আবার একটি পরিকল্পিত খুন এবং সেখানে তথ্য ধামাচাপা দেবার প্রচেষ্টা। এবার ঘটনাস্থল হাসনাবাদের পাটলিখানপুরের আমরুলগাছা। গত ৭ই অক্টোবর, বোনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন আমরুলগাছার বাসিন্দা হাসানুজ্জামান গাজি। পরদিন রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় হাসনাবাদ-নেবুখালি রোড থেকে উদ্ধার হন হাসানুজ্জামান। উদ্ধারের সময় তার মাথা ও সারা শরীরে ভারী বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল, জামাকাপড় ছিল ছিন্নভিন্ন এবং জিভ ছিল কাটা। দেহ উদ্ধারের পর থেকেই খুন ঘিরে একাধিক রহস্য দানা বাঁধে। উদ্ধারের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বসিরহাট জেলা হাসপাতালে, সেখান থেকে পাঠানো হয় আর. জি কর হাসপাতালে। গত ১৯ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। ঘটনা জানাজানি হবার পর থেকেই পীড়িতের পরিবারকে টাকা দিয়ে কেস তুলে নেবার জন্য শাসানির অভিযোগ ওঠে এলাকার একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে।
হাসানুজ্জামানের পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ৭ ই অক্টোবর হাসানুজ্জামান স্বরূপনগর থানার হঠাৎগঞ্জে বোনের বাড়িতে বাবার বাইক আনতে প্রতিবেশী জাহাঙ্গির নামক এক যুবকের সঙ্গে তার ইঞ্জিন ভ্যানে বাড়ি থেকে বের হন৷ সেখান থেকে বাইকটি ইঞ্জিন ভ্যানে চাপিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেন। ফেরার পথে রাত ১০ টায় ফোনে হাসানুজ্জামান জানান তিনি হাসনাবাদে আছেন, এরপরে রাত দু’টো নাগাদ হাসানুজ্জামান জানান তিনি বাড়ি ফিরছে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে, কিন্তু এরপরেই হাসানুজ্জামানের সাথে আর কোনো যোগাযোগ করা যায় নি। বারংবার যোগাযোগের চেষ্টা করার পর শেষরাতে জাহাঙ্গিরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা গেলে সে জানায়, হাসানুজ্জামান তার ইঞ্জিন ভ্যান ছেড়ে নেমে গেছে হিঙ্গলগঞ্জের এক জায়গায়। সে জানে না হাসানুজ্জামান কোথায় গেছে। ভোরবেলা খবর পাওয়া যায় হাসানুজ্জামানকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় হাসনাবাদ-নেবুখালি রোডে নারকেলতলার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷
পরদিন খবর জানাজানি হতেই বাড়ি থেকে ফেরার হয় জাহাঙ্গির ও তার পরিবার। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আদালতে খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের করে পুলিশ জানায় জাহাঙ্গিরকে জেরা করে পুলিশ হাসানুজ্জামানের মোবাইল ফোন, ছুরি, ইঞ্জিন ভ্যানের রড সহ একাধিক অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
হাসানুজ্জামানের পরিবারের দাবি, যে ভাবে হাসানুজ্জামানকে মাথার পিছনে ও বুকে আঘাত করে,জিভ কেটে, থেঁতলে খুন করা হয়েছে তা কখনই জাহাঙ্গিরের মত একজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়, তাকে সামনে রেখে এর পিছনে মূল চক্রীদের এবং আসল ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে পুলিশ ও স্থানীয় শাসকদলের নেতাদের যোগসাজশে৷ হাসানুজ্জামানের পরিবারের দাবি ঘটনা জানাজানি হবার পরেই মামলা বন্ধ করে মিটমিট করার জন্য পর থেকেই তাদের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের পক্ষ থেকে। শাসকদলের স্থানীয় পঞ্চায়েত মেম্বার, প্রাক্তন উপপ্রধান-সহ একাধিক কুখ্যাত দুষ্কৃতিরা এসে তাদের ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মীমাংসা করে নিতে বলে, না মানলে বিভিন্ন সময়ে তাদের হুমকিও দেওয়া হয়। এলাকার একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই ঘটনায় যুক্ত রয়েছেন বলে তাদের সন্দেহ। হাসানুজ্জামানের মা হালিমা গাজী বলেন, ‘আমাদেরকে টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে, প্রাণেনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা এর শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শান্তি নেই।’
হাসানুজ্জামানের মৃত্যুর পরদিন অর্থাৎ ২০ শে অক্টোবর তারিখে দুই শতাধিক ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ চক পাটলি মোড় অবরোধ করে। তাদের দাবি ছিল এই ঘটনার ন্যায়বিচার ও মূল চক্রীদের গ্রেপ্তার করা। এলাকার বাসিন্দা হালিমা বিবি বলেন, হাসানুজ্জামান পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিল, তার একটি ছোট মেয়ে এবং স্ত্রী রয়েছে।’ এলাকার ক্ষুব্ধ মানুষেরা বলেন পুলিশ প্রশাসনের কার্যকলাপে আমাদের বিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। লুঠপাট উদ্দেশ্য ছিল না, গভীর ষড়যন্ত্র করে হাসানুজ্জামানকে খুন করা হয়েছে এবং প্রশাসন প্রথম দিন থেকে একমাত্র জাহাঙ্গিরকে গ্রেপ্তার করে বাকিদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। এমনকি এলাকার সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করে তদন্তে গতি আনা হয় নি। ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ সমগ্র ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঐদিন রাতে কী কারণে এমন নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। যে ভাবে হাসানুজ্জামানকে খুন করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে একজনের কাজ এটা নয়, কিন্তু তারপরেও বাকিদের এক জনও গ্রেফতার কেন হল না তা নিয়ে এখনো গোটা এলাকা ফুঁসছে। এমনকি মৃতদেহ রাতে আনার পর কেন ঐরাতেই তাকে কবর দেওয়া হয় নি, এই জন্য পুলিশ স্থানীয় এক মৌলবীকে তাদের গাড়িতে তুলে ধমকায়। ঘটনায় যুক্ত মুখ্য সন্দেহভাজনকে দু’দফায় বেশ কিছু দিন পুলিশি হেফাজতে রেখেও কেন খুনের আসল কারণ সামনে এল না তা নিয়েও একাধিক প্রশ্ন উঠছে । তবে কী শাসকদলের সঙ্গে যোগসাজশে খুনের আসল ঘটনা ও রাঘববোয়ালকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মাসদুয়েক আগে হাসানুজ্জামানের বাবা ইদ্রিশ আলি গাজি বাইক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেটাও কী কেবল দুর্ঘটনা ছিল? উঠছে এই প্রশ্নও।