রাজনৈতিক খুন, তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ এবং অকুস্থল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। তিনটি বিষয় যেন বারবার একই সুরে উচ্চারিত হতে থাকছে বঙ্গ রাজনীতিতে। বিধানসভা নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হতেই খুনোখুনির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ল তৃণমূল ও বিজেপি। এবারের অকুস্থল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের হৃদপিণ্ডে অবস্থিত টিটাগড়। রবিবার রাতে খুন হলেন টিটাগড়ের দৌর্দাণ্ডপ্রতাপ বিজেপি নেতা ও বিদায়ী কাউন্সিলর মনীশ শুক্লা। টিটাগড় থানার কাছেই ৯ রাউন্ড গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে দুস্কৃতিরা। ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-এর ছায়াসঙ্গী হিসেবে পরিচিত মনীশ খুনের পর থেকেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও তৃণমূল-বিজেপি তরজা।  

এলাকার দখলদারি, তোলাবাজি, নিয়ে তৃণমূল আমলে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে খুনোখুনি ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাস নবীন নয়। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমুলের বিধায়ক অর্জুন সিং লোকসভার টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে যাওয়ার পরেই এই সংঘর্ষের ধার ও ভার সর্বভারতীয় স্তরে খবরের আলোতে আসে। তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ প্রায় মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছায় ভাটপাড়া বিধানসভা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র ক’রে। অধুনা বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-এর গড় হিসেবে পরিচিত ভাটপাড়া কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে এই নির্বাচনের সময়ে। এমনকি কাকিনাড়া স্টেশনে গোলমালের জেরে শিয়ালদা মেইন-লাইনের ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয় বেশ কয়েকদিন। সেই ঘটনার রেশ যেন ফিরে এল টিটাগড়ে মনীশ শুক্লার খুনের ঘটনায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, গত রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ বিটি রোডে টিটাগড় থানার কাছে একদল বাইক আরোহী এসে পরপর গুলি চালায় মনীশ শুক্লার উপর। এই ঘটনা চাউর হতেই কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় এলাকা। খড়দা থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত এলাকায় যান চলাচল স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষের আশঙ্কায় এলাকায় নামানো হয় র‍্যাফ। সোমবার ব্যারাকপুর, নীলগঞ্জ, খড়দা ও টিটাগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে দফায় দফায় ছড়ায় উত্তেজনা। মনীশের মৃতদেহ নিয়ে বিজেপির নেতারা রাজভবনে সিবিআই তদন্তের দাবিতে রাজ্যপালের কাছে ডেপুটেশন দিতে যান সোমবার সন্ধ্যায়, যার দরুন উত্তেজনা ছড়ায় ধর্মতলার এস এন ব্যানার্জী রোডে। শেষে মনীশের পরিবারের সঙ্গে বিজেপির অর্জুন সিং ও সব্যসাচী দত্ত রাজ্যপালের কাছে যান দেখা করতে।

সোমবার ব্যারাকপুরের খড়দায় তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে চলে ইটবৃষ্টি। তৃণমূল যথারীতি বিজেপি নেতার খুনে তাদের হাত থাকার অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছে। তাদের দাবি টিটাগড়ের বিদায়ী কাউন্সিলর মনীশ বিজেপির রাজনীতিতে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, ফিরতে চেয়েছিলেন তৃণমূলে; আর তাই, বিজেপির গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরেই খুন হতে হয়েছে মনীশকে। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বিজেপির আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন সারাদিন অর্জুন সিং-এর সাথে হাওড়ার আমতা, বাউড়িয়ায় থাকার পর রাতে যখন অর্জুন গাড়ি থেকে নেমে যান, তখনই কেন খুন হতে হলো মনীশকে?  

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৭ সালে তেলিনিপাড়া মোড়ে ভদ্রেশ্বর পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান মনোজ উপাধ্যায় খুন হন। সেসময় বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ মনোজের খুনে তৃণমূলের ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। আরএসএসের প্রাক্তন কর্মী ছিলেন মনোজ উপাধ্যায়। আজ সেই ঘটনারই পুণরাবৃত্তি ঘটল গঙ্গার অন্য পাড়ে মনীশ খুনে।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে অর্জুন সিং-এর হাত ধরেই উত্থান মনীশের। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে অর্জুন সিং-এর খাস লোক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। অ-বাঙালী অধ্যুষিত টিটাগড় থেকে ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড়ের বেতাজ বাদশা হিসেবেও পরিচিত মনোজ। এলাকায় বে-আইনি প্রমোটিং থেকে অটোর রুট নিয়ন্ত্রন সবেতেই ছিল মনীশের হাত। গো-বলয়ের আদলেই চলত মনীশের শাসন। অধুনা বিজেপি হলেও, এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়েছিলেন মনোজ। এমনকি যে অর্জুন সিং-এর হাত ধরে তার উত্থান সেই অর্জুন ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে গেলেও মনীশ তৃণমূলেই থেকে যান। অর্জুন জেতার পর তিনি আসেন বিজেপিতে। মনীশের সাথেই আরেক প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তথা নোয়াপাড়ার বিধায়ক সুনীল সিং-ও আসেন বিজেপিতে।

একদা ভাটপাড়ার বাহুবলী তৃণমূল নেতা ও বিধায়ক অর্জুনের বিজেপির টিকিটে ব্যারাকপুর থেকে জয় এই শিল্পাঞ্চলের এলাকার দখলদারি, গুণ্ডাগর্দি, প্রমোটিং থেকে তোলাবাজির ভরকেন্দ্রের বিরাট পরিবর্তন করে দেয়। যার নেপথ্যে ছিলেন তৃণমূলের একদা ২ নং ও অধুনা সর্বভারতীয় বিজেপির সহ- সম্পাদক মুকুল রায়। কাচড়াপাড়া থেকে ব্যারাকপুর—তৃণমূল কাউন্সিলরদের কার্যত হিড়িক পরে যায় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার। সাথে একইভাবে চলতে থাকে এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তৃণমূল-বিজেপির সংঘর্ষ। কখনো তৃণমূল পার্টি অফিসের রঙ পালটে তা দখল করে বিজেপি, আবার কখনো বিজেপি পার্টি অফিসের সাইনবোর্ড খুলে তা দখল করে তৃণমূল। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার হিড়িক অবশ্য সবসময় সমান থাকেনি। অনেক কাউন্সিলর আবার তৃণমূল সরকারের পুলিশ প্রশাসনের চোখ রাঙানী এবং পুরোনো মামলাতে গ্রেপ্তারির ভয়ে আবারও ফিরে যান তৃণমূলে। বর্তমানে ভাটপাড়া ছাড়া এই অঞ্চলে সব পুরসভাই পুণর্দখল করেছে তৃণমূল।

বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই যেন তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তৃণমুল ও বিজেপির নিজেদের মধ্যেকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব— কখনো তা আম্ফানের ক্ষতিপূরণকে ঘিরে, কখনো বা দলীয় পদ নিয়ে। তৃণমূল ফেরত নেতাদের দর বাড়ছে বিজেপিতেও। একদা তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরাকে পদ দিতে বিজেপি সরিয়ে দিয়েছে একদা রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহাকে, যা নিয়ে প্রকাশ্যে বিজেপিকে এক হাত নিয়েছেন রাহুল।

ক্রমে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যত তৃণমূল-বিজেপির মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে, ততই বিভিন্নভাবে গরীবমানুষের হকের জিনিস লুটে খাওয়া, দুষ্কৃতি-দৌরাত্ম্য ও এলাকা সংঘর্ষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর সাথে তৃণমূল-বিজেপি দলবদলুদের কবজি আরো চওড়া হতে যাচ্ছে। বিজেপি-তৃণমূলের কাছে ধর্মীয় উস্কানি থেকে সিণ্ডিকেট, তোলাবাজি থেকে বে-আইনি প্রমোটিং, দাঙ্গাবাঁধানো থেকে খুন-ধর্ষণ— সমাজবিরোধী এমন সমস্ত অপকর্মে সিদ্ধহস্তরাই আজ কেন্দ্র-রাজ্য শাসকদলের ‘করোনা’ থুড়ি মুকুট।   

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *