শারদীয়া ও দীপাবলি উৎসবের রেশ কাটুক না কাটুক, কাটছে না বাজারে তৈরী হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা। ভবিষ্যৎ নির্ভর শেয়ার বাজারের ফাটকা কারবারের অর্থনীতির ওপর যে সঙ্কট প্রতিফলিত হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে, তা চোখে পড়ার মতো। আমাদের দেশও বাদ নেই লিস্টে। ইতিমধ্যেই বিপুল মন্দার সম্মুখীন হয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের বিক্রি বাট্টা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে উৎসবের আনন্দে হুজুগে মানুষের ভিড়ে ভাটা আর তার সাথে বিজ্ঞাপনের অভাবে বাঁশের কঙ্কালের উঁকি মারা বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে ‘রিসেশন’-এর ঘন্টা বাজছে এবং তা পুজোর ঢাকের চেয়ে অনেক বেশী জোরালো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলতে থাকা ‘ট্রেড ওয়ার’ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এই দুই দেশের সাথে আমদানী ও রপ্তানির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার ক্রাইসিস ট্রান্সফারের যে টানেল হয়ে উঠেছে ভারত, তাতেই জমতে শুরু করেছে ফাটকা কারবারের ময়লা। আর এই ময়লা ভর্তি হয়ে যখন টানেল ফেটে বেরুতে শুরু করছে তখন ধ্বসতে থাকছে একটার পর একটা ইন্ডাস্ট্রি। এর নিদর্শন পাওয়া গেছে ‘অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি’-র করুণ অবস্থায়। টালমাটাল অবস্থা থেকে খুব বেশী দূরে নেই আই.টি সেক্টর বা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।
এই অর্থবর্ষের প্রথম তিনমাসেই জিডিপি বৃদ্ধি নেমে এসেছে ৫ শতাংশে (সরকারি তথ্য অনুযায়ী), যা কিনা বিগত ছয় বছরে যে এই প্রথম তা সকলের জানা। অর্থনীতির ভাষায় নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (অর্থাৎ বাজারে লাগানো টাকা যা কিনা উঠে আসেনি)-এর অত্যাধিক বৃদ্ধি এবং এন.বি.এফ.সি (অর্থাৎ নন-ব্যাঙ্ক ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি যারা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে বাজারে প্রদান করে)-এর মধ্যে চলতে থাকা সঙ্কট ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে, যে আদতেও, এই টাকা উঠে আসবে তো? আর ঠিক সেই কারণেই তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ যা ভারতবর্ষের জিডিপি-র প্রায় ৭.৭ শতাংশ বহন করে তাকে এই সঙ্কট থেকে দূরে ভাবা যাচ্ছে না।
চলতি বছরের জুন মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ৮টি মূল শিল্পের ইন্ডেক্স অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন বা উৎপাদনের সূচক এসে দাঁড়িয়েছে ১৩১.৪, যা পূর্ববর্তী বছরের থেকে কোনোক্রমে ০.২ শতাংশ বেশী। এর মধ্যে খনিজ পেট্রোলিয়াম উৎপাদন (-৬.৮ শতাংশ) ও পেট্রোলিয়াম শোধন (-৯.৩ শতাংশ) শিল্পের অবনতি চোখে পড়ার মতো। তাই মূল শিল্পের এই বিপর্যয় পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোতেও যে ছাপ ফেলবে তা স্বাভাবিক। আর এরই উদাহরণ পাওয়া যায় যখন গ্লোবাল রিসার্চ বলছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের গ্রোথ রেট ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৩.৮ শতাংশ, যা কিনা আগের বছরও ছিল ৬.৭ শতাংশে। ভারতীয় স্টক মার্কেট থেকে প্রায় ২০,৫০০ কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনা অর্থনীতির প্রবল মন্দা পরিস্থিতিকেই নির্দেশ করছে। দেশের অর্থমন্ত্রী যতই এই বিপর্যয়কে আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, এই বিপুল মন্দাকে কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই তো রেপো রেট (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃক কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কগুলিকে প্রদত্ত সুদের হার) ৬ শতাংশ থেকে ৫.৭৫ শতাংশে নামার পরও লগ্নি বৃদ্ধি হচ্ছে না। ব্যাঙ্কগুলির করুণ দশাও একপ্রকার বাধ্য করছে সংযুক্তিকরণের পথে যেতে।
গোটা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের যে ৩০ শতাংশ দাঁড়িয়ে আউটসোর্সিং সার্ভিস-এর ওপর, তার ৬০ শতাংশ জুড়েই রয়েছে ভারতীয় কোম্পানী, যারা প্রায় ১৮০- ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি নিয়ে বসে আছে! তাই রিসেশন-এর আগমন হলে যে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে কীভাবে তার প্রতিফলন হবে তা বোঝাই যায়। গত বছরের বাৎসরিক আয়ের রিপোর্টেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট, যেখানে অন্যতম রেভেনিউ সৃষ্টিকারী আইটি নির্ভর কোম্পানীগুলি মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির শিকার হয়েছে। এমনকী ইনফোসিস ও এইচসিএল টেকনোলজি-র মতো বড়ো মাথাদের রেভেনিউ গ্রোথ হয় একই থেকেছে বা নেমে গেছে, যা কিনা বিগত ৫-৬ বছরের বিরল দৃষ্টান্ত। এছাড়া মাঝারি পুঁজির আইটি কোম্পানীগুলি ক্লায়েন্ট বাজেটের সাথে প্রোডাক্ট বাজেটের খাপ না খাওয়াতে পেরে রেভেনিউ গ্রোথ ধরে রাখতে পারছে না, যার ফলে কর্মী ছাঁটাই-এর সম্ভাবনা আরও বাস্তব রূপ নিচ্ছে। ২০১৭-১৮ ব্যবসায়িক বছরে টিসিএস, ইনফোসিস, কগনিজ্যান্ট-এর মতো বিগব্র্যান্ডগুলির প্রায় ৫৬,০০০ কর্মী ছাঁটাই-এর ভয়াবহ প্রতিফলন ছিল। বিশেষজ্ঞরা একে ২০০৮-এর রিসেশনের থেকেও ভয়াবহ রূপ নেবে বলেই মনে করছে। কোম্পানির কর্ণধাররা যতই একে কর্মদক্ষতার অজুহাতে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার গল্প বলুক না কেন, দেখা গেছে মন্দার সময়ে রেভেনিউ গ্রোথকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল অস্ত্র। এই সময় কর্মীনিয়োগ হয়নি বললেই চলে। অর্থাৎ কর্মচারীদের ওপর প্রোজেক্ট ও টার্গেট-এর বোঝা বাড়িয়েই নিজেদের গ্রোথকে কমতে না দেওয়াই এদের একমাত্র লক্ষ্য। ছাঁটাই-এর সম্ভাবনাকে আরও প্রবল করছে গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ যেখানে বলা হচ্ছে আগামীদিনে অটোমোবাইল সেক্টরে রয়েছে ৯০ শতাংশ ছাঁটাই-এর সম্ভাবনা, একইসাথে ক্লাউড কম্পুটিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সেক্টরে ৩০ শতাংশেরও বেশী ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সে জায়গা নিতে চলেছে এডব্লুও অ্যাজিউর।
এছাড়া কর্মীছাঁটাই-এর প্রক্রিয়াও হয়ে গেছে সুবিধাজনক। এমপ্লয়মেন্ট কন্ট্র্যাক্ট-এ সংশোধন করে এখন আর ছাঁটাই-এর আগে নোটিশ পিরিয়ডও দিতে লাগেনা। পারফরম্যান্স-এর বাহানায় বেঞ্চ সিস্টেমে ফেলে যে কোনোদিনই হতে পারে শিরচ্ছেদ। তাই অর্থনীতির এই দুর্দিনে আইটি সেক্টর-এর কর্মচারীরা অন্য সব ক্ষেত্রগুলোর মতোই যে কতটা অসুরক্ষিত তা জলের মতোই স্বচ্ছ। এই পরিস্থিতে তাই খুব শীঘ্রই ছাঁটাইকে বে-আইনী ঘোষণা করা, কন্ট্রাকচুয়াল কর্মীদের পার্মানেন্ট ঘোষণা করা, বিনিয়োগ পিছু কর্মসংস্থান-এর দাবীকে আরও জোড়ালো করার দাবী না তুলতে পারলে আগামীদিন যে কীভাবে মিনাফার হাঙরদের পক্ষ থেকে মেহনতি জনগণের জীবন জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মন্দা পরিস্থিতির উৎস সম্পর্কে বিষদে জানতে এবং নিজেদের দাবীদাওয়াগুলোকে বুঝে নিতে পড়তে থাকুন নয়াউদারবাদী অর্থনীতির উপর আমাদের আর্টিকেল সিরিজঃ
শীঘ্রই এই আর্টিকেল সিরিজের বাংলা অনুবাদ বেরোতে চলেছে।
“এডব্লুও অ্যাজিউর”- এটি সম্পর্কে কিছু তথ্য বা লিঙ্ক যদি পাঠিয়ে দিতে পারেন ভালো হয়।