অতলান্তিক মহাসাগরে মেক্সিকোর পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি ছোট্ট দ্বীপ হল পুয়ের্তো রিকো। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের পর্বেই এই দ্বীপটি স্প্যানিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। দীর্ঘ চারশো বছর স্প্যানিশ উপনিবেশ থাকার পর ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ-মার্কিন যুদ্ধ-এর মাধ্যমে দ্বীপটি স্প্যানিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পুয়ের্তো রিকো বর্তমানে বিশ্বের প্রবীণতম উপনিবেশ। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকিনলে বিখ্যাত “ফোরেকার অ্যাক্ট” প্রণয়ন করেন এবং মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট পুয়ের্তো রিকোকে “অন্তর্ভুক্ত নয় কিন্তু আপাত সীমানা ভুক্ত এলাকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীন” হিসেবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ পুয়ের্তো রিকোকে পূর্ণ মার্কিন রাজ্য কিংবা স্বাধীন দেশ, উভয় দিক দিয়েই বঞ্চিত রাখা হয়। এখানকার মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অধিকার পেলেও, ওয়াশিংটনের সেনেটে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার পায় না। এটি একটি “বিচ্ছিন্ন গভর্নর পরিচালিত এলাকা” হিসেবেই স্বীকৃতি পায় মাত্র এবং বেশ কিছু পূর্বতন গণতান্ত্রিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়।

প্রায় দুটি বিশ্ব যুদ্ধ সংগঠিত হয়ে যাওয়ার ৩০ বছর পর ১৯৭৩ সাল থেকে দ্বীপটিতে আরো নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। এই সময় থেকেই দেশটিতে গভর্নর কর্তৃক দ্বীপটির আয় ব্যয়ের হিসেবের ভারসাম্য তলানিতে যেতে থাকে। আয়ের থেকেও বাড়তে থাকে ব্যয়ভার এবং সেটি সামাল দিতে নতুন কোনো অর্থনৈতিক বাজেটের বদলে বেশ কিছু উৎপাদন ক্ষেত্র এবং ভার্চুয়াল পণ্য ভিত্তিক সরকারি ঋণপত্র বিলি করতে থাকে সেখানকার আঞ্চলিক সরকার! ফলত সমস্যা আরো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। তার সাথে চাপতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে নেওয়া ঋণ ভাড়ের বোঝা এবং সঞ্চয়ের নিম্নগামী হার। তাছাড়াও, সমকালীন সময়ে “জোন্স শ্যাফ্রথ অ্যাক্ট” অনুযায়ী প্রত্যেক পুয়ের্তো রিকান সরকারি ঋণপত্র বিলি পিছু মার্কিনীদের “ট্রিপল ট্যাক্স এক্সেম্পশন” (ফেডারেল ট্যাক্স, স্টেট ট্যাক্স, লোকাল ট্যাক্স) লাগু করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে পুয়ের্তো রিকোর উপর ব্যাঙ্ক জালিয়াতির অভিযোগও টেনে আনে মার্কিনীরা। ফলপ্রসূত ১৯৯৬-২০০৪ সালের মধ্যে মোট ৮০,০০০ পুয়ের্তো রিকোবাসী চাকরি হারান এবং সেলস্ ট্যাক্স প্রায় ১১% বাড়িয়ে দেওয়া হয় ঋণ শোধের নামে। তার উপরে পুরোনো মার্কিন আইন অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মূল মার্কিন দেশ থেকে পুয়ের্তো রিকো দেশে আসতে হলে মার্কিন জাহাজে করেই আসতে হবে, যার ফলে সেগুলো আমদানি করাও হয়ে যায় ব্যয়বহুল এবং ফলস্বরূপ জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিও হয়ে ওঠে আকাশ ছোঁয়া।
পুয়ের্তো রিকো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক চাপানোতরের মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্রপুঞ্জ ও কমনওয়েলথ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি পুয়ের্তো রিকোর উপর “প্রোমেসা” নামের একটি আইন প্রস্তাব করে, যা আদতে দেশটির ঋণ মেটানোর নামে চক্রাকারে ঋণ নিতে বাধ্য করে, ট্যাক্স বাড়াতে বাধ্য করে এবং মিতব্যয়িতা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে দ্বীপটির সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া, ২০১৭ সালের ‘মারিয়া’ ঘূর্ণি ঝড়ের প্রকোপে দ্বীপটির কাঠামোগত সংস্থান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে দ্বীপটির কমনওয়েলথ ঋণের পরিমান ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে পুয়ের্তো রিকোর মোট ঋণ তাদের জিডিপি-এর ৬৪% যার ৪২% অর্থাৎ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সেখানকার বসবাসকারী সাধারণ মানুষের উপর বর্তায়। যে ছোট্ট দ্বীপটির প্রতিটি বাসিন্দার গড় আয় ১৬,৩০০ মার্কিন ডলারেরও নীচে এবং প্রায় ৪১% মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে রয়েছেন, তাঁদের পক্ষে এই ঋণভার যে জীবন ও জীবিকার উপর নেমে আসা এক প্রকার অর্থনৈতিক আঘাত ছাড়া আর কিছুই না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই চরম অর্থনৈতিক দুরাবস্থার পটভূমিকাতেই সেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উত্তরোত্তর সরগরম হয়ে চলেছে। সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলি মূলত তিন ধরণের দাবীতে বিভক্ত। প্রথমত, ২০১২-র গণভোটে সেখানকার সাধারণ মানুষ দ্বীপটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষেই রায় দিয়েছিল কিন্তু মার্কিন সেনেট তা কার্যকারী হতে বাধা দেয়। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জানিয়ে দেন যে পুয়ের্তো রিকোর ঋণের দায় মূল মার্কিন ভূখণ্ড নেবে না। অর্থাৎ নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থানের নিরিখে দ্বীপটিকে ঋণের চক্রে ফাঁসিয়ে, আজ নিজেরা দায় নিতে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে মার্কিনীরা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে পুয়ের্তো রিকো আসলে তাদের একটি উপনিবেশ। তাছাড়া, মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে যাওয়ার স্বপ্নে বর্তমান ক্ষমতাসীন নিউ প্রোগেসিভ পার্টি বিভোর হয়ে থাকলেও তা আদতে “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস”-এর মত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, বরং বাড়াবে কারণ অন্তর্ভুক্তির প্রধান শর্তই হল ঘাড়ের উপর চেপে যাওয়া ফেডেরাল ট্যাক্স। এই অবস্থানের ঠিক উল্টোদিকে পপুলার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দ্বীপটিকে বর্তমান অবস্থাতেই রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চাইছে। অন্যদিকে, ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি ও সেখানকার ২০১০ সালে পুনর্গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি (কমিউনিস্ট রিফাউন্ডেশান পার্টি) একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র পুয়ের্তো রিকোর কথা বলছে। ইতিমধ্যেই এই কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ মানুষের আমেরিকা বিরোধী জনমত একত্রিত করে স্বাধীন দেশের রূপরেখা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন সহ কিছু প্রলেতারীয় মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়।

ইতিমধ্যে সেখানকার চলতি সরকারের গভর্নর রিকার্ডো রসেলো-র একটি বিস্ফোরক পার্সোনাল টেক্সট মেসেজ এবং ভিডিও কল লিক আউট হয়েছে যেখানে রসেলো এবং তাঁর সতীর্কেথদের নারী বিদ্বেষী এবং সমকামী বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে শোনা যায় যার ফলে সেখানকার সাধারণ মানুষের এক বিরাট প্রতিবাদের ঝড় নেমে এসেছে। রসেলো অবশ্য এই বিষয়ে সেরকম কোনো স্বীকারোক্তি এখনো দিয়ে ওঠেননি। কিন্তু জনরোষের চাপে ২রা অগাস্ট পদত্যাগ করার কথা জানিয়েছেন। পরবর্তী সম্ভাব্য গভর্নর পেদ্রো পিয়ের্লুইসি আদতে মূল ভূখণ্ডের অধিবাসী। ফলে তিনি দ্বীপটিতে নিউ প্রোগেসিভ এবং মূল ভূখণ্ডে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য। তিনি ১১৬তম মার্কিন কংগ্রেসেরও সদস্য! এই দুমুখো মূল ভূখণ্ডের দালাল রসেলোর স্ক্যান্ডেলকে কাজে লাগিয়ে জনরোষকে বিপথগামী করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পথেই হাঁটবে বলে জল্পনা রয়েছে। তাই স্বাধীনতার লড়াই এবং মার্কিন দাদাগিরি থেকে মুক্ত খেটে খাও-বাদীদের পরিচালিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়নের লড়াই-ই একমাত্র বর্তমান ঋণ সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।