যকারিতা হারায়। প্রত্যহ ৮ ঘন্টা ১৫ মিনিট ডিউটিতে শ্রমিকরা পাচ্ছে না টিফিন টাইম কিংবা শৌচালয় যাওয়ার সময়টুকুও! মাসিক বেতন তাঁরা পান কোম্পানির ঐচ্ছিক মতিভ্রম অনুসারে। তারা পান না কোনো রকমের পে স্লিপ পর্যন্ত যার কারনে তাঁদের হেনস্তা হতে হয় বিভিন্ন সরকারী সুবিধা উপভোগের ক্ষেত্রে। সরকারী হস্তক্ষেপে বিগত ধর্মঘটে শ্রমিক দের বিভিন্ন আশ্বাস প্রদান করা হলেও শেষ পর্যন্ত তার ফলশ্রুতি হয় শূন্য। মালিক পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা তে বসেও কোনোরকম সমাধান সূত্র বের করা যায় নি। 
এবারে প্রাপ্য মজুরির দাবীর সাথে সাথে তারা সাইকেল-বাইক রাখার ব্যবস্থা করা, ক্যানটিনের ব্যবস্থা করা, সুরক্ষার দায়িত্ব নেওয়া ইত্যাদি সাধারণ অধিকারের দাবীগুলিও তুলে আনেন। তারা দাবী করেন দৈনিক মজুরি ২৭৮টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০টাকা করতে হবে। টাকার অঙ্কের হিসেবটা যদিও আদতে একেবারেই অন্যরকম।
নাম প্রকাশে অনিচ্চছুক এক কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানির তরফ থেকে মাথাপিছু দৈনিক মজুরি বরাদ্দ হয় ৪০০টাকা। কিন্তু শ্রমিকদের নসীব হয় মাত্র ২৭৮ টাকা। প্রাথমিকভাবে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২৫০টাকা। পূর্বে একাধিকবার বিক্ষোভ ও লাগাতার দাবীদাওয়ার ফলে তা বেড়ে ২৭৮টাকা হয়। বাকি টাকার হিসেবেই লুকিয়ে আছে এই ঠিকা কারবারের আসল গল্প।
বরাদ্দ মজুরি ঠিকাদার ও ইউনিয়নের দাদাদের (কিছু ক্ষেত্রে উভয়ে একই ব্যক্তিও হন, যেমন এক্ষেত্রে) মারফত শ্রমিকদের হাতে পৌঁছোয়। ৪০০টাকা থেকে ২৭৮ টাকা শ্রমিকদের দিয়ে বাকি ১২২টাকা দৈনিক মাথাপিছু ভিত্তিতে পকেটস্থ হয় ইউনিয়নের নেতা তথা ঠিকাদারের। শুধু তাই নয়, শ্রমিকেরা একথাও জানিয়েছেন যে তাদেরকে কাজ দেওয়ার জন্যে আই. এন. টি. টি. ইউ. সি.-এর সম্পাদক রণজিৎ বাবু তাদের কাছ থেকে গড়ে প্রায় এক লক্ষ টাকা করে নিয়েছিলেন। একজন শ্রমিক জানান, “কাজ দেওয়ার জন্য আমাদের থেকে এক লাখ করে টাকা নেয় রণজিৎ দা আর এও বলে যে ৩০০টাকা করে মজুরি দেবে।” কিন্তু কাজে ঢোকার পর সেই টাকার অঙ্ক এসে দাঁড়ায় ২৫০ তে। তা থেকে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় শ্রমিকদের মধ্যে এবং দীর্ঘদিন লাগাতার দাবীদাওয়ার ফলে তা ২৭৮ হয়। এই ঘটনার প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও মজুরিতে কোনোরকম বৃদ্ধি ঘটেনি। এরই মধ্যে শ্রমিকেরা জানতে পারেন যে কোম্পানি থেকে তাদের বরাদ্দ হয় ৪০০টাকা করে। ফলে এই ক্ষোভ, যা মূলত ছিল তৃণমূলের শ্রমিক ইউনিয়ন ও তার নেতাদের প্রতি, তা আন্দোলনের রূপ নেয়। বা, বলা যেতে পারে এই ক্ষোভকে আন্দোলনের রূপ দেওয়া খুব সহজ হয়ে ওঠে অজ্ঞাত রাজনৈতিক পরিচয়ের (নিজেরা স্বীকার না করলেও ঘটনাস্থলে গেরুয়া পতাকা হাতে তাদের বেশকিছু অনুগতদের দেখা যায়) নতুন নেতাদের যারা ৩৫০টাকা মজুরির দাবীতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।
 
আন্দোলনে দৃশ্যমান গেরুয়া পতাকা 
 
জানা গিয়েছে এরা কোনো পরিচিত ডান বা বাম শ্রমিক সংগঠনের কেউ নয়। তবে কারা ওই নেতৃত্ব যারা ৪০০টাকা বরাদ্দ জেনেও ৩৫০ টাকা মজুরির দাবীতে আন্দোলন পরিচালনা করলেন এবং মালিকপক্ষের সাথে বৈঠক করে এসে ৩২০টাকা মজুরি ঘোষণা করলেন? ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সাহায্যে তারা রণজিৎ ঘোষ ও আই. এন. টি. টি. ইউ. সি-এর অন্যান্য নেতাদের আটকে দিলেন ও ইউনিয়নকে অচল করে দিলেন ঠিকই, কিন্তু বরাদ্দ মজুরির বাকি ৮০টাকার হিসেবটা তারা আর দিলেন না শ্রমিকদের। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে মালিকের সাথে গোপন অভিসারে চুক্তি করে এরাই হয়ে উঠলেন নতুন ঠিকাদার যাদের হাত দিয়ে মজুরি পৌঁছোবে শ্রমিকদের কাছে।
 
বিপাকে তৃণমূল নেতা রণজিৎ ঘোষ 
 
এই আন্দোলন যে কোনোভাবেই একটি বাম আন্দোলন নয়, শ্রমিকস্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুই শ্রমিকদের সাময়িক স্বস্তি দিয়ে ঠিকাদারির হাতবদলের কারচুপি, তা আন্দোলনের দাবীর অস্বচ্ছতা এবং আন্দোলনের প্রবাহ ও পরিণতিতে স্পষ্ট। এবং এও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে শ্রমিক আন্দোলনের ধারা বামপন্থা ও বামপন্থী নেতৃত্ব থেকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণপন্থী সুবিধাভোগী আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করছে। নারায়ণগড়ের ঘটনা এই ধারার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ। 
লোকসভা নির্বাচন থেকে শ্রমিক আন্দোলন- সর্বত্র বামপন্থা ও বামপন্থীদের অভাব এবং ফ্যাসিবাদী শক্তির ক্রমাগত উত্থান বৃহৎ বামদল তথা বাম শ্রমিক সংগঠনগুলির অসাড়তাকে প্রমাণ করে দিচ্ছে। সেখানে ঠিকা শ্রমিকদের ঘণ্টা প্রতি ন্যূনতম ১০০টাকা মজুরি করা, অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ, শ্রমিকদের সবরকম সুরক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করার দাবীতে প্রকৃত বামপন্থী নেতৃত্বদের উঠে আসা একান্ত আবশ্যিক। শ্রেণী ভোলানোর এই রাজনীতিকে অবিলম্বে না রুখতে পারলে মেহনতীদের জীবন অতি সত্বর অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে।
Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *