দীর্ঘ ৩০ বছর পর ধর্মনিরপেক্ষ হচ্ছে সুদান
বিশ্ব মন্দার নাগপাশে দেশে দেশে ধর্মীয়-বর্ণীয় কট্টরপন্থীদের রমরমা, রাষ্ট্র এবং ধর্মকে মিশিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চলছে, চলছে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার; তখন আঁধারে প্রদীপের মত আফ্রিকার সুদান দীর্ঘ ৩০ বছরের ইসলামিক শরিয়তি আইনের অবসান ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে।
গত ৩রা সেপ্টেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদিস আবাবাতে ‘সুদান পিপ্ল্’স লিবারেশন মুভমেন্ট-নর্থ’ (এস.পি.এল.এম-এন) বিপ্লবী গোষ্ঠীর নেতা আবদেল-আজিজ আল-হিলু এবং সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামডক মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে সুদানে বলবত থাকা ইসলামী শরিয়তি আইনের সংশোধন করে সুদানের ধর্মনিরপেক্ষ শাসনকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
দুপক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে আছে “সব নাগরিকের অধিকার রক্ষার্থে গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে ওঠার জন্য সুদানের সংবিধানের ভিত্তি হতে হবে ‘রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণ’, যার মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান জানানো হবে”। সকল সুদানবাসীর সব ধর্ম পালনে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। চুক্তিতে আরও আছে যে “রাষ্ট্রের কোন অফিসিয়াল ধর্ম থাকবে না। ধর্মের ভিত্তিতে কোন নাগরিকের প্রতি কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে না” বলে জানাচ্ছে চুক্তি।
রাষ্ট্রীয় ধর্ম নিয়ে সুদানে সমস্যা নতুন নয়। ইতিপূর্বে ধর্মীয় কারণে দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ চলার পর ২০১১ সালে গণভোটের ভিত্তিতে খ্রীষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদান সালভিয়া কির মায়ারডীটের নেতৃত্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দক্ষিণ সুদান রাষ্ট্র তৈরি করেছে। অবশ্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মায়রডীটের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অনুচর রিক মাকার তার বিরুদ্ধে বিদেশী মদতে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকেন, ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধের শিখা আজো ধিকিধিকি জ্বলছে।
সুদান সরকার এবং ‘সুদান পিপ্ল্’স লিবারেশন মুভমেন্ট-নর্থ’-এর মধ্যে চুক্তি মোতাবেক সুদানের জন্য ফেডেরাল ব্যবস্থা এবং দক্ষিণ কোরডফান ও নীল নদ অঞ্চলকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়ার কথাও সুপারিশ করেছে।
১৯৮৯ সালে ওমার আল-বসির সুদানের ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে শরিয়তি আইনের কট্টরপন্থাকে লাগু হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল সুদানকে ‘ইসলামিক বিশ্বের অগ্রণী’ করা। এই প্রক্রিয়ায় অন্য ধর্মালম্বী(বিশেষত দক্ষিণ সুদানে বসবাসকারী খ্রীষ্টান) এমনকি শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদেরও উপর অত্যাচার নেমে আসে। এর সাথে বসিরের মাথায় ছিল বিশ্বের তাবড় খনি ও পেট্রোলিয়াম জায়ান্ট সংস্থাগুলির হাত । লোহিত সাগরের বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সোনা উত্তোলক হাসাইকে কেন্দ্র করেও সুদানে বিবাদের সূত্রপাত হয়, এছাড়া দক্ষিণ সুদানের পেট্রোলিয়াম, জিপসাম ও ক্রমিয়াম খনিগুলিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের ফলে সুদান আল-কায়দা এবং কারলোস দ্য জ্যাকেলের মত জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি হয়ে ওঠে বলে আন্তর্জাতিক মহলের মত।
অন্যদিকে ‘সুদান পিপ্প্ল্’স লিবারেশন মুভমেন্ট-নর্থ’ জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল। বিশেষত স্বাধীন দক্ষিণ সুদানের আত্মপ্রকাশের পর থেকে জনসমর্থনও বাড়তে থাকে তাদের। এছাড়া সুদানের ভয়াবহ বন্যার পর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। এই পরিস্থিতিতে গত বছরই সরকার পক্ষ এবং বিপ্লবী গোষ্ঠীর মধ্যে বরফ গলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এস.পি.এল.এম-এন সাফ জানিয়ে দেয় ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাকে নিশ্চিত না করলে কোনোরকম চুক্তি স্বাক্ষর করতে তারা নারাজ। অবশ্য এস.পি.এল.এমের অন্য কয়েকটি গোষ্ঠী এই চুক্তির বিরোধিতাও করেছে। দীর্ঘ আলোচনা চলার পর অবশেষে নতি স্বীকার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পক্ষ শান্তি চুক্তি করতে উদ্যোগী হয় যা সিংহাসনচ্যুত একনায়ক বসিরের আমলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দারফুর ও অন্যান্য অঞ্চলে শান্তি আনবে বলে আশা করা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
এই চুক্তির বিরুদ্ধে মৌলবাদী বসিরের সমর্থকেরা ইতিমধ্যে এই সরকারকে ‘ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্থ’ বলে একাধিক জায়গায় বিক্ষোভ শুরু করেছে।
ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রের স্লোগানে ধর্মীয় ও বর্ণীয় সংখ্যালঘুরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অত্যাচারিত হচ্ছে তখন নয়াউদারবাদের যুগে মৌলবাদী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এই জয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার আলো দেখাবে বলে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলের।