[শিয়ালদহ নর্থের মেইন লাইনে ৯-১৬ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত প্রচুর ট্রেন বাতিল হওয়ায় যাত্রীরা প্রচন্ড অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। একই সময়ে টালা ব্রিজ ভাঙার কাজ শুরু হওয়ায় বাস রুটেও নাকাল সাধারণ যাত্রীরা। টালা ব্রিজ সম্পর্কিত একটি পর্যালোচনা ইতিমধ্যেই ‘জবরদখল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে মারামারি ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছানোর প্রেক্ষাপটে জেনে নেওয়া যাক রেল পরিষেবার এই সংকটের নেপথ্যে আসল কারণগুলি কি। নিম্নলিখিত সাক্ষাৎকারটি একজন রেল কর্মচারীর (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। তিনি সাউথ ইস্টার্ণ রেইলওয়ের একটি টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অফিস সুপারভাইজার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সৌম্য ঘোষ।]  

১. শিয়ালদহ নর্থের মেইন লাইনে ৯-১৬ই ফেব্রুয়ারী অবধি প্রায় ৩০০-র কাছাকাছি ট্রেন বাতিল করার কারণ কি?

এটা রেলের ইন্টারলকিং কাজের জন্য হচ্ছে। এতে যাত্রী পরিষেবা হ্যাম্পার হচ্ছে। শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে। যদিও রেলের কর্মীর বিপুল অভাব বজায় থাকলে এইরকম ঘটনা বার বার হবে। তাছাড়া এনআরসি বিক্ষোভের সময়ে গেদে লাইনে যে রেলের সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে তার প্রভাব এখনও চলছে। এর ফলে এখনও অনেক গেদে যাওয়ার ট্রেন ক্যান্সেল হচ্ছে।

২. রেলের কর্মী নিয়োগ ঠিক মত হচ্ছে? বর্তমান কর্মীদের উপর কাজের চাপ কিরকম?

রেলের কর্মী নিয়োগ বহুদিন ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। টেকনিক্যাল স্টাফ, এমার্জেন্সি স্টাফ কিছু কিছু নিচ্ছে। যেমন, গার্ড, ড্রাইভার, সিগনাল ম্যান… যেটুকু না নিলে সিস্টেমটা আর চালানো যাবে না, তার বাইরে কোনো রেক্রুটমেন্ট হচ্ছে না। টেকনিক্যাল স্টাফের কোনও প্রশিক্ষণ হচ্ছে না যা কার্যক্ষেত্রে ভয়ানক দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। অফিশিয়াল কাজের স্টাফ তো নেওয়াই হচ্ছে না। ২০১৬ সালে গ্রুপ-ডি স্টাফ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ট্রাক ম্যান ইত্যাদি… অল্প কিছু জনকে নিয়েছে। যাদের নিয়েছে তারা সব উচ্চ শিক্ষায় উত্তীর্ণ ছেলেমেয়ে। তারা ওই পোস্টে কাজ করছে! মাইনে খুবই কম এদের। রেলের বাজেট পর্যবেক্ষণ সেকশানে আগে পাঁচজন ছিল। সেখানে এখন দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্ল্যানিং সেকশানে আঠেরো জন ছিল। এখন দাঁড়িয়েছে তিন জন। পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে, বর্তমান কর্মীদের উপর চাপ বাড়ছে। তারা প্রেশার না নিতে পেরে ভিআরএস নেবে বলছে। অফিসাররা সারাক্ষণ গালিগালাজ করছে। কর্মী নিয়োগ না হওয়ার চাপে অটোম্যাটিক স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ভিআরএস নিলে সরকারের কিছু সুবিধা দেওয়ার কথা কিন্তু রেলের ক্ষেত্রে সেরকম কোনও চিন্তাভাবনা সরকারের নেই। সাধারণ স্টাফেরাই কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে অবসর নিতে চাইছে কিন্তু সুযোগ সুবিধার অভাবে পিছিয়ে আসছে। কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছে।    

৩. রেলের আয় কমছে কেন?

প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে রেলের কোনও আয় হয় না, সরকারী ভর্তুকিতে চলে। রেলের আয় হয় মাল গাড়ি অর্থাৎ পণ্য সরবরাহ থেকে। দীর্ঘদিন ধরে পণ্য সরবরাহের খাতে বরাদ্দ টাকা ও পরিকল্পনার অভাব এবং সরকারের অবহেলার ফলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় সড়কে ট্রাক ও লড়ি নির্ভর পণ্য সরবরাহের উপর সরকারী নজর এই অবহেলার প্রত্যক্ষ কারণ। এবারের বাজেটে কৃষিতে বিশেষ জোড় দেওয়ার ফল স্বরূপ কৃষি পণ্য সরবরাহের খাতে টাকা বরাদ্দ হয়েছে রেল বাজেটে। কতটা বাস্তবায়ন হয় সেটাই এখন দেখার।  

৪. রেল পরিষেবা প্রাইভেট করে দিলে কতটা লাভ হতে পারে? ‘তেজাস’ সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

লাভ কিছুই হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলছি… ধরো প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ক্ষেত্রে… প্যাসেঞ্জার ট্রেনে রেলের কোনও আয় হয় না। ফলে, যে প্যাসেঞ্জার পরিষেবার দায়িত্ব প্রাইভেট সংস্থাগুলি নেবে তাতে তারা কত লাভ করতে পারবে? প্রাইভেট, ঝাঁ চকচকে ‘তেজাস’… ওইসবেরই প্রচার থাকবে। এতে আখেরে রেলের কোনও লাভ হবে না। যাত্রীরা ‘তেজাস’-এ যাবে কেন? যারা অ্যাফোর্ড করতে পারবে তারা তো প্লেনে যাবে। ট্রেনে কেন যাবে? যদি অতিরিক্ত বেশী লাগেজ থাকে, তখন হয়তো যেতে পারে। তবুও সংখ্যাটা মুষ্টিমেয়। ফলে, সরকার বা প্যাসেঞ্জারের কোনও লাভই হবে না। এটা আসলে কিছু প্রাইভেট সংস্থাকে পাইয়ে দেওয়া। তাছাড়া, দেখো, সাফাইয়ের কাজ তো প্রাইভেট সংস্থাদের দিয়েছে কিন্তু ট্রেনগুলো কতটা নোংরা হয়ে থাকছে তা তো যাত্রীদের কমপ্লেনের বহর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যাটারিং-ও তো প্রাইভেটদের দিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাতে সামান্য ডিম ভাত এখন ৭০টাকা নিচ্ছে!

. রেলে ঠিকা শ্রমিকদের অস্তিত্ব আছে?

ঠিকা শ্রমিকরা পার্মানেন্ট স্টাফ নয়। রেল এজেন্ট মারফৎ এঁদের কাজে লাগায়। এজেন্টরা মিনিমাম টাকায় এঁদের খাটিয়ে নেয়। রেলের প্রতিটা ক্ষেত্রেই ঠিকা শ্রমিক নিযুক্ত হচ্ছে। সাফাই কর্মী, গ্যাং ম্যান, গার্ডেন, রেলের হাঁসপাতাল প্রভৃতি কাজের ক্ষেত্রে এখন ঠিকা শ্রমিক দিয়ে চালানো হচ্ছে। তাঁদের গ্র্যাচুয়িটি দিতে হবে না, পেনশান দিতে হবে না… অর্থাৎ রেলের কোনও সুযোগ সুবিধাই তাঁরা পাবেন না। কিন্তু এই কাজ পাওয়ার জন্যই কত লোক চেষ্টা করছে। সাফাই, বিল্ডিং মেইন্টেন্যান্স, এমনকি কিছু কিছু রেলের ওয়ার্কশপেও ঠিকা শ্রমিক নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। এতে সুবিধা হল, ওঁরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন না; কোনোরকম ভাবে সংগঠিত হতে পারবেন না। ফলে, ওঁদের দিয়ে যত খুশী খাটাও, দরকার হলে বের করে দাও… কেউ বলার নেই…    

. এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে রেল ভিত্তিক সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

রেল বাজেটের পিন বুকটা পেলে চিত্রটা পরিষ্কার হবে। এবারের বাজেটে রেলের বহু প্রকল্পতেই বরাদ্দ টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্র্যাক ডাব্লিং, ব্রিজ ও লেভেল ক্রসিং, প্যাসেঞ্জার অ্যামেনিটিস ইত্যাদি প্যারামিটার বলে দিতে পারবে কাজ এগোবে কতটা। যেমন, ট্র্যাক ডাব্লিং-এ আগের অর্থবর্ষের তুলনায় এবছরের বরাদ্দ বলে দেবে সেকেন্ড লাইন, থার্ড লাইন প্রভৃতি তৈরির ভবিষ্যৎ। হাসনাবাদের সিঙ্গেল থেকে ডবল লাইনে রূপান্তর এই প্যারামিটারের উপরেই নির্ভরশীল। আবার নিউ ব্যারাকপুরের মত স্টেশানে পুরটা শেড দেওয়া হবে কিনা তা প্যাসেঞ্জার অ্যামেনিটিসে বরাদ্দ টাকা থেকে বোঝা যাবে।

[পাঠকদের বোঝার জন্য নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেইলওয়ের বাজেট পরিসংখ্যান নীচে দেওয়া হলঃ

অর্থাৎ নতুন প্রকল্পের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।]

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *