আজ্ঞে হ্যাঁ, বাংলা ও বাঙালীর সংরক্ষণের নামে আরও একটি শিবসেনার জন্ম হয়েছে, এবার বাংলায়, যার পূর্বসূরীর প্রাথমিক উত্থান আশির দশকে। বর্তমান সময়ে এদের কার্যকলাপ আঞ্চলিকতাবাদের দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছে, আর বাঙালীদের মধ্যে ছড়ানোর চেষ্টা চলছে বিজাতিবিদ্বেষ।
এই সংস্কৃতির আদি সূচনা ‘আমরা বাঙালী’ নামক একটি রাজনৈতিক দলের হাত ধরে, যারা নিজেদের বাঙালী জাতীয়তাবাদী বলে দাবী করত। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, আসাম জুড়ে একদা বিস্তৃত ছিল তাদের সংগঠন। মূল ঘাঁটি ত্রিপুরায়। কেন এই সংগঠন? কী ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য? ‘আমরা বাঙালী’-র দাবী ছিল, বাঙালী অধ্যুষিত রাজ্যে অবাঙালীদের প্রবেশ এবং বসবাসই বাঙালীদের পিছিয়ে থাকার কারণ। বাঙালীদের ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ (!)’ এবং অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য অবাঙালীদের বিতাড়িত করা প্রয়োজন। এই বিদ্বেষমূলক রাজনীতির ফলেই আশির দশক থেকে এই দলের শক্তিক্ষয় হতে থাকে। বর্তমানে এরা সাইনবোর্ডের সমতুল্য।
বর্তমান ‘বাংলা পক্ষ’, বলা ভালো ‘তৃণমূল পক্ষ’ (কারণ এদের নেতারা তৃণমূল প্রসঙ্গে বেজায় পক্ষপাতপূর্ণ) একইসাথে বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বজরং দলের কেবল ‘হিন্দী’ আগ্রাসনকে (করপোরেট বা বর্ণ ব্যবস্থা কিন্তু ঘূনাক্ষরেও নয়) রোখার জন্য পাল্টা বাঙালী আগ্রাসন প্রয়োজন বলে দাবী করে! তারা এও দাবী করে যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কারণ অবাঙালীদের অবাধ বসবাস। বাঙালীদের কর্মসংস্থানের সংকটের জন্যেও তারা অবাঙালীদের দায়ী করে; তারা দাবী রাখে সমস্ত চাকুরীক্ষেত্রে বাঙালীদের ৮৫% সংরক্ষণের।
এবার সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। শুরুতেই বলে রাখা দরকার, বাংলা ভাষা বা বাঙালী কেউই অবলুপ্তপ্রায় নয়। বিশ্বের তিনটি দেশে বাংলা একটি স্বীকৃত অফিসিয়াল ভাষা (ভারত, বাংলাদেশ, সিয়েরা লিওন) এবং সারা বিশ্বে ৩০কোটিরও বেশি বাঙালী বসবাস করেন। এর কোনও দেশের মধ্যেই বাঙালী জাতি হিসেবে অন্য জাতির দ্বারা শোষিত বা নিপীড়িত নয়। বর্তমানে আসামে এনআরসি-র নামে যা হচ্ছে তা বিজেপির উগ্র আগ্রাসী পদক্ষেপ এবং আক্রমণের নিশানায় মূলত মুসলমান সম্প্রদায়। এর প্রতিকার রূপে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই না করে আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে যা খাড়া করা হচ্ছে তা আদতে একধরণের পাল্টা উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদই। মনে রাখা দরকার, তৃণমূলের ন্যায় এই ‘বাংলা পক্ষ’-ও এনআরসি প্রসঙ্গে কেবল হিন্দুদের নিয়েই চিন্তিত, বাকি ধর্মীয় সম্প্রদায় নিয়ে মোটেই নয়।
তাছাড়া, বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র সারা পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত। আর অবাঙালী পদবী দেখলেই বিজাতিবিদ্বেষী কটুক্তি করতে থাকা গর্গবৃন্দের জানা নেই যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মত সাহিত্যিকরাও কতটা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে।
তবে কী বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটেনি? বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে? ঘটেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু, কোনোভাবেই তা অবাঙালীদের বসবাসের কারণে নয়। যদি সেইভাবেই দেখা হয়, তাহলে প্রতিটি রাজ্যের প্রধান ভাষা, সেই সংস্কৃতি ও সেই ভাষাভাষী মানুষের জীবনও অবক্ষয়ের মুখে, যেহেতু ভারতের প্রতিটি রাজ্যেই সেই রাজ্যের প্রধান ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষ অবাধে বসবাস এবং জীবিকা নির্বাহ করে। সেই কাল্পনিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে গেলে প্রতিটি রাজ্যে শুধু এক ভাষাভাষী মানুষই থাকতে হবে এবং প্রতিটি রাজ্যকে এক একটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে, তুলতে হবে কাঁটাতার; যা যুদ্ধ নামক একটি বড় ব্যবসার আখড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রশ্ন উঠবেই যে বাংলা ভাষায় শিক্ষার বেহাল দশা নিয়ে কোনও তাপ উত্তাপ ‘বাংলা পক্ষ’-এর নেই কেন। সারা রাজ্য জুড়ে সরকারি বাংলা মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির বদলে অবলুপ্ত হচ্ছে (মনে রাখবেন, সরকারে কিন্তু রয়েছে ‘বাংলা পক্ষ’ সমাদৃত তৃণমূল কংগ্রেস) এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাজার গুছিয়ে দেওয়ার সরকারী নীতি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা গোটা রাজ্যের ৮০% বাঙালী পরিবারকে প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে। টিকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিকাঠামো, শিক্ষকের সংখ্যা, পাঠ্যক্রমের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আর যদি ওঠে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, সারা দেশব্যাপী কর্মসংস্থানের যা দশা, বাংলা তার ব্যতিক্রম নয়। এই নয়াউদারবাদী যুগে বেকারত্বের হার ক্রমে বেড়েই চলেছে এবং তার জন্য দায়ী বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের বিস্তৃত বসবাস নয়, তার দায় নয়াউদারবাদী অর্থনীতি এবং কেন্দ্রের অর্থনৈতিক অবস্থানের। অথচ, এই মূলগত সমস্যা এবং সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই বাংলার এই শিবসেনার। আসলে সমস্যার কারণ হিসেবে একটি মিথ্যে ছবিকে সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে তৃণমূল সরকারের দুর্নীতিকে চাপা দেওয়ার কাজই করে চলেছে এই ‘বাংলা পক্ষ’, যারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবী করে এবং যাদের সদস্যদের একটি বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসেরই কর্মী বা সমর্থক। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাংলা বাঁচানোর নাটকের আড়ালে বাংলাকে পেছন থেকে ছুড়ি মারার কাজটিকেই সম্পন্ন করতে মরিয়া ‘বাংলা পক্ষ’।

অন্যদিকে বজরং দল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ‘হিন্দী, হিন্দু, হিন্দুস্তান’ আগ্রাসনকে প্রতিহত করার নামে অবাঙালী, মূলত খেটে খাওয়া অবাঙালীদের ওপর যথেচ্ছাচার চালায় এই উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের দল। মার, দাঙ্গা, প্রকাশ্যে ও গোপনে হেনস্থা, যে বাংলা বলতে পারে না তাকে দিয়ে জোর করে বাংলা বলানো, তার মাতৃভাষার নামে অশ্লীল মন্তব্য করা, অবাঙালী পরিবারের বধূদের সম্পর্কে যৌন কটুক্তি এমনকি ধর্ষণেরও ইতিহাস আছে বাংলার এই রক্ষকদের। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে এদের কখনোই বজরং দল বা সংঘের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায় নি, যায় না। তাদের দেখা যায় সেই সংঘের প্রসাদতুষ্ট মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা ও তার নেতৃত্ব রাজ ঠাকরের সাথে রাজনৈতিক সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে।
সুতরাং, এ কথা একেবারেই স্পষ্ট যে জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি এবং তার মাধ্যমে সরকার তথা রাষ্ট্রের সমস্ত শোষণকে ধামাচাপা দিতেই সরকারের মদতপুষ্ট এই দলগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; ঠিক যেমন শিবসেনা, প্রথমে কংগ্রেসের এবং পরবর্তীতে বিজেপির ভজনার মাধ্যমে নিজেদের এবং সরকারে থাকার হিতে হিংসার রাজনীতি ছড়িয়েছে, শ্রমিক আন্দোলনের নেতাদের হত্যা করে এসেছে। ব্যাঘ্রমুখী ঝান্ডা থেকে জাতিবিদ্বেষী নীতি- সর্বত্র এই ব্যাপক সাদৃশ্যই রাজ ঠাকরে এবং বাংলার রক্ষকদের রাজনৈতিক মিত্রতা তৈরি করেছে যা একদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও অন্যদিকে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের গণবিরোধী রাজনীতিকে আড়াল করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভারতবর্ষ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, অর্থাৎ যে কোনো ভারতীয় দেশের যে কোনো জায়গায় অবাধে বিচরণ, বসবাস ও জীবিকানির্বাহ করতে পারেন। তার ওপরে, বিশ্বপুঁজির এই বাজারে যেখানে পুঁজির অবাধ বিচরণ চলছে, সেখানে শ্রমশক্তি তথা শ্রমিকের বিচরণও অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকদের বেহাল দশাও এই ব্যবস্থার একটি বাস্তবতা। তবুও নিস্তার নেই ভীন রাজ্যের এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর। বিজাতি নিদ্বেষের শিকার এরাই। ভীন রাজ্যের বড় ব্যবসায়ীরা আর্থিক লেনদেনে কারচুপি বা কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে যদিও মুখে কুলুপ আঁটে গর্গবৃন্দ। এই আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করতে আগ্রাসী।
কেন্দ্রের হিন্দী আগ্রাসন এবং তার বিরুদ্ধে রাজ্যের বাংলা আগ্রাসন, ‘জয় শ্রী রাম’ এবং তার বিরুদ্ধে ‘জয় মা কালী’ স্লোগান, আদতে একই মুদ্রার দুই পিঠ। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র রাজনীতিকেই ঘুরপথে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ‘বাংলা পক্ষ’-এর রাজনীতি আদতে পরিণত হয় বিজেপি-রই ভোট ব্যাঙ্কে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিষেবা ক্ষেত্রে সরকারের দুর্নীতিকে আড়াল করতে এই উভয় শক্তি আগ্রাসনমূলক হিংসাত্মক রাজনীতিকে ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং দাঙ্গার ফসল ফলায়। আর তাই এদের মূল শত্রু হয়ে ওঠে কমিউনিস্টরা, মারাঠা থেকে বাংলা সর্বত্র। যদিও কিছু মুখোশধারী বামপন্থী এদের প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে আত্মহননের পথে এগিয়ে চলেছে!
যে বাংলাদেশের উদাহরণকে এরা ব্যবহার করে নিজেদের রাজনীতিকে সঠিক প্রমাণের জন্য, তার পরিপ্রেক্ষিতের সাথে বর্তমান ভারতবর্ষের মারাঠা বা বাংলার বা ভারতবর্ষের যে কোনো জাতির সমস্যার পরিপ্রেক্ষিত একেবারেই আলাদা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং পন্থার সাথেও এই আগ্রাসনমূলক রাজনীতির রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
ভাষার স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার অর্থ অন্য ভাষার বা অন্য ভাষার মানুষের ওপর জুলুম নয়, সেই ভাষায় শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সেই ভাষার শিক্ষার মানকে উন্নত করার মাধ্যমেই তা সম্ভব। আর, তার ওপরে কর্মসংস্থান একটি সার্বিক সমস্যা, কোনো বিশেষ জাতির সমস্যা নয়। ফলত, সরকারের কর্মসংস্থান নীতির পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করে আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময় কমিউনিস্টরা ভাষাভিত্তিক রাজ্যবন্টনের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তা ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য, স্বচ্ছলতা ও সাংস্কৃতিক সুস্থতা রক্ষার খাতিরে। বিভাষা তথা বিজাতিবিদ্বেষ এবং ভাষাগত আঞ্চলিকতাবাদী প্রতিহিংসার ভিত্তিতে নয়, যা এই আঞ্চলিকতাবাদী দলগুলির মূল রাজনীতি। আর কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ভিন্ন ভাষাভাষীর কর্মীদের হেনস্থা না করে তামাম শোষিত শ্রমিক, কৃষক, কর্মীদের এবং কর্মহীন বেকারদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলে পুঁজিবাদী সরকারের ঘৃণ্য নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলাই সমাধানের একমাত্র পথ। পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে তাই আজ ডাক দিতে হবেঃ “দুনিয়ার মজদুর এক হও”।