বিগত কয়েকদিন যাবৎ খবরের কাগজে, টিভির পর্দায়, সমাজ-মাধ্যমের পাতায় যেসব ঘটনা শিরোনামে উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের উপর এনসিইআরটি-র কোপ হচ্ছে অন্যতম। আরও বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশান এন্ড রিসার্চ ট্রেনিং নিজেদের দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে মুঘলদের সম্পর্কিত অধ্যায়টি বাদ দিয়েছে। সেই নিয়ে খবরের কাগজে বিস্তর লেখালিখি চলছে, বলাই বাহুল্য। ঐতিহাসিকরা নিজেদের পাণ্ডিত্যের নিদর্শন জাহির করে হেথা-হোথা বক্তৃতা রাখছেন। পথ চলতে চলতে কান পাতলে হয়তোবা শোনা যাবে, দু-একটা চায়ের দোকানেও এই নিয়ে মৃদু আলোচনা চলছে। এনসিইআরটি বা সিবিইএসসি-র কত্তা-ব্যক্তিরা কিন্তু এসব সমালোচনায় অবিচল থেকে বলেছেন সিলেবাসে কাট ছাঁট তো ভীষণই ‘রুটিন’ ব্যাপার। পড়ুয়াদের চাপ কমাতে, বিশেষত কোভিড পরবর্তী সময়ে সিলেবাস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা স্বভাবতই আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। মুঘলদের মোটেও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়নি, বরং সিলেবাসকে ‘রেশানালাইস’ করা হয়ছে। যা কিছু ‘অনাবশ্যক’ বা ‘পুনরাবৃত্তি’, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এই যুক্তিতে মুঘলদের সাথে সাথে গনতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন অংশ, গান্ধী হত্যার পরবর্তী সময়ে আরএসএস-এর উপর নিষেধাজ্ঞা, দেশ ভাগের সময় গান্ধীর হিন্দু-মুসলিম একতার প্রচেষ্টা সহ সাম্প্রতিক অতীতের গুজরাট দাঙ্গা— এই সবকিছুই বিদায় নিয়েছে পাঠ্যক্রম থেকে। এরপরে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, ‘তো? সিলেবাস থেকে আকবরের বাবার নাম বাদ গেলে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হল? শাহজাহানের পুত্রদের সিংঘাসনের লড়াইয়ের গল্প না জানলে কি রাতের ঘুম উড়ে যাবে? বা এসব পড়লে বা না পড়লেও কি চালের দাম, ডালের দাম, পেট্রোলের দাম কমে যাবে?’ আর এসব প্রশ্নগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বুদ্ধিজীবি, ঐতিহাসিক, ইতিহাসের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। আমরা যারা ইতিহাস চর্চা করি এবং পড়াই, তাদের উপর এসে পড়েছে এক গুরু দায়িত্ব— ইতিহাসকে রক্ষা করা এবং তা সঠিক ভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পরিবেশন করা। সাথে সাথে খুবই সোজা সরল ভাষায়ে আমাদের সমসাময়িক সমাজকে বোঝানো যে ইতিহাস লেখা এবং পড়া কোন কিছুই বৃহত্তর রাজনীতির বাইরে বা উর্ধ্বে নয়। বরং ভীষণ ভাবেই সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত। ইতিহাস কেবলই অতীতের জীবন, যুদ্ধ, নীতি, কূটনীতির ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ নয়। ইতিহাসের লেখনীতে ধরা থাকে বর্তমান সময়ের প্রতিচ্ছবি, এবং আরও কাছ থেকে দেখলে পাওয়া যায় ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেতও।
স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালে ভারতের ইতিহাস এবং ভারতবাসীর ইতিহাস চেতনা নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনা ও বিতর্ক আছে। বহু ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা তাদের ভ্রান্তি ও বৈষম্যে ভরপুর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে এর উত্তরে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নানা ভাবধারা এবং দর্শনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের দেশের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছে। বর্তমান কালে বেশ কিছু বছর ধরে, প্রধানত বিজেপি সরকারের আমলে আমরা দেশের ও দশের ইতিহাস লেখন এবং পুনর্লিখন নিয়ে যে টানাপড়েন প্রত্যক্ষ করছি, তার শিকড় কোথাও গিয়ে লুকিয়ে আছে আমাদের দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অতীতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, রাষ্ট্রের ভাবাদর্শ অনুযায়ী ভারতের আদর্শ ইতিহাস হচ্ছে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস, হিন্দু এবং হিন্দুত্বের ইতিহাস। এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ কিন্তু কোনোভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতি, বর্ণ, শ্রেণী, ধর্ম, লিঙ্গ মিলিয়ে ভারতীয়দে্র নিজস্ব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিস্পর্ধা, সংগ্রামের ইতিহাস নয়। বর্তমানে আরএসএস-এর উগ্র হিন্দুত্ববাদে উদ্বুদ্ধ বিজেপি এবং তাদের বুদ্ধিজীবিদের কাছে ভারতের ইতিহাস মানে হিন্দুদের বীরকথা এবং হিন্দুত্বের জয়গাথা। এই ভাবাধারকে নিজেদের বীজমন্ত্র ক’রে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিজেপি-আরএসএস দ্বারা প্রতিপালিত ‘বুদ্ধিজীবির দল’ আজ নিয়োজিত হয়েছে ভারতের ইতিহাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার যাত্রায়। এভাবেই এরা অতীতকে ‘দাবার ঘুঁটি’ করে ভারতকে বহুকাঙ্ক্ষিত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, মুছে ফেলতে চায় সমস্ত সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার— যা বহু লড়াই, ঘাত-প্রতিঘাতের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের দেশে। আর তাই মুঘলদের বা গান্ধীকে সিলেবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া আসলে ইতিহাসকে পুনর্লিখন করার দিকে একটা ধাপ মাত্র। ইতিহাসকে ‘পাব্লিক মেমোরি’ থেকে বিলুপ্ত করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাওয়া হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে।
একথা বলা জরুরী যে ইতিহাসের রচনা ও প্রচারে শাসকের স্বার্থ রক্ষার সবরকম চেষ্টা সবসময়ই চলে এসেছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ইতিহাস এতদিন স্কুলে পড়ানো হয়ে আসছে, সেখানে দেশের স্বাধীনতা লাভকে প্রধাণত নেহেরু-গান্ধী সহ কংগ্রেসী ও দক্ষিণপন্থীদের অবদান হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে। অথচ গান্ধী ও কংগ্রেসের প্রাথমিক মতামত ছিলো ‘ডোমেনিয়ন-স্টেটাস’-এর মতো একটি আপোষরফার ও দাসত্বের লাইন। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কমিউনিষ্টরাই প্রথম ‘টোটাল ইণ্ডিপেণ্ডেন্স’ বা ‘পূর্ণস্বরাজ’-এর দাবী জানান। কমিউনিষ্টদের সে দাবীর জনপ্রিয়তার চাপে পড়েই কার্যত তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী হাইকম্যাণ্ড! মজার ঘটনা হলো এই সত্যকে কিছুটা পাশ কাটিয়েই যাওয়া হয়েছে এদেশের স্কুলপাঠ্যে, সিলেবাসে। ব্রিটিশরাজের মাজা ভেঙ্গে দেওয়া চট্টগ্রামের সশস্ত্র অভ্যুত্থান থেকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা, তেভাগা কৃষক-বিদ্রোহ থেকে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা, কিংবা নৌ-বিদ্রোহ— এমন সবকটি দ্রোহের প্রধান নেতৃত্বের সিংহভাগই যে কমিউনিষ্ট মতাবলম্বী ছিলেন বা পরবর্তীতে কমিউনিষ্ট পার্টিরই কর্মী হয়ে ওঠেন, সেসব সত্যকে চেপে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টাও চিরটাকালই চলে এসেছে। গত বিশ বছরে বিভিন্ন সময়ই এনসিইআরটি, আইসিএসই ও এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও দেখা গেছে ভগৎ সিং, সুকদেব, ও রাজগুরুর মতো বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘টেররিস্ট’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ এমনকি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনকে ‘অ্যাক্ট অব টেররিজম্’-ও বলা হয়েছে। সেসব নিয়ে বিতর্কও চলেছে বিস্তর। ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর সংজ্ঞা কী, তা নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক থাকতেই পারে৷ কিন্তু আজকের দিনে সন্ত্রাসবাদ বা টেররিজম্ বলতে সাধারণ অর্থে অত্যন্তই ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ কারণে ‘নির্বিচার গণহত্যা’-কেই বোঝায়। ফলে, দেশের বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামের আগে এরকম শব্দের ব্যবহার যে আসলে পরিকল্পিতভাবে তাঁদের রাজনীতিকেই বিকৃত অর্থে তরুণ হৃদয়ে গেঁথে দেওয়ারই চেষ্টা, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে!
কিন্তু আজকের বিজেপির ভারতে স্কুলপাঠ্যের ইতিহাস-বিকৃতি কংগ্রেসীদের ইতিহাসের উপর ‘ম্যানিপুলেশন’-এর থেকে গুণগতভাবেই আলাদা। দুনিয়াজুড়ে পুঁজির সঙ্কট এক চরম আকার নিচ্ছে। তার হাত ধরে দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে, ভারত যার অন্যতম ‘এপিসেন্টার’। ২০২৪ সালে একদিকে এদেশের লোকসভা নির্বাচন; অন্যদিকে, এবছরই শতাব্দীর এখনও পর্যন্ত্য দেখা ভয়ানক অর্থনৈতিক সঙ্কটের স্পষ্ট পূর্বাভাস দিয়ে দিয়েছে আইএমএফ-এর মতো নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলি। স্বাভাবিকভাবেই, সঙ্কটের এই বোঝাকে জনগণের ঘাড়ে চাপাতে বদ্ধপরিকর ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি! মালিকদের স্বার্থে করা তাদের এই ‘মহৎ কর্মসূচীর’ বৌদ্ধিক পদক্ষেপই হলো ইতিহাসের পাঠ্যবিকৃতি। ফ্যাসি-অভ্যুত্থানের যুগে রাষ্ট্র চায় চেতনার দিক থেকে একটা পঙ্গু প্রজন্মের নির্মান৷ নইলে সঙ্কটের উপুর্যুপুরি বোঝা সে চাপাবেই বা কীভাবে! আর সে কাজের জন্য সবচাইতে জরুরী হলো মানুষকে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সেজন্যই ’৯৯-এর অটল-সরকারের আমলে কিংবা ২০১৪-এর মোদী সরকারের আমলেও বিভিন্ন প্রস্তাবনা এলেও, বিভিন্ন পরিকল্পনা নিলেও, বিজেপি-আরএসএস-এর ‘হোয়াটস্যাপ সিলেবাস’-কে দেশের স্কুল-সিলেবাসে পরিণত করা যায়নি। গভীর ও অসামালযোগ্য অর্থনৈতিক সঙ্কটের যুগেই যে ফ্যাসিবাদ দানা বাঁধে এবং তা যে স্রেফ একটি নির্দিষ্ট দলের মতাদর্শেরই ব্যপার নয়, বরং একটি বস্তুগত পরিস্থিতিরই বিষয়, এই ঘটনা তারও প্রমাণ দেয়।
বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দু ভারতে, কেবল এবং কেবল মাত্রই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জায়গা আছে। আরও ভালো ভাবে বললে, উচ্চ জাতি এবং শ্রেণীর হিন্দুদের। সেই ভারতে কোনোভাবেই নেই কোনো মৌলিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, জীবন যাপনের অগ্রাধিকার এবং সর্বোপরি ধর্মীয় স্বাধীনতা। ভারতীয় উপমহাদশে যুগ যুগ ধরে বহমান বহুমাত্রিকতা, ধার্মিক বৈচিত্র্, সাংস্কৃতিক বহুত্ব আজ রাজ-রোষে পড়ে বিপন্ন। আজকের ভারতে, উগ্র হিন্দুত্ত্ববাদীদের চোখে এবং তাদের ভাবনাতে তাই মুসলমানদের কোনো স্থান নেই। তারা আজ হয় ‘বহিরাগত’, ‘দেশদ্রোহী’ নাহলে ‘পাকিস্তানী’। স্বভাবতই, মুঘলদের ইতিহাস শুধুমাত্র পরিচিত হচ্ছে ইসলামিক ইতিহাস হিসেবে। ভারতের মধ্যযুগ আজ কেবলমাত্রই মুসলিম আমলে এসে দাঁড়িয়েছে। এ এক চূড়ান্ত ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামির প্রতিফলন, যেখানে কোনভাবেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, বা সাংস্কৃতিক আদান প্রদানকে স্বীকার করা হয়না। বরং বারংবার এটাই বলা হয় যে, এতকাল ধরে যে ইতিহাস স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলিতে পড়ানো হয়ে এসেছে, তা আসলে অসত্য এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রোপাগান্ডা। এই কথাগুলি আক্ষরিক অর্থেই ভেদাভেদ এবং হিংসাত্মক রাজনীতির পরিচয় বহন করে, যাকে মদত দেয় অশিক্ষা এবং খানিকাংশে রাজনীতির প্রতি অনীহাবোধ। ইতিহাস বিষয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে যে চূড়ান্ত আগ্রহের অভাব পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে বিগত বহুবছর ধ’রে, তার ফলেই এধরণের অর্থহীন কথাবার্তা বলা আজকে সহজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে হিন্দুত্বের দালালদের জন্য। এর জন্য অবশ্য যে ভাবে ছেলে মেয়েদের ইতিহাস পড়ানো হয় এবং আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা দুইই বিশাল মাত্রায় দায়ী।
আজ নতুন ইতিহাস লেখার তাগিদে এবং চলতি মুসলমান বিদ্বেষের আগুনে ঘৃতাহুতি দেওার জন্যই পাঠ্যক্রম বা সিলেবাসকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে এতদিনের জানা ও প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতাকে। নতুন ইতিহাস স্থাপন করার চেষ্টা চলছে, যেখানে মুসলমান মুঘল সম্রাটরা হিন্দু হত্যাকারী, হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা মধ্য এশিয়া থেকে এসে হিন্দু ভারতকে লুট করেছে, শিব মন্দিরের উপর তাজ মহল বানিয়েছে। এই সমস্ত তথ্য স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারনা কে প্রশ্রয় দেয়, কিন্তু ইতিহাসকে অবলম্বন করেনা। যারা এই কথাগুলো আজ প্রচার করছে তারা কেউ ঐতিহাসিক তো নয়ই, এবং ইতিহাসের ‘ডিসিপ্লিন’, গবেষণার ‘মেথডোলোজি’ বা ‘সোর্স’ সম্পর্কে দূর দূর অবধি অবগত নয়। তাই রোমিলা থাপার বা ইরফান হাবিবের অবদান ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের কাছে ঔরংজেব কেবলই এক জন মারাঠা, হিন্দুদের অত্যাচারী সম্রাট, তারা জানেনা কাশী-বিশ্বনাথ মন্দির তৈরির পিছনে তাঁর দানের কথা। আজকাল যেকোনো অনুষ্ঠান পার্বণের আগে ‘হিন্দু’ শব্দ প্রয়োগের চল উঠেছে, যেমন হিন্দু নববর্ষ, হিন্দু হোলি ইত্যাদি। এরা জানেনা মুঘল আমলে কিভাবে শাহজাহানাবাদে হোলি, দেওয়ালি পালিত হতো, বা আকবরের দরবারে কিভাবে ফারসি চর্চার সাথে সাথে সংস্কৃত চর্চা হতো। আজকের ভারতবর্ষ থেকে ইবাদত-খানা বা দিন-ই-লাহির ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে, যা হয়তো শুরু হয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সাথে সাথে এবং মান্যতা পাচ্ছে রাম মন্দির নির্মাণের সঙ্গে।
মুঘলদের রাজনৈতিক ইতিহাস বাদ দেওয়া মানে শুধু মুসলমানদের বাদ দেওয়া নয়। বুঝতে হবে এর মানে আরও গভীর। এর মানে কোথাও গিয়ে প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মহাবীরের ইতিহাসকেও বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাবে, আজ নয় তো কাল। মুঘলদের সম্পর্কে না জানা মানে কিন্তু মধ্যযুগীয় ভারতের ব্যবসা বানিজ্যের কথা না জানা, বিদেশনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, বিভিন্ন গোষ্ঠী সম্পর্কে অনবগত থাকা। সাথে সাথে আঠারো শতকে যে সমস্ত নবাবী, মারাঠা, শিখ, সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তাদের ইতিহাসকেও অবৈধ বলা। ইতিহাসকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা যায়, ইতিহাসকে দেখার নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আসতে যেতে পারে, ঐতিহাসিকরা নতুন ‘সোর্স’-ও আবিষ্কার করতে পারেন— কিন্তু অতীতকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়ারা মুঘলদের অধ্যায় পড়ুক আর নাই পড়ুক, ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধ কোনোভাবেই মিথ্যা হয়ে যাবে না। রানা প্রতাপ রাজপুতি বীরের তাজ নিয়ে অমর হয়ে থাকতেই পারেন কিন্তু ইতিহাস জানে হলদীঘাটির যুদ্ধে কি হয়েছিল। ইতিহাসে তর্কের জায়গা সবসময় থাকবে এবং থাকা উচিত, কিন্তু কোন এক বিশেষ অতীতকে পছন্দ নয় বলে, তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারেনা। মুঘলদের ইতিহাস বহিরাগতদের ইতিহাস হলে মনে রাখতে হবে ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কিন্তু বহিরাগতদের আনাগোনা হয়েছে এবং সেই যুক্তিতে আমাদের বৈদিক যুগের ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে হয়। প্রশ্ন করতে হয়ে কুষাণ আমলকে, বাদ দিতে হয় দিল্লী সুলতানদের এবং সব চেয়ে বড় কথা পুরোপুরি অস্বীকার হয় ব্রিটিশ শাসন এবং ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামকে। সর্বোপরি ভুলে গেলে চলবেনা, যে মুসলমানদের বহিরাগত দেশদ্রোহী দেখানোর প্রবল তাগিদ, যে মুঘলদের বিধর্মী লুটেরা দেখানোর প্রাণপাত প্রচেষ্টা, সেই শাহজাহানের বানানো লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট দেশবাসীর উদ্দ্যেশ্যে ভাষণ দেন। এই লাল কেল্লাতেই কিন্তু একদিন সিপাহি বিদ্রোহের সময় বাহাদুর শাহ জাফরকে তাদের নেতা ঘোষণা করে তাঁর কাছে ছুটে গেছিল বিদ্রোহী সেনার দল। এই লাল কেল্লাতেই কিন্তু, আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের বিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল গোটা দেশ। ভুলে গেলে চলবে না, কিছুদিন আগে কৃষক আন্দোলনের সময় প্রতিবাদরত কৃষকরা এই লালকেল্লাতেই উড়িয়েছিলেন তাঁদের প্রতিবাদের নিশান। তাই দিনের শেষে ইতিহাসকে জনমানস থেকে সাময়িক ভাবে সরানো যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তো অবিনশ্বর, চির আবহমান। সে ঠিক নিজের রাস্তা খুজে নিজে চলতে থাকবে।
লেখিকা ইতিহাসের শিক্ষিকা ও গবেষিকা