বিগত লোকসভা ভোটের উত্তাপ শেষ হয়েছে আজ দু’ মাস অতিক্রান্ত। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এন.ডি.এ। দিনকয়েক আগে কেন্দ্রের নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সরকারের প্রথম বাজেটও পেশ করেছেন। কিন্তু আখচাষীদের ভবিষ্যৎ এখনও সেই অন্ধকারেই নিমজ্জিত। সংকটের প্রধান অক্ষ মহারাষ্ট্র। বিগত ১৮ মাসে বিশ্ববাজারে চিনির দাম প্রায় ৪৫% নেমে গেছে। একদিকে চিনির দামের এই পতন, অন্যদিকে সারা দেশজুড়ে আখের অত্যাধিক ফলনের জন্যই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে আখচাষীদের বকেয়া ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা যা কিনা ক্রমবর্ধমান। এসব বিভিন্ন কারণে চিনি উৎপাদন ও তার উৎপাদকরা আরো গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বকেয়া টাকা না পেয়ে মুখ মিষ্টি করাতে থাকা এই চাষিদের প্রতিবাদে পোড়াতে হচ্ছে আখ।

এই সংকটময় পরিস্থিতি রুখতে ক্যাবিনেট কমিটি অফ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (সি.সি.ই.এ.) ৭০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণার সুপারিশ করেছে (পূর্বের ১৫৪০ কোটি টাকার ঘোষিত প্যাকেজের সঙ্গে যোগ করলে যার পরিমাণ হয় ৮৫৪০ কোটি টাকা)। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পরেও অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তা এই কারণেই যে প্যাকেজ লুফেছে মিল মালিকগুলি, কৃষকদের হাতে কিছুই পৌঁছায়নি।

এই সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সড়ক পরিবহন ও জাতীয় সড়ক মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি মহারাষ্ট্রের সমবায় ব্যাঙ্ক দ্বারা আয়োজিত চিনি বিষয়ক অধিবেশনে এক নতুন পলিসির প্রস্তাবনা করেছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন যে,  মুনাফা তৈরি করাই চিনি মিলগুলির কাছে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শস্য উৎপাদনের ধরণ যেহেতু বদলানো সম্ভব নয় তাই বদলাতে হবে আখের ব্যবহার। তিনি মিলগুলিকে ইথানল প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হতে বলেন। ইথানল আখ থেকে প্রস্তুত হওয়া একটি জৈব জ্বালানি এবং বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বাড়ছে। গড়কড়ি বলেন যে ইথানল প্রস্তুত করে এই মুহুর্তে ভারতের আয় ১১০০০ কোটি টাকা এবং আগামী দুবছরে এই সংখ্যা নাকী ৫০০০০ কোটির সীমা অতিক্রম করবে তাই মিলগুলি যদি ইথানল প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে না আসে তাহলে কোনোভাবেই তাদের বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, মিল মালিকরা তাও তো কিছু সরকারি সাহায্য পাচ্ছে অথচ কৃষকদের দুরাবস্থা নিয়ে মালিক-সরকার উভয়ই চোখে ঠুলি পড়ে বসে আছে।

অন্যদিকে বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জল সংকট কবলিত মারাঠওয়াড়ায় আরো চিনি প্রস্তুতকারক মিল গড়ার আহ্বান করেছেন! কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ‘স্বভিমানী পক্ষ’-এর প্রধান তথা প্রাক্তন সাংসদ রাজু শেঠী। তিনি বলেন যে, মহারাষ্ট্র তথা গোটা দেশজুড়ে যে বিপুল জলের সংকটের আগমন হয়েছে তা রুখতে সরকারকে কৃষকদের ক্ষরা প্রতিরোধক ফসল যেমন ডাল, সর্ষে ইত্যাদি উৎপাদনে উদ্যোগী হওয়ানো উচিত। আখচাষে যে বিপুল পরিমাণ জলের প্রয়োজন হয় সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে বিজেপি-র সাথে একদা হাত মিলিয়ে চলা এই কৃষক নেতা বলেছেন যে, মারাঠওয়াড়ার প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা স্মরণ করে এই মুহুর্তে নতুন মিল গঠনের চিন্তাকে বর্জন করতে হবে। এখন সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা এই মিশ্রনীতি প্রনয়ণের দাবী আখচাষীদের সংকটময় পরিস্থিতির উন্নতিতে কতটা কার্যকরী হবে? এর আগেও সমস্ত সরকারী নীতি ও ব্যবস্থা যে আখচাষীদের অবস্থা আরো প্রতিকূল করেছে, সেই ইতিহাস এখনও সাধারণ মানুষের মনে জীবন্ত।

উল্লেখ্য বিষয় এই যে, মন্দার বাজারে আখচাষীরা এম.এস.পি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ (কোনো অত্যাধিক উৎপাদন হওয়া বছরে ফসলের মূল্যের বিশ্ববাজারে পতন হলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম প্রদেয় অর্থ যাতে উৎপাদকের সুরক্ষা বজায় থাকে) থেকে বঞ্চিত হয়ে এফ.আর.পি বা ফেয়ার অ্যান্ড রেমুনারেটিভ প্রাইজ (আখ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি থেকে কৃষকদেরকে প্রদেয় ন্যূনতম অর্থ) গ্রহণ করতে বাধ্য হলেও এই এফ.আর.পি.-এর সিংহভাগই বকেয়া এবং তা ক্রমবর্ধমান! এফ.আর.পি. এই বছরে ১০.৮% বৃদ্ধি পেলেও (বিগত ৫ বছরে সর্বোচ্চ) চিনির বাজারমূল্য ২৪% নেমে গেছে এবং দিনের পর দিন এই বকেয়া এফ.আর.পি. বাড়ছে বলে দাবী বাজার বিশেষজ্ঞদের। রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ মেনে পূর্বতন মহারাষ্ট্রের কংগ্রেসি সরকার সুগার মিলগুলির বিনিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটতে শুরু করে। সেই পথই অনুস্মরণ করে বর্তমান বিজেপি সরকার এখন এফ.আর.পি-র উপর থেকেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিশ্ববাজারে যেখানে ব্রাজিল ২২ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছে, সেখানে ৩২.৩৪ টাকা কেজি দরের চিনি নিয়ে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না ভারত। বিশ্ববাজারে ভারতীয় চিনি তাই প্রতিযোগিতায় পিছু হটছে। এমতাবস্থায় আই.এস.এম.এ. (ইন্ডিয়ান সুগার মিল অ্যাসোসিয়েশন) জানিয়েছে ৩৫ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করতে না পারলে এবং এফ.আর.পি-র নির্ধারিত মূল্য না কমালে নাকি সুগার মিলগুলির পক্ষে এই বকেয়া মিটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সরকারি সাহায্যে ডুবে থাকা আই.এস.এম.এ-এর এই মন্তব্যই চাষিদের প্রতি তাদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট করে তুলেছে।  

বিগত আট বছরে ভারতে চিনির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮-৯%। অর্থাৎ উৎপাদন নয় বিক্রি করে ওঠাই যে মূল সমস্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই সমস্যার উৎপত্তি কোথায় সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আই.এস.এম.এ.-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে চিনি প্রস্তুতকারক বৃহৎ সংস্থাগুলি (যেমন বলরামপুর চিনি মিলস্‌, ত্রিবেণী ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস্‌, ডামিয়া ভারত সুগার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস্‌, ধামপুর সুগার মিলস্‌ ইত্যাদি) কিন্তু এই মন্দার বাজারেও বেশ ভালো পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছে। অন্যদিকে অধিকাংশ ছোট সংস্থাগুলি সরকারি সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও বাজারে পেরে উঠতে পারছে না। উত্তর প্রদেশেও এই চিনি সংকট দেখা দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বীকার করে নিয়েছেন যে এ বছর দেশে রেকর্ড চিনি উৎপাদন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম পড়ে যাওয়ায় দেশের চিনি রপ্তানিতে ভাটা পড়ছে; তার জন্যই আখ চাষিদের এই দুরাবস্থা। উল্লেখ্য, মিল মালিকদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। ভিট্টহাল ভিখে পাতিল সুগার কর্পোরেশানের মালিক রাধাকৃষ্ণ নিজে একজন কংগ্রেস নেতা। শরদ পাওয়ারের নিজেরই ব্রাজিলে একটি সুগার মিল রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক চাপ কৃষকদের উপর আর্থিক দুরাবস্থার উৎসেচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ঋণ পেয়েও যেখানে মিল মালিকরা হরি কীর্তন করতে ব্যস্ত, সেখানে বাজার অর্থনীতির বিষাক্ত ফলই কেবল বরাদ্দ রইল মাঠে আখ চাষ করতে থাকা অ্যাডামদের।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *