প্রশান্ত মহাসাগরের পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত বোগেনভিল দ্বীপটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে পাপুয়া নিউগিনি এবং বোগেনভিল একই শাসন ব্যবস্থার অধীনে ছিল। পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত এই দ্বীপটির নাম বোগেনভিল হয় এক ফরাসি অনুসন্ধানকারীর নাম অনুসারে। পরবর্তীকালে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং জার্মানি ক্রমান্বয়ে এই দ্বীপটিকে তাদের উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করে এবং এই বোগেনভিল দ্বীপটি পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপপুঞ্জের অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশের পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে পাপুয়া নিউগিনি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বোগেনভিল দ্বীপটি পাপুয়া নিউগিনির নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। যদিও পাপুয়া নিউগিনি পুরোপুরিভাবে স্বাধীন হতে পারেনি; অর্থনৈতিকভাবে সে অস্ট্রেলিয়ার উপর নির্ভরশীল। বোগেনভিল দ্বীপের প্যাঙ্গুনা অঞ্চলটি তামা সহ অন্যান্য ধাতুর খনিজে সমৃদ্ধ। প্যাঙ্গুনা অঞ্চলের এই খনিজ খননের দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বোগেনভিল কপার লিমিটেডের অধীনে ছিল। বোগেনভিল কপার লিমিটেডের নিয়ন্ত্রনহীন খননের ফলে ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্যাঙ্গুনা অঞ্চলের অধিবাসীদের বসতি থেকে উৎখাত করা হয় এবং এই খনন সম্পর্কিত কাজে তাদের নিয়োগ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা অমান্য করা হয়। গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি খনি ভিত্তিক হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষরা একরকম অনাহারে দিন কাটাতে শুরু করে। লাগামহীন খননের ফলে প্যাঙ্গুনা অঞ্চলের বন-জঙ্গল নষ্ট হয়, বাতাস ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী ফ্লাই, আঙ্গাবাঙ্গা ও জাবা নামক তিনটি নদীর জল ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়ে যার ফলে মৎস্যজীবীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। বোগেনভিল অঞ্চলের এই চরম অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েনের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে বোগেনভিল রেভোলিউশনারি আর্মি এবং পাপুয়া নিউগিনি ডিফেন্স ফোর্সের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়। পাপুয়া নিউগিনি বোগেনভিল রিভলিউশনারি আর্মি-কে দমন করার জন্য স্যান্ডলাইন ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি সংস্থা থেকে ভাড়া করা সৈন্য নামাতে শুরু করে যার ফলে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আরও বীভৎস হতে শুরু করে। একবিংশ শতকের শুরুতেই বোগেনভিল স্বায়ত্তশাসন লাভ করে কিন্তু তার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পাপুয়া নিউগিনির কাছেই থাকে। এরপর বোগেনভিলের মধ্যে গণভোটের মাধ্যমে বোগেনভিলের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে। এই ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী দশক পার হয়ে ২০১৯-এ এসে থামে যখন দেখা যায় বোগেনভিলের অধিকাংশ অধিবাসী গণভোটে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানাচ্ছে যার ফলস্বরূপ বোগেনভিল এই মুহূর্তে পৃথিবীর নবীনতম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই স্বাধীনতার ফলে বোগেনভিল কপার লিমিটেড যা রায়ো টিনটো নামক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই কোম্পানি তার শেয়ারের ৫৬% বোগেনভিল সরকারের কাছে বিক্রি করে দেয় এবং এই কোম্পানির খননের ফলে পূর্বে যে ব্যাপক পরিমাণে পরিবেশের ক্ষতি হয় তার দায় নিতে অস্বীকার করে। এই অবস্থায় অস্ট্রেলিয়া পাপুয়া নিউগিনিকে এমন কিছু নতুন আইন তৈরীর জন্য উস্কানি দিতে থাকে যার মাধ্যমে পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার মাফিয়া চক্র বোগেনভিলের খনিজ অঞ্চলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। একবিংশ শতকের শুরু থেকে প্যাঙ্গুনার খনিজ অঞ্চলের বন্ধ খনন পুনরায় চালু করার এক গভীর ষড়যন্ত্র দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে এই অঞ্চলের খননের মাধ্যমে আয় করা টাকা দিয়ে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি নেওয়া হবে। অস্ট্রেলিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্যাঙ্গুনার খনিজ অঞ্চলের খনিজ উত্তোলন হওয়ার সাথে সাথে বোগেনভিল অঞ্চলের গণভোটের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতা পুনরায় প্রশ্নের মুখে চলে আসছে। এখন একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে যে দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রাম এবং গণভোটের মাধ্যমে পাওয়া বোগেনভিলের স্বাধীনতা কি পুনরায় আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে বসেছে???



