শিশুটা রাস্তায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর কাঁদছে। ওর মাকে কেউ একজন ধরে নিয়ে গেছে। বুঝতে পারেনি ও, কখন যে এত কিছু হয়ে গেছে। শিশুটা রাস্তায় বসে শুধু কাঁদছে।
হ্যাঁ কাল্পনিক… কিন্তু সত্যিই পুরোটা কী কাল্পনিক? কাশ্মীর আজকে সত্যিই মা হারানো ওই শিশুর মতো। রোজ খবরের কাগজে বড় বড় করে ছাপা হচ্ছে কাশ্মীর শান্ত, নিউজ চ্যানেলে সরকারী পদলেহনকারী ‘প্রাক্তন’ সেনাকর্তারা তাদের ‘অভিজ্ঞতা’ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বোঝাচ্ছেন কাশ্মীরের সার্বিক ‘বিকাশের’ জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া কতটা জরুরী ছিল।কিন্তু সবই ওই শিশু ভোলানো ছড়ার মতো। কেন্দ্রের বিজেপি-সরকারের ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারা তুলে নেওয়ার পর কাশ্মীরিদের অবস্থা কার্যত অনাথের মত।
কেন্দ্র সরকার দ্বারা কাশ্মীরকে বিশেষ অধিকার প্রদানকারী সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের প্রতিবাদে, এন আর সি-এর নামে দেশের মানুষকে বাস্তুহারা করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং ফ্যাসিবাদী কায়দায় সাধারণ মানুষের উপর অর্থনৈতিক শোষণের ব্যূহ তৈরির প্রতিবাদে শিয়ালদহ সংলগ্ন মৌলালি চত্বরে গত ১৯শে অগাস্ট সিপিআই(এম-এল)রেড স্টার, সিপিআই(এম-এল) এবং পিপল’স ব্রিগেড দ্বারা গণ অবস্থান করা হয়। গণ অবস্থান শুরু হয় বেলা ১টা থেকে। কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এহেন পদক্ষেপ কীসের উদ্দেশ্যে? এই নিয়ে বামপন্থীদের মত কী? দেশপ্রেমের আবডালে আসলে কী খেলা চলছে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মানুষের মধ্যে শোনার ও বোঝার তাগিদ ছিল চোখে পড়ার মতো। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই লোক সমাগম বাড়তে থাকে।

কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল, এন.আর.সি আইন চালু, আর.টি.আই আইন সংশোধন, ইউ.এ.পি.এ আইন সংশোধন, বেঙ্গল কেমিক্যালের ন্যায় বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার বিলগ্নিকরণ, দলিত -আদিবাসী সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর করা অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং জি.এস.টি বাতিল ও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের গণভোটের দাবীতে সোচ্চার হন বক্তারা। পিপল’স্ ব্রিগেডের কনভেনর বাসুদেব নাগ চৌধুরী বলেন, “রাবণ যেমন সীতাকে হরণ করে জঙ্গল থেকে সোনার কাননে এনেও তাঁর মন জয় করতে পারেননি কারণ সীতা বলেছিলেন তাঁর অনুমতি ছাড়াই রাবণ এই কার্য করেছেন, ঠিক তেমনই মোদী সরকারও কাশ্মীরের সম্মতি ছাড়া ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে সেখানে সেনা নামিয়ে কাশ্মীরের উন্নয়ন করতে পারবে না।”

সিপিআই(এম-এল)রেড স্টার-এর পক্ষ থেকে প্রদীপ সিংহ ঠাকুর বলেন যে, “কাশ্মীরের জমির উপর বড় কর্পোরেটদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং আদানী আম্বানীর উন্নয়নের ভাঁওতাকে স্বীকৃতি দিতেই ৩৭০ ধারা বাতিলের পদক্ষেপ নিয়েছে বিজেপি সরকার আর যাকে ঢাকতে কাশ্মীরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার উদ্রেগ করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।”
পিপলস্ ব্রিগেডের তরফ থেকে সুমিত ঘোষ তাঁর বক্তব্যতে ৩৭০ বাতিল আসলে ৩৭১ ধারাগুলি বাতিলের পূর্বধাপ বলে উল্লেখ করেন। বহুত্ববাদী সংস্কৃতি রক্ষার্থে অন্যান্য রাজ্যগুলিকে প্রদত্ত বিশেষ অধিকারও বাতিল করে দেওয়ার পূর্বধাপ হলো কাশ্মীরের উপর থেকে ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারা বিলোপ। এর ফলে বিশেষ করে আমাদের দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে এবং এই প্রোভোকেশান চলতে থাকলে এই সমস্ত রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের উদ্রেগ হওয়ারও প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। পিপল’স্ ব্রিগেডের পক্ষে অরিত্র বসু বলেন যে, ” সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে মোদী ও অমিত শাহ কাশ্মীরের সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতেও তাদের মুনাফার পাহাড় অক্ষুণ্ণ রাখার পথ প্রশস্ত করল।”
রেড স্টারের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক অলীক চক্রবর্তী উল্লেখ করেন, “দেশভাগের সময় করদ রাজ্যগুলির শাসক ও সাধারণ জনগণকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল সিদ্ধান্ত নিতে, যে তারা ভারত বা পাকিস্তানভুক্ত হবে, নাকি পৃথক দেশ হিসেবে থাকবে। ৩৭০ ধারা রদ করে কেন্দ্র সরকার সার্বভৌমত্ব এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কার্যত ভূলুণ্ঠিত করছে”। রেড স্টারের পক্ষে শংকর দাস বিজেপি সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গে তাদের পেশী শক্তি আস্ফালনের রাজনীতির কথা বলেন। রেড স্টারের পক্ষে রাজু সিংহ তাঁর বক্তব্যে পরিবেশের উপর বিজেপি-সরকারের মদতপুষ্ট কর্পোরেটদের নিরন্তর আগ্রাসন, আইন বদলের হিড়িক এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলি তুলে ধরেন।
গণ অবস্থানে এই তিনটি বামপন্থী পার্টিই কাশ্মীর নিয়ে তাদের আন্দোলন বৃহত্তর করার ডাক দিয়েছে এবং এই জন্য আগামী ৩রা সেপ্টেম্বর সকল প্রগতিশীল ও বামপন্থী শক্তিকে একজোট করে কাশ্মীর প্রসঙ্গে মৌলালী যুব কেন্দ্রে একটি গণ কনভেনশনের ডাক দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হতে সমস্ত স্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে তারা কনভেনশনে আহ্বান জানিয়েছেন।