নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহল, বলা বাহুল্য তথাকথিত বাম শিবিরের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ও মতাদর্শগত বিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু, সেই বিবর্তনের শ্রমজীবী শ্রেণীস্বার্থে কার্যকারিতা তো দূরস্থ, নির্বাচনেও এই বিবর্তন তথাকথিত বাম শিবিরের জন্য “আচ্ছে দিন” আনতে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অভাব নেই।
বাজার চলতি প্রায় সবকটি বামদলই প্রকাশ্য সমাবেশে ঘোষণা বা ঈঙ্গিতে জানান দিয়েছে যে রাজ্যে বিজেপির প্রবেশ রুখতে তারা মমতা ব্যানার্জী ও তৃণমূলের হাত ধরতেও প্রস্তুত।
শুধুমাত্র এ রাজ্যেই নয়, কেন্দ্রে বিজেপিকে প্রতিহত করতে সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছে এবং দিচ্ছে তথাকথিত বাম শিবির। কংগ্রেসের সাথে যে উদ্দেশ্যে তারা হাত মিলিয়ে আছে বহুদিন থেকেই, এবারে সেই খাতায় তৃণমূলসহ অন্যান্য দলগুলির নাম নথিভুক্ত করতেও তারা পিছপা নয়। অর্থাৎ, শ্রেণীসংগ্রামের লাইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৃণমূলসহ একাধিক পুঁজিবাদী, লুম্পেন, দুর্নীতিপরায়ণ, সাম্প্রদায়িক দলকে সাথী করছেন একটু বেশি সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী একটি দলকে শুধুমাত্র প্রতিহত করার জন্য।
বাংলার মানুষ বিজেপিকে চায় না, তবু ভোটব্যাঙ্কের একটা বড়ো অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে যাওয়ার কারণ তৃণমূলের প্রতি ক্ষোভ, অবিশ্বাস এবং প্রতিস্পৃহা; এবং সেক্ষেত্রে তৃণমূলের কোনো বিকল্প না থাকা। এমতাবস্থায় তৃণমূলকে সাথী করলে বাংলায় বিজেপি-র অবশ্যম্ভাবী প্রবেশ ঘটবেই, এবং বাংলায় তাদের রাজনীতি, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী করবে। আর, যে তৃণমূলকে সাথী করে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতার কথা বলছেন নামাঙ্কিত কমিউনিষ্ট দলগুলির নেতারা, তার সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস কতটা রঙিন তা তারা ভুলে গেলেও সাধারণ মানুষ ভুলে যায়নি। ২০১০-এর দেগঙ্গা, ২০১৩-এর ক্যানিং, ২০১৬-এর কালিয়াচক, খয়রাশোল, ধুলাগড়, ২০১৭-এর বাদুরিয়ার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং তার প্রত্যেকটিতে একাধিক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতাদের অবদান সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে এখনো দগদগে। তাই ভুয়ো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জিগির তুলে বিজেপি-র সাথে সাথে তৃণমূলও বাংলায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে আগাগোড়াই, যারই প্রমাণস্বরূপ পেশ হতে চলেছে বিজেপি-র “রথযাত্রা”-র বিরুদ্ধে তৃণমূলের “পবিত্র যাত্রা”।
তাই তৃণমূলকে সাথী করে রাজ্য বা কেন্দ্রে বিজেপি-কে আটকানোর সম্ভাবনা ০%। পশ্চিমবঙ্গের এই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে বিজেপি-কে রোখা একমাত্র সম্ভব, যদি রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে আসা যায় এবং বিশেষ করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামের পথে হেঁটে আন্দোলন সংগঠিত করা যায়। তা না হলে, তৃণমূলের প্রতি জনমানসের ক্ষোভের প্রকাশরূপেই বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক স্থূল হবে এবং তাকে রুখতে হলে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই লড়াই সংগঠিত করতে হবে। কারণ, বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার দুই পিঠ এবং মুদ্রার এক পিঠকে সাথী করে অপর পিঠের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। তাই, উভয়ের বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে পুঁজিবাদের পেষণে এবং সাম্প্রদায়িক বাতাসায় অচিরেই বাংলায় এক চরমতম বিপর্যয় নেমে আসবে।
