[জবরদখল ডেস্কঃ দেশপ্রেমিক বিজেপি সরকারের দেশপ্রেম উথলে উঠছে দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগে। দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তাঁর সমস্ত দেশপ্রেম উজার করে প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশী বিনিয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরেই, তারই পরিণত রূপদান করতে এবারে সরাসরি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির নিগমীকরণের (আদতে বেসরকারিকরণ) প্রস্তাব নিয়ে এলেন তিনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক-এর সুপারিশে ক্যাবিনেট কমিটি এবং ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীদের তরফ থেকে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ৪১টি শাখা এবং আনুষঙ্গিক আরও ১৫টি সংস্থার নিগমীকরণের পরিকল্পনার প্রস্তাব করেন। এবং এরপরই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে নিজেদের বক্তব্য এবং দাবীদাওয়া তুলে ধরে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির বিভিন্ন কর্মী সংগঠনঃ কনফেডারেশান অফ ডিফেন্স রেকোগ্নাইজড অর্গানাইজেশান্স (সিডিআরএ), অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশান (এআইডিইএস), ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ওয়ারকার্স অ্যাসোসিয়েশান (আইএনডিডব্লুএ) এবং ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘ (বিপিএমএস)। ১৪ই আগস্ট বৈঠকে কর্মীরা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবী জানান এবং এও জানান যে বেসরকারিকরণ ঘটলে তা দেশের প্রতিরক্ষা এবং অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সংকট তৈরি হবে।  বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সমস্ত শাখায় লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলেও প্রতিরক্ষা বিভাগ বা অর্ডিন্যান্স কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই বিষয়ে কোনো সদুত্তর না মেলায় ২০শে আগস্ট থেকে দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করে সবকটি কর্মী সংগঠন। চাপের মুখে পড়ে প্রতিরক্ষা সচিব ২২শে আগস্ট বলেন যে একটি বিশেষ উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের মাধ্যমে সমস্ত কর্মী সংগঠনগুলির সাথে আলোচনা চালানো হবে। তার পরেও ২৫শে আগস্ট পর্যন্ত ধর্মঘট চলতে থাকে। অবশেষে কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ আশ্বাসে তাঁরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। কমিটি গঠিত হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর মিটিং-ও বসে কিন্তু কোনও ঐক্যমত্যে আসতে পারা যায়নি। সরকার এই প্রসঙ্গে এখনও কোনও লিখিত নির্দেশিকা প্রকাশ না করলেও প্রেস বিবৃতিতে বেসরকারিকরণের উল্লেখ করেছে। যেহেতু লিখিত নির্দেশিকা মানেই বেসরকারিকরণ বলবত হয়ে যাবে, তাই কর্মী সংগঠনগুলি সরকারের কাছে বেসরকারিকরণ না করার লিখিত আশ্বাস চায়। সংস্থাগুলির আধুনিকীকরণ বা পুনর্গঠনে আন্দোলনকারীদের সায় থাকলেও সরকারি প্রেস বিবৃতিতে উল্লিখিত “প্রস্তাবিত নতুন এনটিটি” এবং শ্রমিকদের দাবীর উপর আলোচনার ক্ষেত্রে ওই শব্দবন্ধনী ব্যবহারে আপত্তি জানান তাঁরা। বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা হলেও কোনও উত্তর মেলেনি। ৩০শে সেপ্টেম্বরের মিটিং-এ সরকার পক্ষ কর্পোরেট স্ট্রাকচার সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে কর্মী সংগঠনগুলির বিরোধিতায় তা ভেস্তে যায়। গেরুয়া সরকার একেবারে প্রাথমিক পর্ব থেকেই প্রতিরক্ষা বিভাগে বিদেশি বিনিয়োগে সর্বাধিক মনযোগী ছিল। বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সরাসরি বেসরকারিকরণ, উভয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বিভাগের শক্তিবৃদ্ধি, স্বাধীনতা রক্ষার ভাঁওতার আড়ালে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিকে কার্যত অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কারণ, দেশীয় সংস্থার তুলনায় বিদেশী সংস্থার সাথে কোনো প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সরকার এবং বিভাগীয় প্রধানদের স্বার্থকে তুষ্ট করে। অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলি তাদের কাজের বরাত পায় নমিনেশানের ভিত্তিতে। বেসরকারিকরণ হলে তারা আর কাজের বরাত পাবেনা কারণ সামরিক অফিসারদের একটা প্রবণতাই থাকে বিদেশী ভেন্ডারদের বরাত দেওয়ার যার ভিত্তিতে তাঁরা তাঁদের রিটায়ারমেন্টের পর নিজেদের আর্থিক সুরক্ষা ও স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে পারবেন। তাছাড়া বিদেশী ভেন্ডারদের দেশীয় প্রাইভেট ভেন্ডার যেমন রিলায়েন্স, মাহিন্দ্রা, এল অ্যান্ড টি ডিফেন্স, ভারত ফোর্জ প্রাইভেট লিমিটেড, টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস এবং টাটা ডিফেন্সের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধা থাকে। এর বাইরে রয়েছে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট’-এর চাপ যা আদতে ডিআরডিও-র দায়িত্বে এবং যেখানে এ বিষয়ে ডিফেন্স ফ্যাক্টরিগুলির কোনও পারদর্শিতাই নেই। আর পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের হাতছানি তো গোদের উপর খাঁড়ার ঘা। প্রাইভেট সংস্থাগুলি এর মাধ্যমে ডিফেন্স ফ্যাক্টরিগুলির কর্মীদের কাজে লাগিয়ে, নিজেদের অতি স্বল্প কর্মী সংখ্যার বাধা অতিক্রম করে মুনাফা লুটবে আর খেটে মরা ডিফেন্স ফ্যাক্টরির কর্মীরা থেকে যাবে অন্ধকারেই।  এই প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হল উত্তর প্রদেশের কোরবা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সাথে কালাশনিকভ কন্সার্নের ‘ইন্ডো রাশিয়ান রাইফেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ হিসেবে কাজের শুরু।  আন্দোলনের চাপেই মোদী সরকার তার ১০০ দিনের অ্যাজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও এখনও বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে পারেনি। সরকারি আমলারা যদিও হুমকি দেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। কর্মী সংগঠনগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাঁরা সরকারের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং দীপাবলী উৎসবের পরে তাঁরা পুনরায় আন্দোলনের পথে হাঁটবেন। বর্তমান যুদ্ধ জিগীর ও গেরুয়া শিবিরের মেকি দেশপ্রেমের প্রেক্ষাপটে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে এই লড়াই আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নীচে রইল একজন আন্দোলনকারীর বক্তব্য।]

এআইডিইএফ-এর সাধারণ সম্পাদক সি শ্রীকুমারের বক্তব্য শুনত ক্লিক করুন এই লিঙ্কেঃ https://www.youtube.com/watch?v=ECfwgEjbwlg&t=30s

## STOP CORPORATIZATION ## STOP PRIVATIZATION ## STOP DISINVESTMENT ##
## SAVE ORDNANCE FACTORIES ## SAVE DEFENCE OF INDIA ## SAVE THE NATION ##

বিগত কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে নিগমিকরণ এবং বেসরকারীকরণের যে হিড়িক উঠেছে তাতে করে এযাবৎ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দুস্তান মোটোরস, হিন্দুস্তান কেবলস, মিন্ট, বি এস এন এল, বি ই এম এল, হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড, বেঙ্গল কেমিক্যালস সহ এয়ার ইন্ডিয়া ও ভারতীয় রেল এর মতো সংস্থাগুলি এবং সেখানে কর্মরত লক্ষ লক্ষ কর্মচারী । বিপুল ক্ষতির মুখে ও এন জি সি এর মতো সংস্থাও । দেশে বেরোজগারী আজ চরমে পৌঁছেছে, অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে । বিপুল আর্থিক ক্ষতির ভার বহন করতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হতে চলেছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড়োমাপের শিল্পসংস্থাগুলি । সম্প্রতি এক খবরে আরোও জানা গেছে যে ও এন জি সি, আই ও সি এল, জি এ আই এল, বি এইচ ই এল, এন টি পি সি, এন এইচ পি সি, এন এম ডি সি এর মতো নিগমী সংস্থাগুলিকেও চিহ্নিত করা হয়েছে আগামী পাঁচ বছরে ৩.২৫ লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্রায়ত্ত অংশ বিক্রি করার জন্য ।

  এবার নিগমিকরণের থাবা পড়েছে ২১৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিরক্ষা উৎপাদন সংস্থা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস এর উপরেও । সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ তৈরী হয়েছে এই সংস্থায় কর্মরত ৮২০০০ কর্মচারীদের মধ্যে । এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একমাসব্যাপী ধর্মঘটে নেমেছিল তিনটি প্রতিরক্ষা ফেডারেশন এ আই ডি ই এফ, আই এন ডি ডব্লিউ এফ এবং বি পি এম এস । বিগত কয়দিনে প্রতিরক্ষা উৎপাদন সচিব ও প্রতিরক্ষা সচিবের সাথে তিনটি ফেডারেশনের কয়েকদফা আলোচনা হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারি আধিকারিক ও ফেডারেশনগুলোকে নিয়ে একটা কমিটি গঠন করে এই ব্যাপারে পর্যালোচনা করা হবে । আপাতত, ধর্মঘট স্থগিত । অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিকে নিগমিকরণ না করা নিয়ে কমিটির সিদ্ধান্ত ও সর্বোপরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ফেডারেশনগুলি ।

২১৮ বছর আগে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাকে চাঙ্গা করতে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন দেশের অভ্যন্তরে স্বাবলম্বিভাবে করার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল প্রতিরক্ষা উৎপাদন সংস্থা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির । বর্তমানে দেশজুড়ে ৪১টি ফ্যাক্টরি, ৯টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ৩টি সুরক্ষা কেন্দ্র সমেত কোলকাতাস্থিত মুখ্যালয় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড সর্বমোট ৮২০০০ কর্মচারী নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের প্রতিরক্ষা বলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনের কাজ গৌরবের সঙ্গে করে চলেছে । কার্গিল যুদ্ধ হোক কিংবা চীন যুদ্ধ হোক অথবা দেশের জরুরী পরিস্থিতি হোক, যখন যখন দরকার পড়েছে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে । সেইজন্যই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিকে প্রতিরক্ষার চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় ।  অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির অবদান শুধুমাত্র দেশের বর্ডারেই সীমিত থাকেনি, উচ্চমানের বিস্ফোরক সরবরাহ করে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।

অনেকেই হয়তো জানেননা দেশের প্রতিরক্ষার স্বার্থে প্রতিনিয়ত অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস ঠিক কি ধরনের গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে । তার কারণ, সুরক্ষার খাতিরেই নিজস্ব উৎপাদন ও ভূমিকা সম্বন্ধে গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করা হয় বলে খবরে বিশেষ আসেনা । বন্দুক, গোলা বারুদ, স্মল আর্মস, তোপ, গ্রেনেড থেকে শুরু করে প্যারাশ্যুট, মিলিট্যারি জ্যাকেট, নাইট ভিশন, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, মিলিট্যারি ট্যান্ক, মিশাইল, রকেট লঞ্চার ইত্যাদি ইত্যাদি – অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির উৎপাদনের ভান্ডার বিশাল । অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির সাম্প্রতিক কিছু উৎপাদনের মধ্যে যেগুলো অন্যতম এবং দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে তার একটা ছোট্ট তালিকা নীচে দেওয়া যেতে পারে –

• অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি মেডাক এবং ডি আর ডিও যৌথ উদ্যোগে নির্মিত প্রথম এন বি সি ভেহিক্যাল যা ভারতীয় সেনাকে দেওয়া হয়েছে ।

• ১৫৫ x ৪৫ ক্যালিবার বন্দুক যা পোখরানে সফল পরীক্ষণের পর ভারতীয় সেনাকে দেওয়া হয়েছে ।

• কবচ এম ও ডি-২ শ্যাফ লঞ্চার যা সফল পরীক্ষণের পর ভারতীয় নৌসেনার আই এন এস চেন্নাই এ ইনস্টল করা হয়েছে ।

