আন্তঃ দেশীয় লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনার এককের বদলে দেশীয় মুদ্রার (শক্তিধর দেশগুলির দাদাগিরি অটুট রেখে) প্রবর্তন এবং ভবিষ্যৎ উৎপাদন নির্ভরশীল ফাটকা কারবারের প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি আজকের দিনে অর্থনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এই অর্থনৈতিক মহামন্দা ফিরে ফিরে আসছে ৮-৯ বছর অন্তর এবং তার অক্ষ উড়ে বেড়াচ্ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশ বা দেশসমূহে। ২০১৭-য় লোক সভায় পেশ হওয়া বিতর্কিত ‘এফ. আর. ডি. আই’ বিলের মাধ্যমে কেন্দ্র সরকার সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে মার্জার করিয়ে এবং তাদের পরিচালনার কেন্দ্রিকরণ ঘটিয়ে সমকালীন অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজেছিলো। সংসদে বিলের উপর শীলমোহর না পড়লেও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে এর বাইরে আর কোনো পথের হদিস তারা দিতে পারেনি যাতে দেশের ১%-এর মুনাফার পাহাড় অক্ষুন্ন রাখা যায়। ফলে সেই সময় থেকেই প্রশ্ন ওঠে যে এই বিল কি শুধুই সরকারের স্বার্থান্বেষী একটি সাধারণ বিল নাকি বর্তমান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সঙ্কট ধামাচাপা দেওয়ার একটি মরিয়া প্রয়াস? বর্তমান সময়ে ভারতের প্রথম সারির পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলির প্রায় দেউলিয়া দশা রাষ্ট্রের সামনে এনে দিয়েছে এক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। বর্তমানে আমাদের দেশের ৩৮টি প্রধান ব্যাঙ্কের প্রথম ২০টির ২০১৮ সালে মোট এন. পি. এ বা নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (যে ধার শোধের সময়সীমা ৯০ বছর) ৮০০,০০০ কোটি টাকা! এই পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি প্রাইভেট সেক্টরকে যে ‘ডোমেস্টিক ক্রেডিট’ (ধার) দিয়েছে তা ইতিমধ্যেই জি. ডি. পি-র ৫০% অতিক্রম করেছে! সাধারনত ধরে নেওয়া হয় ব্যাঙ্কের স্ট্রেস ইন্ডেক্স যদি ৪-এর বেশী হয় তাহলে ব্যাঙ্কের অবস্থা খারাপ কিন্তু এই স্ট্রেস ইন্ডেক্স যদি ৬-এর বেশী হয় তাহলে সেই ব্যাঙ্ক সংকট থেকে উদ্ধার হওয়ার বিপদসীমা ছাপিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের প্রথম ২০টি পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বিপদসীমার ঊর্ধ্বে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অবস্থা প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলির তুলনায় যথেষ্ট সংকটজনক কারণ রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পর থেকে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলি পুঁজিপতিদের মুনাফা লালসাকেই পুষ্ট করে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে এই ব্যাঙ্কগুলি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারে কিন্তু সেই পরিস্থিতি এড়ানোর প্রয়াস হিসেবে রাষ্ট্র বর্তমানে সবকটিকে একসাথে না পারলেও কিছু কিছু করে পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলির সাথে প্রাইভেট সেক্টর ব্যাঙ্কগুলির ‘মার্জার অ্যান্ড আকুইজিশান’ করাতে চাইছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার সব চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, বিজয়া ব্যাঙ্ক এবং দেনা ব্যাঙ্ক-এর মার্জার। ব্যাঙ্কগুলি থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে এই মার্জারকে “পাওয়ার অফ থ্রি”-এর মতো চটকদারি নামে অভিহিত করলেও আদতে এই মার্জার বিপুল অনাদায়ী ঋণের ফলে গড়ে ওঠা সঙ্কটের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, বিজয়া ব্যাঙ্ক এবং দেনা ব্যাঙ্ক-এর স্ট্রেস ইন্ডেক্সের পরিমাণ যথাক্রমে ৫.৩২, ২.৮০ এবং ৭.১৫! তাই সর্বশেষে বলা যায় ২০১৮ সালের ১৬ই মার্চ “জবরদখল” পত্রিকায় প্রকাশিত “FRDI Bill-The Balance of Payment of an Imported Crisis” শীর্ষক প্রবন্ধ যে বক্তব্য সামনে এনেছিল আজ এই তিনটি ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ সেই বিশ্লেষণের পক্ষেই ইঙ্গিত করছে এবং আমরা এগিয়ে চলেছি এক অসমাধানযোগ্য নয়াউদারবাদী সঙ্কটের দিকে।
