প্রায় দীর্ঘ তিনমাস যাবৎ ডামাডোলের পর অবশেষে কর্ণাটকে সরকারে পালাবদল ঘটল। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথের পরে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ  দিলেন কর্নাটকের বিজেপি সভাপতি বি এস ইয়েদুরাপ্পা। এই নিয়ে চতুর্থবার তিনি বেঙ্গালুরুর মসনদে বসলেন। আস্থাভোটে পরাজয়ের ফলে জেডি(এস) ও কংগ্রেস জোট সরকারের ১৩ মাসের শাসনের পতন সুনিশ্চিত হয়েছিল কয়েকদিন আগেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইয়েদুরাপ্পার আরেকবার অভিষেক ছিল কার্যত সময়ের অপেক্ষা। ইয়েদুরাপ্পার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সাথে সাথেই স্পিকার পদেও ইস্তফা দিয়েছেন কর্ণাটক বিধানসভার স্পিকার রমেশ কুমার, যার কাজের খতিয়ান নিয়ে একের পর এক অভিযোগ করছিলেন কর্নাটক বিজেপির নেতারা।

কর্ণাটকে এইচ ডি কুমারস্বামীর সরকারের এই পতন এবং ইয়েদুরাপ্পার মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনরাভিষেক কর্ণাটকের রাজ্য রাজনীতির পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও অনেকগুলো প্রশ্নকে উস্কে দিল। যেভাবে কংগ্রেস এবং নির্দল বিধায়কদের দলে টেনে বিজেপি কর্ণাটকে কুমারস্বামী সরকারকে ফেললেন তাতে করে দেশের ‘ফেডেরাল স্ট্রাকচারের’ উপর বিজেপির কতটা আস্থা আছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। একইসাথে একের পর এক রাজ্যে যেভাবে বিধায়ক কেনাবেচা করে সরকার ‘দখলের’ নজির বিজেপি তৈরি করেছে, ২০১৪-তে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার তালিকাতেও যুক্ত হলো কর্ণাটকের নাম। কর্ণাটকের জোট সরকারের পতন আরো একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো গণতন্ত্রের নামে প্রহসনকে।

কর্ণাটকে ২০১৮-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফল ত্রিশঙ্কু হয়। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় বিজেপি। সেই সূত্রে রাজ্যপাল বাজুভাই বালার কাছে মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবি জানান ইয়েদুরাপ্পা। মাত্র দু’দিন পদে থাকার পরেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ইস্তফা দেন ইয়েদুরাপ্পা। কংগ্রেসের অর্ধেকেরও কম আসন পেলেও জেডি(এস)-এর এইচ ডি কুমারস্বামীকে সামনে রেখে সরকার গঠনে রাজি হয় কংগ্রেস। শুরুর দিকে কয়েকমাসের মধুচন্দ্রিমা-পর্ব শেষ হতেই কুমারস্বামী তোপ দাগতে থাকেন কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বের দিকে; বিশেষত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার দিকে। তার অভিযোগ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাজকর্মকে সংখ্যার জোরে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে কংগ্রেস। এমনকি একবার প্রকাশ্যে ইস্তফা দিতে চান দেবেগৌড়া-পুত্র। পরিস্থিতি তখনকার মত সামলে দেওয়া গেলেও কুমারস্বামীর মুখ্যমন্ত্রীত্ব নিয়ে কংগ্রেস বিধায়কদের মধ্যেই অসন্তোষ ছিল। লোকসভা ভোটের আগে থেকেই এই সুযোগে ঘোলা জলে মাছ ধরার খেলায় নামে ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে বিজেপি। লোকসভা ভোটে গোটা দেশের মত কর্ণাটকেও ভরাডুবি ঘটে কংগ্রেসের। ২৮ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের ঝুলিতে আসে মাত্র ২ টি আসন। অন্যদিকে বিজেপি ২৫ টি আসনে জয়লাভ করে। জেডি(এস) সুপ্রিমো তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া স্বয়ং টুমকুর আসন থেকে বিজেপির বাসবরাজের কাছে হারেন। দেওয়াল লিখন তখনই অনেকটা স্পষ্ট হয় যে, এবার সরকার ভাঙার খেলায় নামবে বিজেপি। ভোটের ফল বের হবার পর থেকেই কংগ্রেসের একের পর এক বিধায়ক ভাঙাতে থাকে বিজেপি। কংগ্রেসের ১৩ জন বিদ্রোহী বিধায়ক ইস্তফা দেবার জন্য এতটা উতলা হয়ে পড়েন যে স্পিকার ইস্তফা গ্রহন না করায় তারা কর্ণাটক ছেড়ে মুম্বইতে থাকতে শুরু করেন।

কিন্তু ক’জন বিধায়ক বিজেপির ইশারায় আত্মগোপন করে ছিলেন মুম্বইতে এনিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয় সঙ্কটপর্বে। ১৮ই জুলাই প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা ডি কে শিবকুমার সাংবাদিকদের বলেন ৮ জন কংগ্রেস বিধায়ক নিখোঁজ। সরকার বাঁচানোর জন্য জোড়াতাপ্পি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী। পাশে পেয়েছিলেন শিবকুমার আর সিদ্দারামাইয়াকেও। কিন্তু ১৩ জন বিধায়ক পাশ থেকে সরে যাওয়ায় সংখ্যালঘু হয়ে যায় সরকার। আস্থাভোটের দাবিতে বিধানসভায় তোলপাড় শুরু করে ইয়েড্ডি-বাহিনী। বিধায়কদের ভাঙিয়ে আনার খেলায় জয়লাভের পর নখ-দাঁত বের করে বিজেপি আস্থাভোটের দাবি জানাতে থাকে। আস্থাভোটের আগে স্পিকার চেয়েছিলেন সব বিধায়কদের বলার সুযোগ দিতে, কিন্তু তাতেও রাজি ছিল না বিজেপি। বিধায়কদের বলার সময় কমিয়ে আস্থাভোটে যেতেই তৎপর ছিল বিজেপি। ঘোরতর অচলাবস্থায় চলে যায় কর্ণাটক বিধানসভা। এই পর্বে একধাপ এগিয়ে বিজেপির মদতে দুই নির্দল বিধায়ক এইচ নাগেশ এবং আর শঙ্কর সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন যাতে ২৩ শে জুলাইতেই আস্থাভোট করা হয়।

রাজ্যপাল বাজুভাই বালাকে ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছে বিজেপি কংগ্রেস নেতারা এমন অভিযোগ শুরু থেকেই করে আসা হচ্ছিল। আস্থাভোটের আগেই ২২ শে জুলাই কার্যত কুমারস্বামী সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। ২২ শে জুলাই বিদ্রোহী বিধায়কদের পাশাপাশি কর্ণাটকে বহুজন সমাজ পার্টির একমাত্র বিধায়ক এন মহেশ জানান দলের ‘হাইকম্যাণ্ডের’ নির্দেশে তিনি আস্থাভোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। লোকসভা ভোটের পর বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর সাথে বিজেপির রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে জলঘোলা চলছিলই, তারপর এন মহেশের এহেন মন্তব্য সেই জল্পনাই উস্কে দেয়। যদিও পরদিন এন মহেশ জানান তিনি আস্থাভোটে কুমারস্বামী সরকারের পক্ষেই ভোট দেবেন। 

২২৫ আসনের কর্ণাটক বিধানসভায় কংগ্রেস-জেডি(এস) জোটের মোট বিধায়কসংখ্যা ছিল ১১৮। বিদ্রোহী বিধায়কদের ইস্তফা দেওয়ায় সদস্য সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২১২-তে। আস্থাভোটের আগে যদিও অনুমান করা হয়েছিল কুমারস্বামীর পক্ষে থাকবেন ১০২ জন, কিন্তু বাস্তবে সরকারের পক্ষে ভোট দেন মাত্র ৯৯ জন। আর অন্যদিকে ১০৫ ভোট পড়ে অনাস্থার সপক্ষে। অতঃপর ইস্তফা দেন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী।

নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও বিধায়ক কেনাবেচা করে সরকার বানানোর নজির এর আগে সবথেকে নগ্নভাবে  বিজেপি রেখেছিল ২০১৭-এর গোয়া বিধানসভায় ৪০ আসনের মাত্র ১৩ টি আসন পেয়েও সরকার বানায় বিজেপি।  গোয়ার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত পার্সেকরের নেতৃত্বে বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবি বিজেপির, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও হেরে যান। দিল্লী থেকে উড়িয়ে এনে তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পরীর্করকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির ৩, গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টির ৩ এবং ৩ নির্দল বিধায়কের সমর্থনে। বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস বিধায়কপিছু ১০-১৫ কোটি টাকা দিয়ে সমর্থন কেনার অভিযোগ আনে।

ঘোড়া কেনাবেচার ন্যায় বিধায়ক কিনে কর্ণাটকে সরকার ফেলা হয়েছে। রূঢ় সত্য সমন্বিত এই প্রশ্নের জবাবে ইয়েদুরাপ্পা বলেছেন দলের নেতাদের উপর বিশ্বাস হারিয়েই নাকি কর্ণাটকে বিধায়করা দলে দলে তাঁর কমল চরণে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিদ্রোহী বিধায়কদেরকে বিজেপি মুম্বইতে প্রমোদযাপনে রেখেছিলেন কী ইয়েদুরাপ্পার উপর আস্থা তৈরির জন্য? আর ইয়েদুরাপ্পার ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত। বেঙ্গালুরু, শিমোগাতে রিয়েল এস্টেটের জমি কেনাবেচা নিয়ে দুর্নীতি এবং বেলারি, চিত্রদুর্গ, টুমকুরে লোহা খনিতে কুখ্যাত খনি ব্যবসায়ী রেড্ডি ভাই-দের বে-আইনিভাবে বরাত পাইয়ে দেবার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন বিজেপির সুপ্রিমো লালকৃষ্ণ আদবাণী স্বয়ং তার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। ২০১১-তে লোকায়ুক্ত দ্বারা তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেন ইয়েদুরাপ্পা। খনি মাফিয়াদের হয়ে জমি অধিগ্রহনে প্রত্যক্ষ মদতের অভিযোগও সামনে আসে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির কাঁটার মুকুট যখন মাথায় সেসময় বিজেপি থেকে বেরিয়ে কিছুদিনের জন্য কর্ণাটক জনতা পক্ষ নামে নতুন এক দলও তৈরি করেন। কর্পোরেটপ্রেমী বিজেপির সাথে এই বিচ্ছেদ ইয়েদুরাপ্পার বেশীদিন চলেনি, বছরখানেকের মধ্যেই অবশ্য বিজেপিতে ফিরে আসেন এবং বিজেপির শীর্ষপদেই আসীন হন এই লিঙ্গায়েত নেতা। ২০১৮-এর বিধানসভায় ইয়েদুরাপ্পার মুখকে সামনে রেখেই বিধানসভা নির্বাচনে গেছিল বিজেপি। সিদ্দারামাইয়ার সরকারয়কে ফেলতে পারলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পৌছাতে পারেননি ইয়েড্ডি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হবার সূত্রে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসলেও জেডি(এস) ও কংগ্রেসের জোটের পর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ অসম্ভব দেখে ইস্তফা দেন তিনি। এর প্রায় সাড়ে তেরো মাস বাদেই বিধায়ক ভাঁড়িয়ে ফের মসনদে একদা দুর্নীতির দায়ে অপসারিত এই নেতা।

২০১৪-এর লোকসভা ভোটের থেকেও সাংসদ সংখ্যা বাড়িয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এবার ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গোটা দেশকে বিরোধীশূণ্য করার উদ্যোগ নিয়েছেন অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদিরা। লোকসভা ভোটের প্রচারপর্ব থেকেই বিজেপির একাধিক হিন্দুত্ববাদী মুখেরা স্লোগান দিয়েছিলেন যে, এবার বিজেপি নির্বাচনে জিতলে আর নির্বাচনই করা হবে না। এভাবে সরাসরি ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে’ চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০১৯-এ লোকসভায় ৩০৩ আসন নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর থেকেই একের পর রাজ্যে বিধায়ক ভাঙানোর খেলা শুরু করেছে বিজেপি। তার সবথেকে সত্বর সফলতা মিলেছে কর্ণাটকে। বিধায়ক কিনে সরকার ফেলার খেলায় বিজেপির পরের টার্গেট মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সরকার। ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধীদের হাওয়া করার এই পন্থা দেশের তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’কেই কার্যত উলঙ্গ করে দিচ্ছে।  

২০১৪-এর পর থেকে পাঁচ বছরে বিরোধী মত দমনের যে আগুন অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদিরা ধিকিধিকি জ্বালাচ্ছিলেন সেটাই কার্যত দাবানলে রূপান্তরিত হয়েছে ২০১৯-এর ফল ঘোষণার পর থেকে। তথ্য জানার অধিকার আইনকে পঙ্গু করে দিয়ে, শ্রম আইনকে শিথীল করে, মানবাধিকার আইনের সংশোধন করে এবং কাশ্মীরে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে ও ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল করে দিয়ে সরকার-বিরোধী সমস্ত বক্তব্যকেই রাষ্ট্রের অখণ্ডতার উপর চ্যালেঞ্জ বলে দেখাতে চাইছে এবং তাকে সন্ত্রাসবাদের একটা মুখোশ পরাতে চাইছে বিজেপি।

ঘোড়ার মত জনপ্রতিনিধিদের কেনা-বেচা করে ক্ষমতায় আসা বা নির্বাচিত সরকারকে অগণতান্ত্রিকভাবে অপসারণ করার ইতিহাস ভারতীয় গণতন্ত্রের শুরুর দিক থেকেই সঙ্গী। এই কাজের ধ্রুবতারা ছিল অবশ্যই কংগ্রেস আর এখন সেই একই জুতোয় পা গলিয়েছে বিজেপি। ১৯৫৭-এর কেরলে নির্বাচিত প্রথম অকংগ্রেসী কমিউনিস্ট পার্টির সরকারকে ফেলে দিয়েছিল কেন্দ্রের জওহরলাল নেহরুর সরকার। পশ্চিমবঙ্গে দু’দফায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মধ্যে গোলযোগ বাঁধিয়ে সরকার ফেলে দিয়েছিল কংগ্রেস। তাদের হাত থেকেই এখন মশাল নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীরা। ১৯৫২-এর নির্বাচন ব্যবস্থার শুরুর দিন থেকেই শুরুর দিন থেকেই ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি ভারতের দক্ষিণপন্থী দলগুলির কাছে কার্যত জলভাত। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো ভয় দেখিয়ে বা খুনের হুমকি দিয়ে এই কাজ চলছে।

‘বিশ্বের সবথেকে বড় গণতন্ত্র!’-তে জনপ্রতিনিধিদের কেনার সবথেকে বর বিজ্ঞাপন হয়ে রয়েছে ২০০৮-এর মনমোহন সিংহ সরকারের আস্থাভোট। ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে বামেরা যখন ইউপিএ-১ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেন, তখন সরকার বাঁচানোর জন্য তৎকালীন বিরোধী বিজেপি-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সাংসদদের ক্রস ভোটিং করার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ দেবার অভিযোগ ওঠে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। স্পিকারের ডায়াসে উঠে টাকার ব্যাগ উল্টে বিক্ষোভ দেখান তিন বিজেপি সাংসদ- অশোক আর্গল, ফজ্ঞন সিং কুলাস্তে এবং মহাবীর ভাগোরা। অভিযোগ ছিল সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিং এবং কংগ্রেস নেতা অহমেদ পটেল তাদের ভোট কেনার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেকটি দক্ষিণপন্থী দলের কোনো না কোনো সাংসদের বিরুদ্ধে ওঠে ক্রস ভোটিং-এর অভিযোগ। বিজেপি তাদের ৮জন সাংসদকে, তেলুগু দেশম ২ জনকে, বিজু জনতা দল ও অকালি দল ১ জনকে বহিষ্কার করে সরকারের পক্ষে ভোট দেবার জন্য।

নিজেদের ব্যক্তিগত কায়েমি স্বার্থের জন্য পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যাল বডির ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ’-এর বিভিন্ন অঙ্কে এদল ওদল করা এখন ভোটার দের কাছেও সয়ে গেছে। স্থানীয় স্তরে দলত্যাগবিরোধী আইন প্রযুক্ত না হওয়ায় অনাস্থা প্রস্তাব বা টালমাটাল পরিস্থিতিতে কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত স্তরের মেম্বারদের নিয়ে কার্যত দড়ি টানাটানির খেলা করে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি। ব্যারাকপুর লোকসভা জেতার পর সেই লোকসভার অন্তর্গত তৃণমূলের পৌর সদস্যদের ভাঁড়িয়ে বিজেপি একের পর এক পৌরসভা দখল করতে শুরু করে, আবার সপ্তাহ না ঘুরতে ঘুরতেই ভাগ বাঁটোয়ারার হিস্‌সা পোষাচ্ছে না বলে তারা আবার তৃণমূলের ‘উন্নয়নে’ শরীক হতে চলে এলেন পুরোনো দলে। ‘কিম্ভুতকিমাকার গণতন্ত্র!’ 

পৌরসভা বা পঞ্চায়েত স্তরে দলত্যাগ বিরোধী আইন লাগু হয় না; এদল ওদল করা অনেক সহজ কিন্তু বিধানসভা বা লোকসভায় নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধিগণও’ উড়ুক্কু মাছের মত এদলে ওদলে ঘুরে বেড়ানোরও নজির তৈরি করছেন। সবথেকে ভালো উদাহরণ আছে পশ্চিমবঙ্গেই। বাগদার বিধায়ক দুলাল বর এবং বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য ২০১৬-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটে জিতেছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে। মাসখানেক বাদে তারা দলবদল করে যান প্রথমে তৃণমূলে, আবার ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময় তারা যান বিজেপিতে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই যে, তারা এখনো খাতায়কলমে কংগ্রেসের বিধায়ক। বিধায়করা যে তিন বছর আগে কোন দলের হয়ে জিতেছিলেন তাই প্রায় ভুলে গেছেন সেই ভোটাররা। আর এদিকে ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের তরফে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, ‘গণতন্ত্রের সবথেকে বড় উৎসব’!

বিজেপির বিরোধিতায় ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে সুবিধাবাদী বিভিন্ন আকার ও আয়তনের জোট করে ভারতের ‘গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার পূজারীরা’ চেয়েছিল ক্ষমতা দখল করতে। জোটের প্রত্যেকেই আবার প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কলকাতার ব্রিগেডের সভায় বিজেপি ফিনিশ শ্লোগান দিলেন ‘ফেডেরাল ফ্রন্টের’ উদ্যোক্তারা। তারপরেই ভোট যত এগিয়েছে ক্রমেই ঠুনকো হতে থেকেছে এই ফ্রণ্টের ভাবনা। গোটা লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিজেপিকে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির তকমা দিয়েই এইসব দলগুলি ক্ষান্ত হয়। বিজেপির কর্পোরেট তোষণ, রাষ্ট্রায়াত্ত্ব সংস্থাগুলির একের পর এক বিলগ্নিকরণ, এফ আর ডি আই বিল, জিএসটি, নোটবন্দির মত সাধারণ মানুষের উপর খাঁড়ার ঘার মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলির বিপক্ষে মৃদু মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েই এরা ক্ষান্ত হন। আসলে কর্পোরেট-প্রেম বিজেপির থেকে এদের কোনো অংশে কম নয়। ভোটপর্ব মিটতে না মিটতেই এরা কেউ সরাসরি বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছেন আবার কেউ কেউ তলে তলে যোগাযোগ রেখে চলেছেন বিজেপির সাথে (সংসদে একের পর এক বিলে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছেন)। সবথেকে বড় কথা যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি এখনো ক্ষমতায় আসেনি সেই সব জায়গায় বিজেপি প্রবেশ করার সবথেকে বড় সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে রাজ্যভিত্তিক আঞ্চলিক দলগুলির দুর্নীতি এবং জনবিরোধী কাজের জন্য। আঞ্চলিক দলগুলির  দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকেই বারংবার পুঁজি করছে বিজেপি। আর তাতেই হচ্ছে বাজিমাৎ। এটাই আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের আসল ছবি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *