দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া দেশের শ্রম আইনে সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল। জোকো উইডোডোর নেতৃত্বাধীন সরকারের করা শ্রম আইনে নয়া সংশোধনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা। সর্বনাশা এই ‘নয়া-কর্মসংস্থান’ বিল গত ৫ই অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার সংসদে পাশ হয়েছে। এই আইনে মুখ্যত ন্যুনতম মজুরির উপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া, কাজের সময় বাড়ানো এবং ইন্দোনেশিয়ায় আউটসোর্সিং বাড়ানো সহ একগুচ্ছ ধারা সংযোজিত হয়েছে। যার মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার সরকার বিদেশী পুঁজি অনুপ্রবেশের পথকে প্রশস্ত করেছে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, এই বিলটি ইন্দোনেশিয়ার সংসদে আইন বহির্ভূতভাবে তড়িঘড়ি পাশ করানো হয়েছে, কেবলমাত্র শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে। একইসাথে এই আইনের মাধ্যমে সমস্ত পরিবেশগত বিধিনিষেধ লঘু করে ইন্দোনেশিয়ায় বড় ও বিদেশী কর্পোরেটদের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে অভ্যর্থনা করা হচ্ছে । বিক্ষোভ ঠেকাতে ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ কড়া দমননীতি নিয়েছে কাঁদানে গ্যাস থেকে শারীরিক আক্রমণ কোনো কিছুই বাদ যায় নি, যার ফলে ২৪ জন ছাত্র বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হয়েছেন।
প্রথমদিকে বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল ইন্দোনেশিয়ার সবথেকে জনবহুল দ্বীপ জাভার জাকার্তা এবং বান্দুং। কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্ষোভ গোটা ইন্দোনেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে পুলিশের আক্রমণের তেজ যত বেড়েছে ততই বিক্ষোভের ধার ও ভার চতুর্গুণ হয়েছে, যার ফলে দেশের উদারপন্থীদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। বিশেষত কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে বিক্ষোভ ক্রমেই সরকারবিরোধী এক সংঘর্ষে পর্যবসিত যা কার্যত অবশ্যম্ভাবী হতে চলেছে ইন্দোনেশিয়ায়। বিশেষত ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে যেখানে এর আগেও বহুবার রাস্তায় সাধারণ মানুষের সংগ্রামে উত্তাল হয়েছে দেশ।
এর আগেও আমেরিকার মদতপুষ্ট সুহার্তো সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯৮-তে উত্তাল হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। গত বছরেও ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি- দমন কমিশনের ডানা ছাঁটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল দেশ। এই দুর্নীতি-দমন কমিশনের মুকুটে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা ও কর্পোরেটদের শাস্তি দেবার একাধিক পালক রয়েছে। সেই বিক্ষোভে ঘি ঢালে সরকারের প্রাইভেসি পলিসিতে সংশোধনী আইনের প্রণয়নে, যাতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ চর্চাকে দণ্ডনীয় অপরাধের তকমা দেওয়া হয়।
প্রত্যাশিতভাবে নয়া শ্রম আইনের সংশোধনীকে ইন্দোনেশিয়ার কর্পোরেটমহল এবং চেম্বার অব কমার্স স্বাগত জানিয়েছে। আম-ইন্দোনেশিয়াবাসীর প্রতিবাদকে খাটো করে তারা জানিয়েছে যে এই আইনের মাধ্যমে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে ,যা দেশের সংকটে থাকা অর্থনীতির পরিত্রাতা হতে চলেছে। এদের সুরে সুর মিলিয়ে সরকারের বক্তব্য দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যেই এই বিল। এর মাধ্যমে একইসাথে শিল্প তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া লাঘব করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে নয়া সংশোধনী বিশ্লেষণ করে অন্য সুরই মিলেছে। তথাকথিত ‘মধ্য-বাম’ দল বলে পরিচিত পি.ডি.আই(ডি) কার্যত এই সংশোধণীর মাধ্যমে কর্পোরেটদের মুনাফা করার পথকেই প্রশস্ত করেছে।
শ্রম আইনে এই সংশোধনীতে সবথেকে বড় কোপ পরেছে কাজের সময় এবং ন্যুনতম মজুরির উপর। কেবলমাত্র ইন্দোনেশিয়ায় নয় করোনা অতিমারির এই পর্বে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এহেন আক্রমণ নেমে আসছে বা আসতে চলেছে শ্রমিকদের উপর। জাকার্তা, মেডং এবং বান্দুং-এর বিক্ষোভ তাতে আরো রসদ জোগাবে বলেই মত আন্তর্জাতিক মহলে।
উইডোডো সরকারের আনা ‘কর্মসংস্থান আইন’-এর নির্যাস হলো-
১) এই সংশোধণির মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় আউটসোর্সিং-এর উপর যে বিধিনিষেধ ছিল তা লঘু করা হয়েছে।
২) নতুন একমাত্র বেশী- ঝুঁকির শিল্প ও বাণিজ্য পরিকাঠামো তৈরি ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র আর আবশ্যিক রইল না।
৩) শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কর্মীদের এবার থেকে সপ্তাহে একদিনই ছুটি দেওয়া যাবে এবং অতিরিক্ত মজুরি দিনে ৪ ঘন্টার এবং সপ্তাহে ১৮ ঘন্টার বেশী দেওয়া যাবে না।
৪) নয়া সংশোধনীতে সেক্টর ভিত্তিক ন্যুনতম মজুরিকে খারিজ করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রাদেশিক সরকারগুলিকে মজুরি নির্ধারণের দ্বায়িত্ব দিয়েছে।
৫) ইন্দোনেশিয়ায় ইতিপূর্বে বেসরকারী ক্ষেত্রে চালু থাকা অবসরকালীন বেতন (সেভেরান্স পে) চালু ছিল ৩২ মাসের জন্য। বর্তমানে এই বিধি শিথিল করে তা ১৯ মাসে নামিয়ে আনা হলো এবং তার পরবর্তী ৭ মাস এই টাকা সরকার নিজের তহবিল থেকে দেবে।
প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে চলা ‘কর্মসংস্থান’ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে আন্তর্জাতিক মহলে ইন্দোনেশিয়ার সরকার যারপরনাই অস্বস্তিতে, তাই কড়া হাতে বিক্ষোভে রাশ টানতে চাইছে তারা। সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশ ইতিমধ্যেই ৬০০ জনকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেপ্তার করেছে। কনফেডেরশন অফ ইন্দোনেশিয়ান ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সহ ৩২-টি ট্রেড ইউনিয়ন গত বৃহস্পতিবার এক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল যা সরকারের উপর আরো চাপ বাড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের এক্মাত্র দাবি নয়া সংশোধিত আইন প্রত্যাহার। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশের আক্রমণ যেভাবে আরো বিক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে সেই প্রেক্ষিতে ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন কি করে তাই দেখার।