এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন! ১৯৭২- ১৯৭৩-এ খনি জাতীয়করণের থেকে আজ ২০১৯; ভারতের কয়লা শিল্পের ইতিহাসে যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। গতকাল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল ঘোষণা করেন, “ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারতের কয়লা শিল্পে ১০০% এফ ডি আই বা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে”। পীযূষ গয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “ ইতিপূর্বে কেবলমাত্র ‘ক্যাপটিভ কনসাম্পশনের’ ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ বলবৎ ছিল। এবার থেকে কয়লা খনি, কয়লা প্রক্রিয়াকরণ থেকে অন্যান্য পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিক্রি সবক্ষেত্রেই ১০০% প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হলো।” এর পাশাপাশি একই সঙ্গে পীযূষ গয়াল আরও জানান প্রিন্ট মিডিয়ায় এতদিন ২৬% প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ করা যেত, এবার থেকে ডিজিটাল মিডিয়াতেও একই পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দিল কেন্দ্র সরকার।
ঘোষণা হবার পর থেকেই কয়লায় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেবার বিজেপি সরকারের সিদ্ধান্ত শিল্পমহলে কার্যত ঝড় তুলে দিয়েছে । কারণ এর ফলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কয়লার রিজার্ভে সরাসরি কয়লা উত্তোলন এবং তা প্রক্রিয়াকরনের ছাড়পত্র পেতে চলেছে বিশ্বব্যাপী একাধিক কর্পোরেটি খনি-জায়ান্ট, যাদের মধ্যে এই মুহুর্তে ভারতে কয়লা-শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে বিএইচপি বিলিটন, রিও টিন্টো গ্লেনকোর।
গত বছর ফেব্রুয়ারীতেই অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন একটি অর্ডিনান্স জারি করেন, ঐ অর্ডিনান্সে কয়লা ব্লকগুলিকে পুনর্বন্টন করার কথা বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কংগ্রেসের আমলে কয়লা-ব্লক বন্টনের দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির খননকার্যের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। কিন্তু বিজেপি সরকার সেই সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি অর্ডিন্যান্স জারি করে কয়লাখনিগুলিকে কর্পোরেটদের মধ্যে পুনর্বন্টন করেন। উদ্দেশ্য সত্ত্বর কয়লার উত্তোলন চালু করা। ‘বেদান্ত’ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত হলো গেমচেঞ্জার, এর ফলে দেশের শক্তিসম্পদের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে।” একইসঙ্গে তিনি দাবি করেছেন এর ফলে বৃহদায়ন ওপেন কাস্ট কয়লাখনি তৈরি হবে যাতে বিপুল কর্মসংস্থান হবে।
বর্তমানে ভারতে আনুমানিক সঞ্চিত কয়লা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন টন। ২০১৮-২০১৯ আর্থিক বর্ষে দেশের মোট উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ ছিল ৭৩০ মিলিয়ন টন। যার মধ্যে ৬০৭ মিলিয়ন টন কোল ইণ্ডিয়ার উত্তোলন, ৬৪ মিলিয়ন টন সিঙ্গারেনী কোলিয়ারীগুলির এবং বাকিটা ক্যাপ্টিভ কয়লা উত্তোলনকারীদের। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কয়লা ও খনি মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে বার্ষিক কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ করতে হবে ১৫০০ মিলিয়ন টন যা গত আর্থিক বছরে উত্তোলিত কয়লার প্রায় দ্বিগুন। এমনকি আভ্যন্তরীন জ্বালানী চাহিদার জন্য কয়লার উত্তোলনের পরিমাণও গত দু’বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন টন।
উনবিংশ শতাব্দী থেকে আজ অবধি কয়লাই হলো ভারতের প্রধানতম জ্বালানী সম্পদ। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, যুদ্ধ-পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক সংকটের সময়েই কেবল কয়লা উত্তোলনের গড় অবস্থা থেকে হেরফের ঘটেছে। বিশ শতকের শুরুতে এদেশে বছরে প্রায় ৬০ লক্ষ টন কয়লা উৎপাদিত হত। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেটা লাফিয়ে উঠে চলে গেল ১৮০ লক্ষ টনে। অর্থাৎ ৩০০ % বেড়ে গেল। আবার ১৯৩০-এর মহামন্দার সময়ে কিন্তু কয়লার উৎপাদন ২০% নীচে নেমে এলো। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৩০০ লক্ষ টন কয়লা উৎপাদন শুরু হয়েছিল।
ভারতের ৭২% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় কয়লা থেকে। কয়লা শিল্পের সার্বিক বেসরকারীকরণ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের ফলে কয়লার দাম ওঠানামা করতে থাকবে এবং বিদ্যুতের দামের হেরফের ঘটবে বেশী। এর ফল ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই কারণ তথ্যপ্রযুক্তির মত অনেক বৃহদায়ন শিল্পক্ষেত্রের বিদ্যুত-ই করমুক্ত। উপরন্তু কয়লার অতি-উত্তোলন বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার যোগান আরো বড় সমস্যা। কারণ কয়লার মত প্রাথমিক শক্তি সম্পদের মালিকানা যখন একচ্ছত্রভাবে বেসরকারী মালিকানার হাতে চলে যায় তখন বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণও এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৭-এর পরবর্তীতে ভারত যখন অতিরিক্ত ১ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নিয়েছে (যার বেশীরভাগটাই তাপবিদ্যুৎ) তখন তার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন টন কয়লা। আর বর্তমানে ভারতের কয়লা উৎপাদন মোটামুটি ৫৮৫ মিলিয়ন টন (২০১১-এর বিশ্ব কয়লা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী)। অর্থাৎ কয়লাখনিগুলির উত্তোলন বৃদ্ধির পরিমাণ হতে হবে দ্বিগুনের কাছাকাছি। অর্থাৎ ভারতে লোকসভা নির্বাচনোত্তোর ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকট থেকে কোনোভাবে পরিত্রাণের জন্যই কয়লার উত্তোলনের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি লিগনাইট কয়লার যে ভাণ্ডার ভারতে গচ্ছিত আছে তার দিকেও আক্রমণ আসতে চলেছে এবার। বর্তমান উত্তোলনের পরিমাণের থেকে দ্বিগুণ লক্ষমাত্রা স্থির করা তারই নিদর্শন মাত্র।

কয়লা শিল্পে ১০০% প্রত্যক্ষ বেসরকারী বিনিয়োগকে সুযোগ করে দিয়ে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা কেন্দ্র সরকার নিয়েছে তা পরিবেশের প্রতিও আনবে এক গুরুতর কশাঘাত। যেখানে বিশ্বে প্রায় ৪০% নিঃসৃত গ্রীন হাউজ গ্যাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উৎস কয়লা, সেখানে কয়লার উত্তোলন বৃদ্ধি যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পরিপন্থী হবে তা বলাই বাহুল্য। প্রতিটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমানোর যে কথা বলা হচ্ছে তা যে কেবল ‘কাগুজে বাঘ’ হয়েই রয়ে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।
অথচ, ভারতের ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে ‘পরিবেশবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত সৌরশক্তি উৎপাদনের খরচ বিগত বছরগুলির তুলনায় ২৫% কমেছে। ‘সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’-এর ২০১৭-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভাদলা সৌরবিদ্যুৎ পার্কে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ২.৪৪ টাকা প্রতি কিলোওয়াট/ ঘণ্টায় খরচা হয়েছে অন্যদিকে ঐ একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ভারতের সর্ববৃহৎ তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা ‘ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন’-এর খরচ হয়েছে ৩.৪৪ টাকা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্র সরকারের অতি আগ্রহ কেন? আর দিনের পর দিন পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রযুক্তিগত খরচ কমলেও তাকে কলেবরে বাড়ানোর চেষ্টার পেছনে অনীহার কারণ কী? আসল কারণ নিমজ্জিত আছে বিশ্বের তাবড় কর্পোরেটদের স্বার্থে; যারা ইতিমধ্যে কয়লাশিল্প এবং তাপবিদ্যুত উৎপাদনে বিপুল বিনিয়োগ করে বসে আছে এবং উপর্যুপরি বিনিয়োগ করে চলেছে (যেমন-ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানিরা)।
বেসরকারী খনিগুলিতে অবৈজ্ঞানিকভাবে কয়লা উত্তোলনের ফলে দেশের কয়লাখনি অঞ্চলগুলির নিত্যদিনের সঙ্গী ধ্বস-গ্যাস-আগুন। বিষাক্ত ধোয়া-ধুলোর কারণে কয়লাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে সিলিকোসিসের মত মারণব্যাধি। সার্বিকভাবে দেশী ও বিদেশী উভয় পুঁজি বিনিয়োগের পথ খুলে যাওয়ায় অবৈজ্ঞানিকভাবে লাগামছাড়া কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং ধ্বসের আশঙ্কা চতুর্গুণ বাড়বে।
প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের সুফল হিসেবে কর্মসংস্থানকে কর্পোরেটরা পুঁজি করেছেন। কিন্তু ৯০-এর দশকের শেষদিক থেকে কয়লা ব্লকগুলির বেসরকারীকরণের ফলে আদানী, আরপি গোয়াঙ্কা, টাটা, জেএসপিএল-এর মতো ভারতীয় খনি-কর্পোরেট সংস্থাগুলি কয়লা শিল্পে অবাধ প্রবেশের সুযোগ পায়। এদের কর্তৃক পরিচালিত বৃহদায়তন ওপেন কাস্ট মাইন-গুলিতে কর্মসংস্থানের বেহাল দশা কয়েকবছরের মধ্যেই চোখে পরতে থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কয়লা ব্লকের বরাত পাওয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলি কয়লা উত্তোলন নিজেরা করে না, উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন সাব-কন্ট্রাকটর নিয়োগ করে। যেমন- রেইজিং সাব-কন্ট্রাকটর, ট্রান্সপোর্ট সাব-কন্ট্রাকটর ইত্যাদি। তার ফলে কয়লা খনির জন্য জমিহারা মানুষদের যে চাকরি দেবার কথা বরাত পাওয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলির থাকে, তার দায় থেকে সহজেই তারা হাত ধুয়ে ফেলে। কারণ তখন জমিহারারা চাকরি পায় সাব-কন্ট্রাকটরের অধীন। বরাত পাওয়া কোম্পানির দেওয়া চাকরির মাইনে আর সাব-কন্ট্রাকটরের অধীনের চাকরির আশমান-জমিন ফারাক আছে। কারণ কোল-ইণ্ডিয়ার নির্ধারিত কয়লা শ্রমিকদের বেতনক্রম আর সাব-কন্ট্রাকটরের আওতায় থাকা শ্রমিকদের বেতনের তফাত ন্যুনতম ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। আর এবার ১০০% বিদেশী বিনিয়োগের ফলে কয়লা-শিল্পে কর্মসংস্থানের হার তলানিতে এসে ঠেকবে, কারণ বিএইচপি বিলিটন, রিও টিন্টো গ্লেনকোর-এর মতো কয়লাখনি জায়ান্টগুলির প্রযুক্তি, যাতে কর্মসংস্থান হয় কার্যত নামমাত্র।
পুরোপুরিভাবে মেশিলচালিত কয়লার উত্তোলন কয়লার সঙ্গে যুক্ত মানুষের কর্মসংস্থানকে আরো সঙ্কুচিত করবে। তার ফলে অবধারিতভাবে কয়লার চোরাচালান এবং অবৈধ খনির রমরমা এবং তাকে ঘিরে ভারতের কয়লাঞ্চলগুলিতে মাফিয়ারাজকে ঘুরপথে আরো তোল্লাই দিতে চলেছে কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত। ক্ষুদ্রক্ষুদ্র ব্যক্তিমালিকদের হাত থেকে কয়লাখনি নিয়ে ১৯৭৩-এ খনি জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে টাটা আয়রণ এন্ড স্টিলের মতো কয়েকটি কোম্পানির কোকিং কয়লাখনিগুলি জাতীয়করনের তালিকা থেকে বাদ পড়ে। আসলে সরকারেের হাতে খনিগুলিকে এনে যাতে ১০০%-ই দেশী ও বিদেশী কর্পোরেটি পুঁজি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা যায় তাই ছিল জাতীয়করণের ছদ্ম-লক্ষ্য। ২০১৯-এ এসে সেই বৃত্তটাই সম্পূর্ণ করল বিজেপি-সরকার।



