পৃথিবী জুড়ে বিশ্বায়নের জিগির যখন তুঙ্গে, তার মাঝেই গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের অন্তঃসংঘাত। এই সংঘাত মূলত দুই দেশের মধ্যবর্তী ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ নিয়ে শুরু হলেও, বর্তমানে সেটা শুধুমাত্র আর সেখানে আটকে নেই। ইতিহাসগতভাবে ১৮৫৬ সালে ক্রাইমিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন প্যারিস চুক্তিতে রাশিয়া নিজেদের পরাজয় স্বীকার করে এবং ক্রাইমিয়া অন্তর্গত সেভাস্তোপোল বন্দরটি থেকে অধিকার চ্যুত হয়। এরপর ১৮৭০ সালের ফ্রান্স-রাশিয়া যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে পুনরায় রাশিয়া এই বন্দরটি পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী হয়। এরপর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি সেভাস্তোপোলে বোমা বিস্ফোরণ করলে ভয়াবহ ধ্বংসের সম্মুখীন হয় বন্দরটি। যদিও রাশিয়ার তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক নেতা জোসেফ স্তালিন সেই সময় শহরটিকে “হিরো সিটি”-র আখ্যা দেন। পরবর্তীকালে রুশ নেতা খ্রুশ্চেভ ক্রাইমিয়া ইউক্রেনীয় সোভিয়েতের অন্তর্গত করে দেন। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৭ সালে কৃষ্ণ সাগর সংলগ্ন ক্রাইমিয়া দ্বীপ অন্তর্ভুক্ত সেভাস্তোপোল দ্বীপটিকে নিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে জলসীমা সহ আরো কিছু বিশেষ শর্ত সাপেক্ষ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যার মাধ্যমে রাশিয়া ২০৪২ পর্যন্ত এই দ্বীপটির ইজারা পায়। আবার অশান্তির সূত্রপাত ২০১৪ সালে, যখন জলসীমা লঙ্ঘন করে ইউক্রেনের তিনটি জাহাজ নোঙ্গর করে ক্রাইমিয়া উপদ্বীপে এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রাশিয়া ওই তিনটি জাহাজ আটক করে এবং রাশিয়ানদের গুলিতে জাহাজের ছ’জন ক্রু আহত হয়। এরপর রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের সামরিক লড়াইয়ে ডোনেস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে মৃত্যু হয় প্রায় দশ হাজার মানুষের। মূল ঘটনাটি ঘটেছিল রাশিয়া এবং ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের মাঝামাঝি এলাকায় নৌ পথে, যা কেরচ স্ট্রেইট নামে পরিচিত। কৃষ্ণ সাগরের ওডিসি বন্দর থেকে রওনা হয়ে আজোভ সাগরের মারিউপোলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ইউক্রেনের দুটি জাহাজ যা রাশিয়া জলসীমা লঙ্ঘন বলে দাবি করলেও ইউক্রেন দাবি করছে, ২০০৩ সালে সাক্ষরিত মস্কো ও কিয়েভ চুক্তি অনুযায়ী কেরচ স্ট্রেইট এবং আজোভ সাগরের উপর দুই দেশেরই অংশীদারিত্ব আছে। তবুও রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নৌ পথে আগ্রাসনের অভিযোগ আনছে এবং তারা আজোভ সাগরের উপর তৈরী একটা রাশিয়ান ব্রিজের নিচে ট্যাঙ্কার মোতায়েন করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সংসদীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রাইমিয়ায় রাশিয়ান সৈন্য পাঠিয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়াকে সমর্থনকারী জনগণের হাত মজবুত করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো সংসদে সামরিক শাসন জারি করার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাশিয়ার বিরোধিতায় বেশ অগ্রসর ভূমিকা পালন করছে সেখানকার প্রেসিডেন্ট এবং একদা কৌতুক অভিনতা ভলদিমির ঝেলিন্সকি এবং রাজনৈতিক সংগঠন “সার্ভেন্ট অফ দা পিপ্ল্” (নামটি ইউক্রেনের একটি জনপ্রিয় ছোট পর্দার অনুষ্ঠান থেকে অনুপ্রাণিত)। তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো-র সাথে টরন্টো কনফারেন্স-এ আয়োজিত একটি বৈঠকে বসেন এবং কানাডা সাহায্যের হাত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে নিজের দেশের অস্ত্র ব্যবসা চাঙ্গা করতে উদ্যত হয়। ফলস্বরূপ, অটোয়া সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেনে কানাডার ২০০টি পৃথক সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা থাকবে। এর পূর্বেই ২০১৫ সাল থেকে প্রায় ১১,০০০ ইউক্রেনিয়ান সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয় কানাডার তরফ থেকে। শুধু তাই নয়, কানাডার অর্থমন্ত্রী ইউক্রেনকে সাহায্যার্থে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ ঘোষণা করেন।

এই সরগরম পরিস্থিতির মধ্যেই সাম্প্রতিককালে ইউক্রেনে অবস্থিত রাশিয়া দূতাবাসের সামনে গণবিক্ষোভ দেখানো এবং গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সাথে চলছে সশস্ত্র সামরিক লড়াই। অন্যদিকে, ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেরচ স্ট্রেইটে রাশিয়াকে যাতায়াতের পথ উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে এবং তারা এও বলেছে যে কেরচ-এ রাশিয়া যে ব্রিজ বানিয়েছে, তা আসলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। উল্টোদিকে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মতে ইউক্রেন তথা সমগ্র বিশ্বের উপর এক অর্থনৈতিক ধাক্কা। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া তাঁর একটি সাখ্যাৎকারে তিনি জানান মারিউপোল থেকে উৎপাদিত লোহা আর স্টিল তাঁর দেশের ২৫ ভাগ অর্থনৈতিক চাহিদা মেটায়, যা এখন রাশিয়ার দখলে। সাম্প্রতিক ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের ঝেলিন্সকিকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ সামরিক সাহায্যের পরিবর্তে বিরোধীদের ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের ষড়যন্ত্র সামনে এসেছে।
এমতাবস্থায়, দুই দেশেরই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবনতি দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে একটি রিপোর্টে জানা গেছে ইউক্রেনে ড্রাগস্ এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ দ্রব্যের পাচার বেড়েছে বহু গুণ, যার মাশুল দিতে হচ্ছে দুই দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের। পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন দেশে লুটে খাওয়াদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিভিন্ন সময়ে বেড়ে উঠছে।
গত ১০ই নভেম্বর থেকে ইউক্রেন এবং রাশিয়া ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে ২০১৪ সাল থেকে চলে আসা সামরিক লড়াই থেকে পিছিয়ে এসে সেনা প্রত্যাহার করতে শুরু করে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে আলোচনার পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তু এই সাময়িক যুদ্ধ বিরতি সাধারণ মানুষকে সুরাহা করে কিনা সেটাই এখন দেখার।