লোকসভা নির্বাচন পর্ব শেষ হয়েছে একপক্ষ হতে চলল। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক খুনোখুনির যেন কোনো বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। তৃণমূল নেতা, বিধায়ক, কাউন্সিলররা যখন উড়ুক্কু মাছের মত বিজেপিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন, সেই সময় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূল-বিজেপির রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও রক্তপাত দিনের পর দিন বাড়ছে; যার শিকার সেই ‘উলুখাগড়া-রূপী’ সাধারণ মানুষ এবং নীচুতলার রাজনৈতিক কর্মীরা। সাথে চলছে মৃতদেহের উপর ঝাণ্ডা পোঁতার রাজনীতি। সমগ্র পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি-সরকার নেমেছে ঘোলা জলে মাছ ধরতে, রবিবারই তাঁরা রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছে, যেখানে রাজ্যের অশান্তির পরিবেশ তৈরিতে বিজেপির ভূমিকা রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের থেকে কোনো অংশে কম নয়।

নিমতায় তৃণমূল কর্মী নির্মল কুণ্ডু খুন, মথুরাপুরে সিপিআই(এম) কর্মী রাজু হালদার খুন, রাজনৈতিক আক্রোশে অশোকনগরে তৃণমূল সমর্থকের শিশুপুত্রকে মারধোরের পর গত শনিবার বসিরহাট লোকসভার সন্দেশখালিতে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যার বলি হয়েছেন দুই তরফের মোট চারজন, যার জেরে সন্দেশখালি-সহ গোটা বসিরহাটের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। মৃত তৃণমূল কর্মী মুসলিম এবং বিজেপি কর্মীরা হিন্দু হওয়ায় বিজেপি-তৃণমূলের সংঘর্ষের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে গুজব ও উস্কানি ছড়ানোর চেষ্টা চলে বসিরহাটের বিভিন্ন প্রান্তে। গুজব ছড়ানো হয় যে, শনিবার সারারাত ধরে হিন্দুদের বাড়ি ধরে ধরে তৃণমূল-সমর্থক মুসলিমরা আক্রমণ করেছে, এবং গ্রামে ঢুকে খুন করে তাঁদের দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে রবিবার বসিরহাটের বিস্তীর্ন অঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস সুবিদিত। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘর্ষ কি ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেছিল ২০১৭-র জুলাই-তে, যা সাম্প্রদায়িক হানাহানির রূপ নিয়েছিল। এর জেরেই ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের বিজয়ী সাংসদ ইদ্রিশ আলিকে সরিয়ে  অভিনেত্রী নুসরত জহানকে এবারের লোকসভায়  প্রার্থী করে তৃণমূল। নুসরত তিন লক্ষাধিক ভোটে জিতলেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এই আবহে হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামে বিজেপি। সন্দেশখালির ভাঙ্গিগ্রামে একটি বুথে বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু ১০০-এর বেশী ভোটে লিড পান। তৃণমূল সূত্রের খবর, ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করার জন্য শনিবার বুথ স্তরে একটি বৈঠক ছিল তৃণমূলের। অভিযোগ, বৈঠক শেষে গ্রামের রাস্তায় তৃণমূলের পতাকা লাগানোকে কেন্দ্র করে গোলমালের সূত্রপাত। তৃণমূলের অভিযোগ, তাঁদের কর্মী কায়ুম মোল্লাকে পিছন থেকে গুলি করে বিজেপি, পরে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।  এরপরেই পাল্টা প্রতিরোধে নামে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী। এলাকার বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে একের পর এক হামলা চালানো হয়, দোকান ভাঙচুর করা হয়। বিজেপি কর্মী সুকান্ত মণ্ডলকে খুন করা হয়, অপর এক বিজেপি কর্মী প্রদীপ মণ্ডল কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এই সম্পূর্ণ ঘটনার নেপথ্যে যার নাম সবথেকে বেশী উঠে আসছে, তিনি তৃণমূলের ব্লক-সভাপতি শেখ শাহজাহান। পঞ্চায়েত স্তরে একাধিক দুর্নীতি, চোরাচালান, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গরু-পাচার ইত্যাদি বহু অভিযোগে অভিযুক্ত শাহজাহানের নামে এর আগেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠে এসেছিল বারংবার। কায়ুম মোল্লা খুনে শেখ শাহজাহানের উপর অভিযোগের আঙুল তুলেছে বিজেপি, যদিও জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক শাহজাহানের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

কায়ুম মোল্লার মৃত্যু এবং তারপরে বিজেপি নেতাদের মৃত্যুতে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। বসিরহাট জেলা হাসপাতালে মৃত বিজেপি কর্মীদের দেহ ঘিরে একপ্রস্থ উত্তেজনা তৈরি করে বিজেপি নেতৃত্ব। অবশেষে মৃতদেহের গায়ে ঝাণ্ডা পুঁতে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়রা দেহ নিয়ে সন্দেশখালি থেকে কলকাতার দিকে আসতে থাকায় মিনাখাঁয় তাদের পথ আটকায় পুলিশ। শেষ পর্যন্ত সন্দেশখালির ন্যাজাটেই শবদেহ দাহ করা হয়। মৃতদেহের উপর ঝাণ্ডা পুঁতে তা থেকে ফায়দা তোলার মত জঘন্য কাজে লিপ্ত বিজেপি। দিনভর রাজ্যজুড়ে দফায় দফায় পথ অবরোধ ও মিছিল করে বিজেপি। সোমবার বসিরহাট বনধেরও ডাক দেওয়া হয় বিজেপির তরফে। শবদেহ নিয়ে ফায়দা তোলার কাজ একাধিকবার বিরোধী থাকার সময় তৃণমূলও করেছে, আর এখন রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে একের পর এক খুনে একই ভূমিকা পালন করছে এই বিজেপি। আর হবে নাই বা কেন, দল ভাঙানোর খেলায় মেতে যারা একসময় টাকা দিয়ে  বিধায়ক-সাংসদদের ভাঙিয়ে ‘উন্নয়নে’ সামিল করতেন, আজ বিজেপি তাঁদের দলের লোকেদেরই ‘বিকাশে’ সামিল করছে, একই ভাবে। রাজনৈতিক খুনোখুনির পরে এই সত্য যেন আরো খোলামেলা যে, বিজেপি আর তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর বাংলার মানুষের জীবনকে এরা জঘন্য খেলার ‘বোড়ে’ করেই রেখে দিয়েছেন। ছিঃ… 

 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *