আম্ফানের ক্ষতিপূরণের দাবীতে গত ৩০ শে জুলাই হাসনাবাদ বিডিও অফিসের সামনে টানা নয় ঘন্টার অবস্থান বিক্ষোভ করলো পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড। হাসনাবাদের পাটলিখানপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্ভূক্ত কয়েক হাজার পরিবার আম্ফানের তাণ্ডবে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আম্ফানে বরাদ্দ ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করার অভিযোগ নিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ বিডিও অফিসে অবস্থান করেন এদিন।

গত ১ লা জুন থেকে টানা ২৪ দিন দু’বেলা প্রায় দেড় হাজার লোকের রান্নাখাবারের একাধিক ত্রাণশিবির চালাচ্ছিলো পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড। পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের সংগঠক শেখর ঘোষ জানান যে, তাদের ত্রাণশিবির শুরু হওয়ার সময় থেকেই তারা দেখতে পান আম্ফানে বরাদ্দ ক্ষতিপূরণের টাকা বিভিন্ন উপায়ে আত্মস্যাৎ করছে অঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত গ্রাম-পঞ্চায়েত। প্রসঙ্গত, আম্ফানে বরাদ্দ ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে স্বজনপোষণের অভিযোগ এখন রাজ্যজুড়ে। হাসনাবাদ ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চলেই তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা ও পঞ্চায়েত মেম্বারদের পরিবারের ৫ জন, ৭ জন, ১২ জন ও এমনকি ১৮ জন সদস্যের অ্যাকাউন্টে পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা দেওয়ার নজির দেখা গিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার পরিবারের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণেরই আশা দেখা যাচ্ছিল না। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, বন্যার জল থাকাকালীন সময়েও সরকারের পক্ষ থেকে এমনকি ন্যূনতম ত্রাণসামগ্রীও এসে পৌঁছয়নি বলে জানাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরা। এমন পরিস্থিতিতে, পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের নেতৃত্বে গ্রামের কয়েকশো মানুষের একটি মিছিল গত ১১ই জুন হাসনাবাদের বিডিও অফিসে পরিবার-পিছু ক্ষতিপূরনের ২০ হাজার টাকা, নদীবাঁধ মেরামতি, ত্রাণসামগ্রী-সহ বিভিন্ন দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়।
পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের বক্তব্য অনুযায়ী, জুন মাসে তাঁদের বিডিও অফিস অভিযানের সময় হাসনাবাদের বিডিও অরিন্দম মুখার্জী ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী যেমন ত্রিপল, শুকনো খাবার, রান্নার বাসন ইত্যাদি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, দেড় মাসে কোনো কথাই তিনি রাখেননি; ফলে পাল্টা আন্দোলনের পথে তাদের নামতে হয়েছে।
গত ৩০ তারিখ পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড যে বিপুল সংখ্যার মানুষকে নিয়ে আন্দোলনের পথে পা বাড়ান, তাতে বোয়ালমারী, ঘুনি, চকপাটলি, ঠাকুরানির আবাদ সহ গোটা পাটলিখানপুর পঞ্চায়েত ও সংলগ্ন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের এক বিশাল অংশের মানুষের অংশগ্রহন ছিলো চোখে পড়ার মতো। হাসনাবাদের নবনির্মিত বনবিবি সেতুর আশেপাশের দোকানদাররা বলছিলেন যে সাম্প্রতীক সময়ে তাঁরা লাল পতাকা হাতে বিপুল মানুষের মিছিল-আন্দোলনের কথা মনে করতে পারছেন না!
বিডিওর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণে সাধারণ মানুষ যে কতটা বিক্ষুদ্ধ ও মারমুখী হয়ে উঠেছেন, কালকের এই আন্দোলনে তা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
আম্ফানের পর থেকে শাসক দল তৃণমূলের মেম্বারদের টাকা পয়সা থেকে রেশন সবকিছু চুরি করা ও অঞ্চলজুড়ে তৃণমূলের দুই কুখ্যাত দুষ্কৃতি রহিম ডাক্তার ও পিন্টু মোল্লার দাপাদাপি সাধারণ মানুষদের জীবন অতিষ্ঠ ক’রে তুলেছে। এদিন সেই ক্ষোভ উগরে দিতেই যেন পথে নেমেছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ গ্রামবাসীরা।
হাসনাবাদের যে বিডিওর প্রতিশ্রুতিভঙ্গ নিয়ে এই আন্দোলনের এত উষ্মা, সেই অরিন্দম মুখার্জী এর আগেও বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। হাসনাবাদের প্রকাশ্য এক সভায় বলেন, প্রতিদিন সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ছবির সামনে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে তিনি অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করেন। আম্ফানের আগেও অরিন্দম মুখার্জী গত ডিসেম্বরে বুলবুলের তাণ্ডবের পর ত্রাণসংক্রান্ত ব্যপক অভিযোগের চাপে পড়েন।

এদিন পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড যখন বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসীকে নিয়ে বিডিও’র দপ্তরে পৌঁছয়। বিডিও-র সাথে দেখা করতে যান পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের কনভেনর বাসুদেব নাগ চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা একটি প্রতিনিধি দল, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরাই বেশী ছিলেন। বাসুদেব নাগ চৌধুরী জানান যে, বিডিওর কেবিনে ঢুকে যখন তাঁরা এই নির্লজ্জ প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণ জানতে চান, তৃণমূলের একাধিক নেতাকে ঢাল করে বিডিও জানান, তার পক্ষে আর ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া সম্ভব নয়৷ এমনকি প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করেন তিনি। উত্তরে প্রতিনিধিদল বিডিওকে জানিয়ে আসেন, যতক্ষণ না অব্দি বিডিও এব্যপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ততক্ষণ এই আন্দোলন থেকে এক পা-ও পিছোতে রাজী নয় পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড। তাঁর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাসুদেব নাগচৌধুরী আন্দোলনকারী গ্রামবাসীদের কাছে বিডিওর ঔদ্ধত্যের কথা জানালে তাদের ক্ষোভ দ্বিগুণ হয়ে যায় ও তখনই গ্রামবাসীদের সাথে কথা ব’লে ওখানেই অবস্থান বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নেয় পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড।

গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন যে, পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের নেতৃত্বে জুনের আন্দোলনের পর গত দেড় মাসে হাতে গোনা কয়েকজনের অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকার পরিবর্তে ঢুকেছে মাত্র ৫ হাজার টাকা এবং বাদবাকী অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখনও কানাকড়িও পায়নি সরকারের পক্ষ্য থেকে। আন্দোলকারীদের সূত্রে খবর, ইতিমধ্যে বিকেলের দিকে পুলিশ ও র্যাফ ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলে আন্দোলনকারী সাধারণ গ্রামবাসীরা উষ্মায় ফেটে পড়েন ও সেখানেই তাঁরা অফিসের গেট ভেঙ্গে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা চালাতে থাকেন। পুলিশ ও র্যাফ উভয়েই তাঁদেরকে আঁটকানোর মত জায়গায় ছিলোনা। কিছু সময়ের মধ্যেই যখন পরিস্থিতি প্রশাসনের হাতের বাইরে যাচ্ছে, পুলিশ আন্দোলনকারী ও বিডিও-শাসকদলের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টায় নামে। পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের নেতৃত্ব ও কনভেনরের সাথে কথা ব’লে পুলিশ বিডিওর সাথে দ্বিতীয় দফার বৈঠকের ব্যবস্থা করে সন্ধ্যা সাতটায়। পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড ও গ্রামবাসী আন্দোলনকারীদের সূত্রের খবর যে দ্বিতীয় দফায় যখন প্রতিনিধি দল বিডিওর ঘরে ঢোকে, তখন বিডিও বাধ্য হন তাঁদের কথা শুনতে। যে সমস্ত পরিবারগুলি এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি তাদের অ্যাকাউন্টে দ্রুত টাকা ঢোকানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। পাশাপাশি এ-ও জানান যে, যেসমস্ত পরিবারগুলি ইতিমধ্যেই মাত্র ৫ হাজার টাকা ক’রে পেয়েছে, তাদের বাকী ১৫ হাজার টাকা পেতে গেলে সরাসরি এসডিও-র সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তিনি এবিষয়ে আর কিছু করতে অক্ষম। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাঁকে তিরস্কার জানালে তিনি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ত্রিপল ও রান্নার বাসন পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করবেন ব’লে প্রতিশ্রুতি দেন। বিডিওকে পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন যে যদি দ্রুত তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি না রাখেন, তবে আগামী দিনের আন্দোলনে তাঁরা আর কোনওভাবেই বিডিও, সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে রেয়াৎ করবেন না। বিডিওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, এই আন্দোলন দিয়ে তাঁরা কেবল তাঁদের ক্ষমতার ভগ্নাংশটুকুই দেখিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি পালন করা না হলে তারা আরো বৃহত্তর আন্দোলনে যাবেন।

৩০ তারিখ প্রায় নয় ঘন্টার টানা অবস্থান-বিক্ষোভের শেষে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে জেলার প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে নতুন ধারার আন্দোলন-সংগ্রামের পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে। তৃণমূলের ব্যপক সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করেই যেখানে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ ও উগ্রদক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান হচ্ছে, সেখানে রাজ্যের মূলধারার বামেদের মধ্যে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ও নকশালদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজ যথাক্রমে জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে পোলারাইজড হয়ে যাচ্ছে বিজেপি-বিরোধীতার নামে। ঠিক তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে নতুন ক’রে মেহনতী মানুষের লড়াই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই নয়া-পদক্ষেপ রাজ্য-রাজনীতিতে নতুন উপাদান যোগ করছে৷
আম্ফানের ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে রেশনের চাল— চুরি-বাটপারির এক অভূতপূর্ব ট্র্যাডিশন বানিয়েছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যবাসী দেখেছেন যে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলির প্রভাবশালী নেতারা আম্ফানের বরাদ্দ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিজেদের পকেটস্থ করেছেন। চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, বাদ যাননি তৃণমূলের কোনও স্তরের নেতারাই! আম্ফান ঝড়ের ক্ষতিপূরণের ব্যয়বরাদ্দের মোট ৭২০০ কোটি টাকা নিয়ে তৃণমূল সরকারের কারচুপি ও কেলেঙ্কারি গত দু মাসে রাজ্যের সাধারণ মানুষের সামনে জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে।