করোনা আবহে লকডাউনে সরকারী রেশন বিতরণে তৃণমূল নেতাদের হস্তক্ষেপ ও তা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে এসেছিল। এরপর ২০শে মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলিতে ক্ষতিপূরণ ও ত্রাণবন্টনকে কেন্দ্র করে আরো বড় কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির অভিযোগের তীর তৃণমূল সরকারের দিকে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে নদীবাঁধ ভেঙে বন্যাকবলিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার সুন্দরবন এলাকা। এছাড়া ঝড়ের কারণে ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। আম্ফানের অব্যবহিত পরেই দুর্গত এলাকা হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আম্ফান দুর্গত এলাকাগুলির পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আর ১০০০ কোটি এবং রাজ্য সরকারের তরফে ৬২৫০ কোটি এবং অর্থাৎ মোট ৭২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় ‘আম্ফান রিলিফ ফান্ড’ নামক তহবিলে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন আম্ফানে যাদের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পরিবারপিছু ‘আম্ফান এইচ বি’ গ্রান্টে ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরবর্তীতে ঘোষণা করা হয় আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
আম্ফানে সুন্দরবনের প্রায় প্রতিটি ব্লকে নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় মাইলের পর মাইল এলাকা, সেসব অঞ্চলে প্রথমদিকে সরকারী তরফে ত্রাণকার্যের কার্যত কোনোরকম পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। আম্ফানবিধ্বস্ত জেলাগুলিতে ত্রানের দাবিতে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ ছবিটা আরো স্পষ্ট করে দেয়। প্রশাসন নিজেদের গাফিলতিকে আড়াল করতে গিয়ে বিভিন্ন এন জি ও এবং ধর্মীয় মাধ্যমে সরকারী ত্রাণকার্য চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন। এক শীর্ষস্থানীয় সরকারী আধিকারিক এও বলেছেন যে, ‘সরকারের হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ ত্রাণশিবির চালাচ্ছে’। সরকারের টাকায় কোনও প্রাইভেট ও ধর্মীয় সংস্থা কিকরে ত্রাণকার্য চালাতে পারে, তা নিয়ে প্রশাসনের দিকে বিস্তর প্রশ্ন ওঠার প্রবল সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়।
এ তো গেল ত্রাণের কথা। নজর দেওয়া যাক কেলেঙ্কারির মূল পর্ব অর্থাৎ ক্ষতিপূরণের দিকে। ক্ষতিপূরণ বিলি কে নিয়ে উঠে আসে একের পর এক অভিযোগ। দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগণা, বীরভূম, নদিয়া, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা প্রতিটি জেলা থেকে উঠে আসতে থাকে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারি হিসেবে এই ক্ষতিপূরণকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের কাছে দায়ের হওয়া অভিযোগের সংখ্যা ২১০০-রও বেশি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা, তা সম্পর্কে সরকারী প্রচার কার্যত শূন্য। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলিতে দীর্ঘদিন যাবত বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিসেবা না থাকায় ‘গ্রিভেন্স’ জানানোর পন্থা নিয়েও রয়েছে হাজারো প্রশ্ন। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলে আসে আম্ফানে ক্ষতিপূরণকে ঘিরে দুর্নীতির হরেক কিসিমের খবর। উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদে পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের নেতৃত্বে পাটলিখানপুর এলাকার মানুষ বিক্ষোভ দেখান হাসনাবাদ বিডিও অফিসে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধান ও গ্রাম পঞ্চায়েত মেম্বারদের বিরুদ্ধে। টাকা তছরুপে নাম জড়ায় জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ ফিরোজ কামাল গাজী-সহ তৃণমূল নেতাদের।
পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের হাসনাবাদ ছিল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। এরপর গোটা জুন মাস জুড়ে দুই ২৪ পরগণা-সহ আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলিতে ক্ষতিপূরণে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে শুরু হয় সাধারণ মানুষের একের পর এক বিক্ষোভ ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচী। উত্তর ২৪ পরগণার দেগঙ্গা, হিঙ্গলগঞ্জ, বাগদা, দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কাকদ্বীপ, রায়দিঘী, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী হাওড়ার উলুবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, সর্বত্র জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গণবিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন জায়গায় পঞ্চায়েত অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় কার্যত চাপের মুখে পড়ে সাফাই দিতে পড়েই ৬৫ জন মেম্বারকে নাম কে ওয়াস্তে শো-কজ করা হয় সরকারের তরফ থেকে, যদিও তাতে বিহিত কিছুই হয়নি। তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত মেম্বারকে সংবাদমাধ্যমের সামনে কান ধরে ওঠবোস করান গ্রামবাসীরা। ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানূষের রোষের মুখে পড়েন তৃনমুলের পঞ্চায়েত সদস্যরাও। সন্দেশখালির কালিনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ‘কালিপদ দাস’ নামক এক ব্যক্তির সন্তান পরিচয়ে বহু ব্যক্তির নাম ক্ষতিপূরণের তালিকায় নথিভুক্ত হয়েছে যাদের পদবী, ধর্মীয় পরিচয়েও বিভিন্নতা রয়েছে এবং যাদের প্রত্যেকেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ উঠে এসেছে। বসিরহাট মহকুমায় আবাদ-মোহনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি বুথে মেম্বার-সহ তাঁর পরিবারের মোট ১৮ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ২০ হাজার টাকা করে। হাসনাবাদের পাটলিখানপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একাধিক বুথে মেম্বার ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন বলে লিস্ট প্রকাশিত হয়েছে।
ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিয়ে দুর্নীতিতে কেবল তৃণমূল নয়, অভিযোগের তীর বিজেপি পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধেও। উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা ব্লকের হেলেঞ্চা গ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপির একাধিক মেম্বারের বিরুদ্ধে পরিবারের লোকেদের ক্ষতিপূরণ দেবার অভিযোগ উঠেছে ।
নদীয়া জেলাতেও উঠে আসে এরকমই একাধিক দৃশ্য। কারো ক্ষেত্রে নিজের পরিবারেই দুজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, আবার কোথাও ১০২ জনের তালিকার ৯১ জনই পঞ্চায়েত প্রধানের অত্মীয় নতুবা দলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যারা এমনকি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্যই নয়। হুগলী জেলার গরলগাছা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মনোজ সিং-এর নিজের মোবাইল নম্বরে একশো জনের নাম নথিভুক্ত করার দৃশ্য প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে সরকারি নিয়ম অনুসারে একটি মোবাইল নম্বরে একবারই মাত্র ক্ষতিপূরণ বরাত হওয়ার কথা।
এরকমই আরও বহু জায়গায় উঠে এসেছে অজস্র অভিযোগ যার কূল কিনারা পাওয়া দায়। কারচুপি এতটা ভয়ানক পর্যায়ে হয়েছে যে বহু মানুষের নামে জমা দেওয়া ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্রের সাথে নিজেদের ব্যাংক একাউন্টের নম্বর জুড়ে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটিয়েছে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। এমনকি এও অভিযোগ উঠেছে ক্ষতিপূরণের ফর্ম থেকে ক্ষতিগ্রস্ত আবেদনকারীর ফোন নম্বর নিয়ে বাড়ির ছবি ও ব্যাঙ্ক একাউন্ট নম্বর পালটে ফর্ম জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করে প্রশাসন একাধিক আন্দোলন-বিক্ষোভের ঘটনায় চাপের মুখে পড়ে কিছু অভিযোগ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রী সাফাই দেন, সিপিএমের সময় ১০০%-ই দুর্নীতি হতো, এখন মাত্র কয়েকটি অভিযোগ এসেছে। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী এমনও বলেন যে, আম্ফানে ১০০% মানুষ ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে গেছেন।
এবার এখানেই উঠে যায় গুরুতর এক প্রশ্ন। মুখ্যমন্ত্রীর দাবীমতো যদি ১০০% ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ হয়ে গিয়েই থাকতো, তবে পরে ৬ই এবং ৭ই অগাস্ট ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন জমা নেওয়ার কাজ আবার বিডিও এবং এসডিও অফিসে কেন শুরু করতে হলো রাজ্য সরকারকে? জেলায় জেলায় বিক্ষোভ, পঞ্চায়েত ভাঙচুর, পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যদের দুই সহস্রাধিক অভিযোগ মুড়ি-মুড়কির মত উঠল কিভাবে? এবং সবথেকে বড় প্রশ্ন সরকার কিসের ভিত্তিতে আংশিক ও পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এই দুই স্ল্যাব ক্ষতিপূরণ বিলিতে তৈরি করল? এত কম সময়ের মধ্যে কিভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাড়ি যাওয়া সম্ভব করল প্রশাসন? সরকারের মানরক্ষার্থে ‘১০০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে’ বক্তব্য রাখার পরেও কিভাবে ক্ষতিপূরণের জন্য আবার আবেদন করার বিজ্ঞাপণ দিল সরকার, তা নিয়েই উঠে যাচ্ছে প্রশ্ন।
সরকারি হিসেবমতো ৭২৫০ কোটি টাকা থেকে ১৫৫৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে ১৪.৮২ লক্ষ পরিবারের ক্ষতিপূরণ বাবদ। উঠে আসা অভিযোগ স্পষ্ট করে দেয় যে, এই খরচ হওয়া অর্থের এক বিপুল অংশই তৃণমূল নেতৃত্ব ও কর্মীদের পকেট ভারী করার কাজেই লেগেছে, এমনকি যে ক’টি জায়গায় লড়াই আন্দোলনের চাপে প’ড়ে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে, সেখানেও পূর্ণ ক্ষতিপূরণের দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও আংশিক ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০০ টাকা ক’রে দিয়ে দায় সারার চেষ্টাই করা হয়েছে সরকার ও প্রশাসনের তরফে। তাতে করেও আদৌ ১৪.৮২ লক্ষ পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণ গিয়েছে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। এখন প্রশ্ন হলো তহবিলের বাকি ৫৭৪৩ কোটি টাকা কোন খাতে বরাদ্দ হয়েছে সে বিষয়ে একটি বক্তব্য অবধি মেলেনি সরকারের তরফ থেকে! চিটফাণ্ড, নারদার তালিকায় কি তবে নতুন কেলেঙ্কারি হিসেবে যোগ হতে চলেছে ‘আম্ফান’?
প্রচ্ছদঃ কিংশুক চক্রবর্তী