ঠিক যেন নব্বই এর হিন্দী ছবি। ঠিক যেমন ছবিতে দেখা যায়- অধিক প্রভাবশালী খলনায়ক তুলনামূলক কম ক্ষমতাশালী খলনায়কের বেআইনি কারবার ফাঁস করে দিয়ে তাকে জব্দ করে, ঠিক তেমনই ঘটলো গতকাল।
২০শে আগস্ট, ২০১৯, সিবিআই-এর পক্ষ থেকে লক-আউট-নোটিশ জারি করা হয় এককালীন কংগ্রেস সরকারের অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের নামে। আই.এন.এক্স মিডিয়া-র আর্থিক কারচুপির বিষকে কেন্দ্র করেই জারি হয় লুক-আউট-নোটিশ। নোটিশ পেয়ে পরদিনই কংগ্রেসের হেডকোয়ার্টারে সাংবাদিক বৈঠক করেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। সেখানে তিনি জানান যে তাঁর এবং তাঁর ছেলে কার্তি চিদম্বরমের নামে উঠে আসা সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন এবং এটি বিরোধীদের অপপ্রচার মাত্র। আই.এন.এক্স মিডিয়া-র সাথে সমস্ত রকম অর্থনৈতিক সম্পর্কই অস্বীকার করেন তিনি। ঠিক এর একঘন্টার মধ্যেই সিবিআই কর্তারা তাঁকে গ্রেফতার করেন। সাংবাদিক বৈঠকের খবর পেয়ে কংগ্রেসের হেডকোয়ার্টারে গিয়ে সেখানে চিদম্বরমকে না পাওয়ার পর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং দিল্লী পুলিশকে সাথে নিয়েই সিবিআই হানা দেয় তাঁর বাসভবন, জোর বাঘ রেসিডেন্সিতে। দ্বাররক্ষীরা তাদের ঢুকতে না দিলে অবশেষে তাদের একাংশ পাঁচিল টপকে, আর একাংশ পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে কার্যত ফিল্মী কায়দায়, এবং অবশেষে পি চিদম্বরমকে গ্রেফতার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সাফ জানিয়ে দেয় যে ২৩ তারিখের আগে জামিন পাওয়া সম্ভব নয়, এবং যেহেতু এখন তিনি গ্রেফতার, ফলে তাঁকে সাধারণ জামিনের জন্য আগে আবেদন করতে হবে। সিবিআই তাঁকে সারা রাত ব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ চালায়…
আসুন, এই ফিল্মী দৃশ্যের ইতিহাস জানা যাক। ১৫ই মে, ২০১৭; আই.এন.এক্স মিডিয়া-কে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন বোর্ড (এফ.আই.পি.বি)-এর অনুমোদন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কারচুপির ঘটনাকে নিয়েই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর নামে এফ.আই.আর দাখিল করে সিবিআই। এরপর, ২০১৮ সালে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট- এর পক্ষ থেকেও আর্থিক কারচুপির অভিযোগ দাখিল করা হয়। জানা যায়, ২০০৭ সালে ৪.৬২ কোটি টাকার বিদেশী লগ্নির অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও সবমিলে মোট ৩০৫ কোটি টাকার বিদেশী লগ্নি আমদানি করে আই.এন.এক্স মিডিয়া। ঘটনাটি আয়কর বিভাগের নজরে এলে তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয় এবং তখনই এই নাটকে প্রবেশ ঘটে চিদম্বরমের। ২০১৮ সালে আই.এন.এক্স মিডিয়া-র মালিক, শীনা বোরা হত্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত, পিটার মুখার্জী ও ইন্দ্রাণী মুখার্জী জানায় যে ২০০৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের শরণাপন্ন হলে চিদম্বরম তাঁর নিজ পুত্র, চেস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস-এর সর্বেসর্বা কার্তি চিদম্বরমের মাধ্যমে তাদের যাবতীয় আর্থিক লেনদেনের এবং সমস্ত রকম অনুমোদনের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন এবং বিনিময়ে ছেলের ব্যবসায় যাবতীয় সহায়তা দাবী করেন। ইন্দ্রাণী মুখার্জী জানিয়েছে, সে পরবর্তীতে কার্তি চিদম্বরমের সাথে দেখা করলে কার্তি তার কাছে দশ লক্ষ ডলার দাবী করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৮-র ফেব্রুয়ারীতে কার্তি চিদম্বরমকে গ্রেফতার করা হয়, যদিও তার জামিন হয়ে যায় বিনা তদন্তেই। চলতি বছরের ২৫শে জানুয়ারি পুনরায় এই মামলার বিচার শুরু হয় এবং ২০শে আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট চিদম্বরমকে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করে যার ভিত্তিতে গতকাল তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
২জি দুর্নীতি থেকে শুরু করে যত বড় বড় আর্থিক কারচুপিতে জড়িয়ে আছেন চিদম্বরম ও তাঁর সতীর্থরা, তার কাছে এই ঘটনা অতীব নগণ্য। এখন দেখার বিষয় হল এই ফিল্মী কায়দায় গ্রেফতারী কী শুধুই চিদম্বরমের জন্য? নাকি আর্থিক কারচুপির অভিযোগের খাতায় থাকা প্রত্যেকের সাথেই এই ঘটনা ঘটবে? যদি ঘটে, তবে তা কী শুধুই বিরোধী নেতাদের ক্ষেত্রে, নাকি বিজেপি নেতাদের ক্ষেত্রেও ঘটবে, বিশেষত যেখানে জেটলি অ্যান্ড সীতারামন কোম্পানি নোটবন্দীর সময় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তথ্য বিকৃতিতে অভিযুক্ত? নাকি এর কিছুই হবে না, অভ্যন্তরীণ সমঝোতা ছাড়া? প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, কেন ২০ তারিখে নির্দেশ জারি করে ২১ তারিখে করা হল গ্রেফতার? একটি দিন সারা দেশের সংবাদ মাধ্যমকে রমরমিয়ে নিজেদের বাজার চালানোর মোক্ষম একটি বিষয় তুলে দিয়ে গোটা দেশকে তাতে মশগুল করে রাখা হল। আর অন্য দিকে দিল্লীর রাজপথ কাঁপিয়ে চলল কাতারে কাতারে দলিত-আদিবাসীদের মিছিল। চিদম্বরমের গ্রেফতারির খবরের শোরগোলে চাপা দিয়ে দেওয়া হল দেশের তামাম শোষিত- অত্যাচারিত দলিতদের আর্তনাদকে।
ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন…