গোটা লেবানন জুড়ে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে তার প্রধান কারণ হিসাবে সাদ হারিরির সরকারের নয়াউদারবাদী পদক্ষেপগুলিকেই দায়ী করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে ফিউচার মুভমেন্ট পার্টির সরকারের মিতব্যায়িতার অর্থনীতি ও দেশজুড়ে চলতে থাকা ব্যাপক বেকারত্বের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনরোষের সৃষ্টি হয়েছিল। তার উপর সরকারের ইন্টারনেট ফোনকল পরিষেবা, গ্যাসোলিন ও তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর অত্যাধিক কর চাপানোই হয়ে ওঠে এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কারণ। ১৭ই অক্টোবর, রাজধানী বেইরুট শহরে প্রায় ১০,০০০-এর ওপর সাধারণ জনতা সরকারের এই নয়া কর চাপানোর প্রতিবাদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে এই আন্দোলনের সূচনা করে। অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া এবং বর্তমানে চলতে থাকা আন্দোলনকে প্রতিহত করতে লেবানন সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছে সেখানকার কুখ্যাত উগ্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিজবুল্লাহ। এই আন্দোলন চলাকালীন ১২ই নভেম্বর রাজধানী বেইরুটের খুব নিকটে খালদে শহরের এক প্রতিবাদ মিছিলে প্রোগ্রেসিভ সোস্যালিস্ট পার্টির সদস্য আবু ফকর নামক এক জনৈক ব্যক্তি লেবানিজ মিলিটারীর গুলিতে নিহত হন। মিলিটারী জানায় যে তারা রাস্তা খালি করতে আকাশে গুলি ছুঁড়লে সেই গুলি ভুলবশত ঐ ব্যক্তির গায়ে এসে লাগে। তবে আবু ফকরের স্ত্রীর বক্তব্যে জানা যায় যে সে সাধারণ পোশাক পরিহিত এক ব্যাক্তিকে সামনে থেকে গুলি চালাতে দেখেছে এবং লেবানিজ ইন্টেলিজেন্সই এই হত্যার জন্য দায়ী। পরবর্তী সময়ে মিলিটারী ঐ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কোর্ট ট্রায়ালে পাঠিয়েছে বলে জানায়। প্রসঙ্গত এই প্রোগ্রেসিভ সোস্যালিস্ট পার্টি একটি সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং সংখ্যালঘু ড্রুজ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন পুষ্ট।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লেবানিজ সরকারের নয়াউদারবাদে প্রবেশ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা জানতে গেলে মার্চ ১৪ অ্যালায়েন্স-এর কথা উঠে আসবেই। লেবাননকে একসময় সিরিয়ান সৈন্য দখল করে এবং তৎকালীন সিরিয়া সমর্থিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কারিমি, সাদ হারিরির পিতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যা করে। এরপরেই সাদ হারিরির ফিউচার মুভমেন্ট পার্টি ও অন্যান্য সিরিয়া বিরোধী সংগঠনগুলি রফিক হারিরির হত্যার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কারিমিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ও সিরিয়ার সৈন্যকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে আন্দোলন শুরু করে, যা সেদার বিপ্লব নামেও পরিচিত৷ এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৪ই মার্চ, ২০০৫ এবং প্রোগ্রেসিভ সোস্যালিস্ট পার্টিসহ অন্যন্য সিরিয়া বিরোধী সংগঠনগুলি এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এরপরেই ২০০৫ সালে ফিউচার মুভমেন্ট পার্টি এই মার্চ ১৪ নামের একটি সিরিয়া বিরোধী অ্যালায়েন্স তৈরি করে, যাতে নিহত আবু ফকরের প্রোগ্রেসিভ সোস্যালিস্ট পার্টিও যুক্ত আছে। সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও সিরিয়ান দখলদারীর সমর্থক হিজবুল্লাহ এই অ্যালায়েন্সের বিপক্ষে ছিল এবং অন্যদিকে ইউ.এস.এ, ফ্রান্স-এর মতো দেশগুলি এই অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করেছিল। এর থেকে এটা খুব সহজেই বোঝা যায় বর্তমান হারিরি সরকারের নয়াউদারবাদী কার্যকলাপের পেছনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক কতখানি প্রভাব রয়েছে!
বস্তুত লেবানন রিসেশনে প্রবেশ করেছে, তার ফলস্বরূপ এই আন্দোলন দেখা যাচ্ছে। গ্রীসের পথেই লেবাননের ব্যঙ্কগুলি দেউলিয়া হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। লেবানিজ মুদ্রার মূল্য দিনের পর দিন পড়ে চলেছে। লেবাননের রেভেনিউ অর্থাৎ সরকারের আয় যেখানে ১২ বিলিয়ন ইউ.এস. ডলার সেখানে ঋণের পরিমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ বিলিয়ন ইউ.এস. ডলার যা কিনা দেশের জিডিপির প্রায় ১৪৯%। দেশের কমার্শিয়াল ব্যঙ্কগুলি এই সরকারি ঋণের ৮৫% বহন করছে এবং শেয়ার বাজারে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে যে বন্ড তারা ছেড়ে রেখেছে, সেই পরিমাণ অর্থ তারা তুলে আনতে পারছে না, যার ফলে পাবলিক সেক্টরগুলি ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। একইসাথে বেড়ে চলেছে অনাদায়ী ঋণের পরিমান।
রিসেশনের এই মরণ কামড়ে প্রায় ৪ লক্ষ পরিবারের মানুষ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে চলেছে, প্রায় ৩ লক্ষ ১০ হাজার কর্মক্ষেত্র কাজ হারাতে চলেছে এবং প্রায় ১লক্ষ ৫ হাজার মানুষ পেনশনসহ তাদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট খুইয়ে পথে বসতে চলেছে। এই ভয়ানক অর্থনৈতিক ক্রাইসিস ও জনরোষকে সামাল দিতে একদিকে সরকার যখন মিলিটারী দিয়ে আন্দোলনকে রুখে দিতে চাইছে, যার জন্য প্রায় ২০ হাজার মিলিটারী নতুন করে নিয়োগ করা হয়েছে, অন্যদিকে ব্যঙ্ক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে যার ফলে আদতেই জাতীয় লগ্নীর ক্ষমতা লোপ পেয়েছে এবং ব্যপক মুদ্রাস্ফীতি দেখে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতে দাড়িয়ে আই.এম.এফ. বা ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাকে সামাল দিতে অর্থ বিনিয়োগে রাজি হলেও তার শর্ত হিসেবে জানিয়েছে যে পেনশন বন্ধ করে দিতে, নতুনভাবে কর্মসংস্থান বন্ধ করতে এবং বিদ্যুৎ পরিষেবায় সরকার প্রদেয় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ইউ. এস. ডলার ভর্তুকি বন্ধ করতে যাতে তারা বিনিয়োগ করা অর্থকে নিজেদের সর্বাপেক্ষা রেভেনিউ জেনারেশনের কাজে লাগাতে পারে। আই.এম.এফ. প্রদত্ত এই শর্তগুলি আদতেই নয়াউদারবাদী অর্থনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্বরূপ মিতব্যায়িতাকেই নির্দেশ করে। এই পরিস্থিতিতে নয়াউদারবাদী সরকারের বিরুদ্ধেই চলছে লেবাননের জনতার এই প্রতিবাদ।