বিক্রি কার্যত তলানিতে, বিপুল সংখ্যায় অবিক্রিত গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি কারখানায়, ব্যাঙ্ক বহির্ভূত ফিনান্সিং কোম্পানিগুলিও(এনবিএফসি) সংকটের মুহুর্তে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে; যার জেরে গভীর সংকটের মুখে ভারতের গাড়ি উৎপাদন শিল্প। ভারতের গাড়ি প্রস্তুতকারক বিভিন্ন সংস্থা পৃথকভাবে তাঁদের রিপোর্টে গাড়ি ও মোটরবাইক বিক্রিতে হতাশার ছবিটাই দেখাচ্ছে এবং এর সাথে প্রায় ১০ লক্ষ গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক ছাঁটাই এর আশঙ্কায় ভুগছেন।
২০১৯-২০২০ অর্থবর্ষের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের গাড়ি ও মোটরবাইকের বিক্রি কমেছে প্রায় ১৮.৭১%। সংখ্যার বিচারে গত অর্থবর্ষের (২০১৮-‘১৯) জুলাই মাসের তুলনায় বিক্রি কমেছে ২২.৪৫ লক্ষ ইউনিট। ২০১৮-’১৯-এ (এপ্রিল-জুন) প্রথম পর্বে গাড়ি শিল্পে বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ১৮% এবছর সেই সংখ্যা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবধরনের গাড়িই বিক্রি কমেছে বিগত তিনমাসে। যাত্রীবাহী গাড়ির বিক্রি কমেছে ২০%, মোটরবাইক বিক্রি কমেছে ১৬% এবং সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি কমেছে প্রায় ৫১.৫৫%। বিগত ১৯ বছরে এত বেশি সংখ্যায় গাড়ি বিক্রি কমেনি ভারতে। সর্বভারতীয় গাড়ি উৎপাদক সংস্থাগুলির সংগঠন ‘সিয়াম’-এর রিপোর্টেও এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগপ্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনোরকম দিশা তারা দেখাতে কার্যত অপারগ।
ছাঁটাই-এর খাঁড়া মূলত ঝুলছে গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির কর্মীদের উপর। গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সংগঠন ‘একমা’ (অটোমোটিভ কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া)-এর তরফে বিন্নি মেহতা একে গাড়ি শিল্পের ‘মন্দার দশা’ বললেও বিষয়টা নিয়ে তারাও যে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তা তাদের অবস্থান থেকেই স্পষ্ট। ‘একমা’ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য গাড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রাংশে সার্বিকভাবে ১৮% জিএসটি করার দাবি করেছে। ‘একমা’-এর দাবি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু গাড়ির যন্ত্রাংশের উপর রয়েছে ২৮%-এর বেশী জিএসটি। আবার তার উপর রয়েছে বাড়তি ‘সেস’। যে কারণে গাড়ির দাম জিএসটির ফলে আগের তুলনায় শতাংশের হিসেবে বেড়েছে এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে বিক্রি।
‘একমা’-এর তথ্যানুযায়ী কাজ হারানোর ভয়ে উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমিক। ‘অচ্ছে দিন’-এর মূল্য চোকাতে কী চাকরিটাই খোয়াতে চলেছেন তারা। গাড়ি শিল্পের চাকা ঘোরাতে কেন্দ্রের বিজেপি-সরকারের কাছে এবছর বাজেটের আগেই আর্জি জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি। কিন্তু পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হয়েছে। অটোমোবাইল ক্ষেত্রটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। সমস্ত গাড়ি-শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা এই মুহুর্তে সাড়ে তিন কোটিরও বেশী। ‘ওইপি’ বা ‘ওরিজিনাল ইক্যুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার’-এর তথ্য বলছে ইতিমধ্যেই ১৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন মে-জুন মাসে। সক্রিয় পুঁজির অভাবে দেশের প্রায় ৩০০ জন গাড়ির ডিলার শোরুম বন্ধ করে দিয়েছেন, অর্থাৎ পরোক্ষে ইতিমধ্যেই আরো কয়েকহাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
এবছর এপ্রিল-জুন মাসে দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গাড়ি উৎপাদক সংস্থা মারুতি-সুজুকির বিক্রি কমেছে ৩৫%, টাটা মোটর্সের বিক্রি কমেছে ৪৬%, হোন্ডার বিক্রি কমেছে ৪৮%, টয়োটা এবং হুণ্ডাই এর বিক্রি কমেছে যথাক্রমে ২৩% ও ১০%। গত ২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষের শেষদিক থেকে গাড়ি বিক্রির হার কমার ইঙ্গিত ছিল। শহর, আধা শহর থেকে গ্রাম সব অঞ্চলে থেকেই ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে বিক্রি কমার ইঙ্গিত পাচ্ছিল গাড়ি উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি। উল্লেখযোগ্যভাবে পড়ছিল বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি। বিগত বছরগুলিতে গাড়ি বিক্রিতে ব্যাঙ্ক বহির্ভূত ফিনান্স কোম্পানিগুলির দৌলতে শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে শহরতলী ও গ্রামাঞ্চলে বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি যেভাবে বেড়েছিল এবছর তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এছাড়াও গাড়ি-বিমাতে সুদের হার বৃদ্ধি এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যিক গাড়িতে লাভ কমছিল দিনের পর দিন। আর সেজন্যই বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রির পতন সবথেকে বেশী। গাড়ি বিক্রির সেরা সময় উৎসবের মরসুম এসে গেলেও আশঙ্কার মেঘ কিছুতেই কাটার ইঙ্গিত এখনো মেলেনি।
গাড়ি শিল্পের সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞ আবার গাড়ি বিক্রি কমার পিছনে কিছু অন্য কারণ দেখছেন, ক্রমাগত জীবাশ্ম-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে অনেক গ্রাহকই নতুন ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন বলে এই সমস্ত বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আবার অন্যদিকে বিজেপি সরকার পরিবেশ দূষণ কমানোর অজুহাতে এবং ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি বাড়াতে বিএস-৪ গাড়ি বিক্রির সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ২০২০-এর এপ্রিলের মধ্যে। যার জেরে মারুতি-সুজুকি ১৭০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত গুরগাওতে তাঁদের ডিজেল গাড়ি তৈরির কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। জীবাশ্ম-জ্বালানী চালিত গাড়ি কেনায় গ্রাহকদের অনীহা এইকারণেই, এমনই অনুমান করছেন অনেকে। কিন্তু, আমাদের দেশে যেখানে দেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা পুড়িয়ে সেখানে পরিবেশ-রক্ষার এই বুলি যে সরকারের পরিকল্পিত ভাঁওতা তা বলাই বাহুল্য।
আসলে গাড়ি-শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই ও গাড়ি বিক্রির মন্দার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে গত পাঁচ বছরের বিজেপি সরকারের নয়া-উদারবাদী নীতি ও সীমাহিন কর্পোরেট-প্রেম। গাড়িশিল্পের এই হাঁড়ির হাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তাঁদের ওপরেও কীভাবে আঘাত হানছে কেন্দ্রের মোদী-সরকারের একের পর এক কর্পোরেট-হিতৈষী নীতি। ‘এক দেশ এক কর’ শ্লোগান দিয়ে যে জিএসটি চালু হয়েছে তাই এখন কার্যত গলায় ফাঁসের আকার নিয়েছে ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী থেকে মধ্যবিত্তের কাছে। বিলগ্নিকরন, শ্রমিক ছাঁটাই কার্যত ‘নিত্যকর্মে’ পরিণত হয়েছে। বেসরকারী ক্ষেত্রে জেট এয়ারওয়েজের পর অতি সম্প্রতি পার্লে বিস্কুট প্রস্তুতকারী সংস্থা ২৫ হাজার কর্মী ছাঁটাই করা হবে বলে জানিয়েছে। ২ কোটি কর্মসংস্থানের আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে ক্ষমতায় এসেছেন মোদি। কিন্তু বৃহৎশিল্পের এই দুরবস্থা দেখে সাধারণ মানুষের শঙ্কা ঐ ২ কোটি মানুষকে বেকার না করে ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী, ১০ লক্ষ গাড়ি শ্রমিকরা তারই প্রথম কিস্তি। কারণ নয়াউদারবাদ তো বেকারত্বেরও বিশ্বায়ন করেছে। আর বেকারত্বের প্রশ্ন ভুলিয়ে দেশবাসীকে ‘দেশপ্রেমী’ করে তোলার জন্য ‘কাশ্মীর-সিয়াচেন’ তো রয়েইছে।