হারাধনের ১২ টি ছেলে, রইলো বাকি …।
শূন্যস্থানে কখন যে কোন সংখ্যা এসে পরবে, সে কথা গ্যারেন্টি করে বোধ হয় হারাধনবাবুও বলতে পারবেন না।
গত ২৬ শে নভেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন IDBI ব্যাঙ্কে সরকারী স্টেক কমানোর পাশাপাশি আরও দুটি পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্ক এবং একটি নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানির বেসরকারীকরণের ভবিষ্যদ্বানী করেন। কিন্তু সেই শুভ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কতকগুলি আইনবিধি, আর তাই চলতি মরশুমের শীতকালীন অধিবেশনেই সেই সমস্ত আইন সংশোধন করতে মরিয়া কেন্দ্র সরকার। একদিকে ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ একুইজিশন এন্ড ট্রান্সফার অফ আন্ডারটেকিংস এক্ট, ১৯৭০ ও ১৯৮০, আর একদিকে ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন এক্ট, ১৯৪৯– বেসরকারীকরণের এই দুই শিখণ্ডী পেরোতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় তৈরি হচ্ছে ব্যাঙ্কিং লজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২১ যা এই শীতকালীন অধিবেশনেই প্রস্তাব করা হবে। নয়া এই বিলের প্রতিবাদে গত ১৬ এবং ১৭-ই ডিসেম্বর দুদিনের ধর্মঘট পালন করেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী ও অফিসারদের ৯ টি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ইউএফবিইউ। প্রায় ৯ লক্ষ ব্যাঙ্ক অফিসার ও কর্মচারী এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন।
ব্যাঙ্কিং লজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২১ -এই আইনবলে সরকারকে আর আগের মতো পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্কের ৫০ শতাংশ বা তার বেশি স্টেকের অংশীদার হতে হবে না, এবং একই সঙ্গে সরকারি স্টেক বিক্রি করা হয়ে উঠবে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট। নীতি আয়োগের তরফে বলা হয়, ” আসন্ন বিলটি দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের (পাব্লিক সেক্টর ব্যাংক) বেসরকারীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রক অনুমোদনের রাস্তা পরিষ্কার করবে, তবে আমরা কিছু অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি লঘু করতে চাই”। এমনকি নীতি আয়োগের তরফ থেকে ‘সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘ইন্ডিয়ান ওভারসীজ ব্যাঙ্ক’-কে বেসরকারিকরণের জন্যে চিহ্নিতও করা হয়েছে। এই দুটি ব্যাংকেরই সরকারি স্টেকের পরিমাণ ৫১% থেকে কমিয়ে ২৬% এর কাছাকাছি নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে অর্থমন্ত্রক। এছাড়া, আইডিবিআই ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের কথাও উঠে এসেছে নীতি আয়োগ এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্য থেকে। যদিও আইডিবিআই এর কত শতাংশ অংশীদারীত্ব সরকার রাখবে, তা আলোচনাসাপেক্ষ বলে জানিয়েছে সংস্থা। ধর্মঘটী ব্যাঙ্ককর্মীদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে এই বিলের ফলে সরকার কার্যত ব্যাঙ্কগুলিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইছে, সরকার ব্যাঙ্কগুলিতে নিজস্ব অংশীদারীত্ব প্রায় ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, যার ফলে গ্রাহকদের আমানত থেকে ব্যাঙ্ক কর্মী সংকটে পরবেন সকলেই।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তরফে ২০২১-২০২২ অর্থবর্ষে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার ব্যায়সংকোচের টার্গে্ট নেওয়া হয়েছে। নয়া ব্যাঙ্ক আইন কার্যকর হলে মাত্র দুটি ব্যাঙ্ক নয়, একের পর এক ব্যাঙ্ক থেকে সরকার তার অংশীদারীত্ব কমিয়ে সম্পূর্ন ব্যাঙ্কিং সেক্টরকেই বেসরকারি করার দ্রুত আয়োজন করবে সরকার। আর তার ফলেই স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাঙ্কগুলির কোনোরকম সিদ্ধান্তগ্রহণে সরকার আর কোনো হস্তক্ষেপই করবে না।
২০১৬ সাল থেকেই কার্যত ধুঁকছে ব্যাঙ্কিং সহ গোটা ফিনান্স সেক্টর। নোটবন্দীর আড়ালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘মার্কেট স্টেবিলাইজেশন স্কিম’ চালানো হয় শুরুতে, এরপর ঝুলি থেকে বের হতে থাকে একের পর এক ‘বেড়াল’— জিএসটি, নতুন এফআরডিআই বিল, ব্যাঙ্ক মার্জার। ২০১৯-এ দ্বিতীয়বার মসনদে আসার পর থেকে ইতিমধ্যে ১০টি পাব্লিক সেক্টর ব্যাংক মার্জারে চলে গিয়েছে। কিন্তু, কোনকিছুতেই বিশেষ সুরাহা হয়নি। বরং বিশ্ববাজারের অবাধ লুঠ সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে। লকডাউনের বাজারে যে ৩৫% সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে এদেশের বিলিয়নিয়ারদের, তার সিংহভাগ আসলে ফিনান্স সেক্টরে ক্রেডিটের অংক বাড়িয়েছে। তার ওপর লকডাউন থেকেই দেউলিয়া হয়ে চলেছে বহু সংস্থা, যার অনাদায়ী ঋণের বোঝা এসে পড়ছে ফিনান্স সেক্টরের ওপর, যেই বোঝা জণগনের ঘাড়ে পুরোপুরি চাপিয়ে দিতে এই শীতকালীন অধিবেশন আয়োজিত হচ্ছে বলা যায়।
শুধুমাত্র ব্যাঙ্কিং লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল নয়; সরকারী ব্যয় সংকোচ, পুর্ণ বেসরকারিকরণ এবং এবং সংকটের সমস্ত বোঝা জনগনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আইনানুগ বন্দোবস্তো করার জন্য সর্বমোট ২৬ টি বিল সংশোধনীর প্রস্তাব উঠতে চলেছে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে। যার মধ্যে অন্যতম আর একটি হল এফআরডিআই (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২১; যা ৫৪-সি ধারায় নতুন সংযোজন হিসেবে নিয়ে আসছে ‘বেল ইন’। অর্থাৎ, এতদিন যেভাবে কোনো ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে বা তেমন পরিস্থিতি হলে সরকার ‘বেল আউট’ ঘোষণা করে সরকারি অনুদানের মাধ্যমে ব্যাঙ্ককে সংকট থেকে বাঁচাতো। এবার আর তেমনটা হবে না। এখন থেকে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে আর সরকারি টাকায় নয়, ব্যাঙ্ক সরাসরি তার গ্রাহকদের গচ্ছিত টাকা নিয়ে নিজের সংকট মেটাবে, আর সেক্ষেত্রে সেই টাকার মাত্র ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গ্রাহকদেরকে ফেরত দেবে। সুতরাং, ব্যাঙ্ক সংকটে পড়লে তার দায় গ্রাহকদেরই নিতে হবে। অঙ্কটা খুব সরল, তাবৎ হানাদারী কার্পোরেট দস্যুরা ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ কোটি তাকার পাহাড়প্রমাণ অনাদায়ী ঋণ নিয়ে চম্পট দেবেন আর ব্যাঙ্কের সেই দেনা জনগণ নিজের জমানো টাকা দিয়ে শোধ দেবেন। যদিও এর আগেও জনগণের টাকাতেই মিটতো এই লোকসান— জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, সরকারি কোষাগার থেকে। কিন্তু, এখন জিএসটি আসার একই প্রোডাক্টের প্রত্যেক হাতবদল বাবদ ট্যাক্স নিলেও সেই ট্যাক্সের টাকাতেও মিটবে না সংকট, মিটবে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনগণের টাকা থেকেই। আর কোষাগার সংক্রান্ত বেশি প্রশ্ন করলে কেন্দ্র সরকারের মুখে মিলবে একটাই উত্তর, “কাগজ আমরা দেখাবো না”।
ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে খনি রাষ্ট্রায়াত্ত্বকরণ করাকে কংগ্রেস ভারতে সরকারী উদ্যোগে অর্থনৈতিক বিকাশে তাদের ভূমিকাকে তুলে ধরতে সচেষ্ট এবং একইসাথে বেসরকারীকরনের এই জয়রথ বিজেপির দায় হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু বাস্তব হল এই যে ব্যাঙ্ক থেকে খনি যখনই এইসমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব করা হয় তখন এখানে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে ছিল না। আর তাই আজ যখন ভারতে পুঁজির বিকাশ কার্যত মগডালে পৌঁছেছে তখন সর্বত্র চলছে অবাধ বিলগ্নীকরণ, যার সূত্রপাত হয়েছিল কংগ্রেসের নরসীমা রাও সরকারের সময় থেকেই। একদিকে পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্ক থেকে সম্পুর্ণ দায়দায়িত্ব তুলে নেওয়ার আর অন্যদিকে সম্পূর্ণ সংকটকে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে খোলা বাজারে লুঠের আইন প্রণয়নের গণতান্ত্রিক উৎসব এবছরের শীতকালীন অধিবেশন। এখন, দেখার বিষয় এটাই যে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিরোধী আসনে বসে থাকা নেতারা ঠিক কতটা বিরোধিতা করেন, নাকি বরাবরের মতো ‘বিরোধিতার সহযোগিতায়’…