• ৭.৬২ x ৩৯ অ্যাসল্ট রাইফেল ঘাতক যা এ কে-৪৭ ওর পরিপূরক ।

• বাই মডিউলার চার্জ সিস্টেম (বি এম সি এস) যা ভারতীয় সেনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ।

• অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির নবনির্মিত ১৫৫ x ৪৫ ক্যালিবার সর্বোৎকৃষ্ট বন্দুক ধনুষ ২০১৭ সালে দিল্লিতে পালিত সাধারণতন্ত্র দিবসের প্যারাডে প্রদর্শন করা হয়েছিল ।

• অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির সরবরাহ করা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং উচ্চমানের বিস্ফোরক তথা স্পেশ্যাল গ্রেড আর ডি এক্স সম্প্রতি ইসরোর চন্দ্রযান উৎক্ষেপণে সফল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।

(আরোও বিস্তারিত জানতে উইকিপিডিয়া লিংক: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ordnance_Factory_Board তে দেখুন).

অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো সঠিক অর্থে দেশের ও জাতির স্বার্থে পরিষেবামূলক কাজে নিযুক্ত । তাই শুধুমাত্র লাভের অঙ্কে এইসব সংস্থাগুলোকে বিচার করা যথাযথ নয় । আর পরিষেবার অঙ্কে দেখলে এইসব সংস্থাগুলোর কৃতিত্বে কোনও খামতি নেই । হ্যাঁ, প্রতিযোগিতার বাজারে জায়গা কিছুটা পিছিয়ে, কিন্তু সেটা সরকারী নিয়ম ও স্বল্প পরিসীমায় কাজ করতে হয় বলে । সেটা দূর করতে হলে এই সংস্থাগুলোর নবিনীকরণ ও আধুনিকিকরণের প্রয়োজন । অথচ ভারত সরকার এই সংস্থাগুলোকে নিগমিকরণ, বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারীকরণের পথে হাঁটছে । এখানে প্রশ্ন উঠছে , কেন ? কেন নিয়মের জাল সরিয়ে সরলীকরণের রাস্তায় না গিয়ে, কাজের পরিসরে অধিক স্বাধীনতা না দিয়ে সোজাসুজি এই সংস্থাগুলোর কর্মদক্ষতাকে দায়ী করা হচ্ছে ? এইভাবে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর নিগমিকরণ, বিলগ্নিকরণ কিংবা বেসরকারীকরণের ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে কেন তা ভাবা হচ্ছেনা ? আধুনিক পরিষেবার ক্ষেত্রে বি এস এন এল কে ছাড়পত্র দেওয়া হলে কি আজ বি এস এন এলের এই দুর্দশা হতো ? যে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড ভারতীয় বায়ুসেনাকে তেজস এবং সুখোই এর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান উপহার দিয়েছে সে কি রাফাল বানানোর যোগ্যতা রাখেনা ? রাফালের বরাত রিলায়েন্সকে দেওয়ার পিছনে কি যুক্তি আছে তা আমাদের সরকারই জানে । এই প্রশ্নটা তাই অমূলক নয়, তবে কি রিলায়েন্সের স্বার্থ দেখতে গিয়ে বি এস এন এল এবং হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেডের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর প্রতি সৎমাতৃত্বসুলভ আচরণ করা হচ্ছেনা ?

ঠিক এই সৎমাতৃত্বসুলভ আচরণটাই করা হচ্ছে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির সাথেও । ভারত সরকারের নিম্নলিখিত প্রতিক্রিয়াগুলি থেকে সুস্পষ্টভাবে এই চিত্রই উঠে আসছে কিভাবে বিগত কিছু সময় ধরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিকে দুর্বলতা এবং অসুস্থতার শিকার করা হচ্ছে –

(১) নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়ায় উৎপাদনের সাথে যুক্ত কর্মচারী সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে । আগে যেখানে ১৭২০০০ কর্মচারী উৎপাদনের কাজ করতেন এখন সেটা ৮২০০০ এ ঠেকেছে ।

(২) কোর এব নন কোর আইটেম ভাগ করে ২৭৫ টি নন কোর আইটেমকে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির উৎপাদন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে । ঐ আইটেমগুলি নাকি অন্য কোনো জায়গা থেকে কেনা হবে ।

(৩) ভারতীয় সেনা আগে যেখানে দরকারের অধিকাংশটাই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিকে বরাত দিয়ে নিতো সেখানে এখন তাদের যেকোনো বেসরকারী কোম্পানির থেকে কেনার ছাড়পত্র দেওয়ায় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস দরকারের মাত্র ৩৫ শতাংশ বরাত পাচ্ছে ।

(৪) সাম্প্রতিক বাজেটগুলোতে প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাতে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির জন্য আশ্চর্যরকম কম বাজেট তথা ফান্ড বরাদ্দ করা হয়েছে । অন্যদিকে, ডিফেন্স অ্যাক্যুইজিশন কাউন্সিলকে বেশি বেশি ফান্ড বরাদ্দ করা হচ্ছে বেসরকারি ও বিদেশি উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য ।

(৫) প্রতিরক্ষা সেক্টরে এফ ডি আই নীতি আরোপ এবং অস্ত্র আইন ২০১৬ প্রনয়ন করে প্রতিরক্ষা অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদনে বেসরকারী সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির গুরুত্ব লঘু করে দেওয়া হয়েছে ।

(৬) অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও সংগ্রহের গুনগত মান বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল এবং অসঙ্গত নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং গুণমান নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে । এখানে বলা দরকার যে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির উৎপাদন সম্বন্ধিত রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট এর দায়িত্বে থাকা ডি আর ডি ও সংস্থার ক্ষেত্রেও সুষ্পষ্ট নীতি না নেওয়ার ফলে ডেভেলপমেন্টের দিক থেকেও মার খাচ্ছে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির উৎপাদন ব্যবস্থা । আবার, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদন প্রণালী এবং অন্তিম প্রোডাক্টস এর গুণমান নির্ধারণ ও পরীক্ষণের ভার যেখানে আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন ডি জি কিউ এ এবং এস কিউ এ ই সংস্থার উপর সেখানে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিস ও তার উৎপাদনের প্রতি অভিযোগ করাটা ভিত্তিহীন । কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে আর্মির পক্ষ থেকে সেই ভিত্তিহীন অভিযোগই প্রচার করা হচ্ছে, এর মধ্যে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভাবমূর্তি খারাপ করার চেষ্টাই চোখে পড়ে ।

(৭) দীর্ঘসময় ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে প্রোমোশন আটকে থাকায় ফ্যাক্টরিগুলোতে এক ধরনের অসঙ্গত অনুপাত তৈরী হয়েছে, কাজের ক্ষেত্রে একটা অসম বন্টন দেখা দিয়েছে ।

(৮) ক্রয়, ঠিকা পঞ্জিকরণ, সাপ্লাই অর্ডার ইত্যাদি বিষয়গুলির ক্ষেত্রে নিয়ম ও কার্য্যপ্রণালীর কঠোরতার কারণে উৎপাদন ব্যবস্থা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত । প্রত্যেকবার ওপেন টেন্ডার এবং ভেন্ডর ডেভেলপমেন্ট এর দরুণ অভাবনীয় দেরীর মাশুল গুনতে হয় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলোকে ।

এইভাবে, বিভিন্ন দিক দিয়ে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলোর কাজের পরিধি বিগত কয়েক বছরে খুবই সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে ।

ঈদানীং বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একদিকে বেসরকারী শিল্পসংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে উঠছে এবং সেগুলোকে বেশি বেশি উৎসাহিত করা হচ্ছে আর অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো অবহেলার পাত্র হয়ে উঠছে । ব্যাবসার স্বার্থে নিয়ম নীতিও এমনভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করতে এবং নিয়মের ঘেরাটোপে ও রুগ্নতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে । বেসরকারি সংস্থাগুলি কাস্টমস ও এক্সসাইজ ডিউটি দিচ্ছে এই যুক্তি দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকেও একই নিয়মের আওতায় নিয়ে আসা হলো, কিন্তু অন্যান্য যেসব নিয়ম, বাধা নিষেধ, সংরক্ষণ অথবা সামাজিক দায়িত্ব ও জনকল্যাণমূলক আচারবিধি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো মেনে চলে বেসরকারি সংস্থাগুলি তার থেকে মুক্ত । এটা দ্বিচারিতা ছাড়া আর কি ? সুতরাং, তুলনাটা সেই অর্থে মোটেই ঠিক নয় । আসলে সরকারের মনোভাবটাই হয়ে উঠেছে নিজের কাঁধ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বোঝা হালকা করা, তাই নিগমিকরণ, বিলগ্নিকরণ এবং বেসরকারিকরণ ছাড়া কিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবাই হচ্ছেনা ।

এখন, ভাববার বিষয় এটাই যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর এই নিগমিকরণ বা বিলগ্নিকরণ কিংবা বেসরকারিকরণের ফল কি হতে পারে । নিগমিকরণ করা হলে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভাগ্যই বা কি হবে ? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে খুবই তাড়াতাড়ি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে । বি এস এন এল দেখুন, বি ই এম এল দেখুন, হিন্দুস্তান মোটরস দেখুন কিংবা ও এন জি সি এর মতো সংস্থাকে দেখুন । আমাদের দেশে নিগমিকরণ সবক্ষেত্রেই ব্যর্থ, কোনটা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনটা ধুঁকছে, কোনটা আর্থিক ক্ষতির ভারে জর্জরিত এবং বন্ধপ্রায় । এই সংস্থাগুলির তুলনায় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ব্যাবসার পরিসর তো অত্যন্ত সীমিত । অতএব, নিগমিকরণের পরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ভবিতব্য অবশ্যম্ভাবীভাবে মৃত্যু । প্রথমে নিগমিকরণ, তারপর বিলগ্নিকরণ আর তারপর শেষ পরিণতি মৃত্যু । এর ফলে যে শুধু ৮২০০০ কর্মচারীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত তা নয়, সমগ্র দেশ এবং জাতির জন্যও এক ভয়ানক অভিশাপ নেমে আসবে । দেশের সেনাবাহিনীকে যেমন প্রতিরক্ষার দরকারে অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করতে হবে তেমনই দেশ ও জাতি অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার শিকার হবে । বেরোজগারী এবং চাকরির সুরক্ষাহীনতা বাড়বে, কাজ হারাবে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসংস্থায় কাজ করা লোক । জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হবে । আগামী প্রজন্মের কাছে পরিষেবা নামক ধারণাটাই আদৃশ্য হয়ে যাবে । সমাজ এবং জাতি চলবে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের মনোভাব এবং টাকার কারবারের বশে । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা সবকিছুই কুক্ষিগত হবে ব্যবসায়ীদের কবলে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি রেল, বেসরকারি সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা – চারিদিকে পয়সার বোঝা, বিনিময়ে পরিষেবা । অভিশাপ ছাড়া আর কি ?

তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে নিগমিকরণ, বিলগ্নিকরণ অথবা বেসরকারিকরণ কতটা খারাপ পদক্ষেপ । এখন প্রতিরক্ষা উৎপাদনের মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে যেভাবে বেসরকারি আগ্রাসন বাড়ছে তা ভাবতে বাধ্য করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও তার ফলাফল সম্বন্ধে । আমেরিকা, রাশিয়া, কোরিয়া, ইসরায়েলের মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের আর যেসব দেশের নিজস্ব প্রতিরক্ষা উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় এবং প্রয়োজনের অধিকাংশটাই বেসরকারি ও বিদেশি নির্মাতাদের থেকে আমদানি করে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করতে হয় সেইসব দেশের সরকারকে । এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বড়ো বড়ো অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণী কোম্পানিগুলি আজ ব্যবসায়িক স্বার্থলাভে মত্ত । আজ বিশ্বজুড়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও ইন্ধনের কারণেই পাশ্চাত্য দেশগুলি যুদ্ধ পরিস্থিতির শিকার । এইসব থেকে শিক্ষা নিয়ে শোধরানোর পরিবর্তে কেন আমরা সেই পুনরাবৃত্তির পথই অনুসরণ ক‍রছি ? অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির মতো ঐতিহ্যবাহী একটা প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাকে কোনোভাবেই নিগমিকরণ অথবা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয় । সরকারের এই পদক্ষেপকে ধিক্কার জানাই এবং এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করি ।

শিবশঙ্কর পাল

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *