আমৃত্যু তিনি সমাজতন্ত্রের হয়ে একহাত নিয়ে গেছেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের। রাজনৈতিক গুরু হিসেবে মনে করতেন ফিদেল কাস্ত্রোকে। লাতিনভূমের দুই বিপ্লবী বন্ধু চে আর ফিদেলের প্রতি তিনি ছিলেন নতমস্তক। ভেনিজুয়েলায় কমরেড সাভেজের মৃত্যুর পর ক্যারাকাসের রাস্তায় পতাকা হাতে দেখা যায় ১০ নম্বর জার্সি ধারি ৫’৫’’ বিশ্ব জয় করা মানুষ টাকে। এই নির্ভীক মানুষটি যদি ফুটবল না খেলতেন তাহলে হয়ত হতেন লাল পতাকা হাতে বিপ্লবী। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মত একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে চলতেন শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। গতকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
আর্জেন্তিনার দক্ষি্ণে ভিসা ফিওরিতায় মারাদোনায় বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলায় দেখেছেন নিদারুণ দারিদ্র। অর্থকষ্টে সেজন্য প্রথাগত লেখাপড়াও হয়নি, ফুটবলকেই বানিয়েছিলেন নিজের ধ্যান জ্ঞান। কিন্তু যার জন্মই হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হবার জন্য তাকে আটকে রাখে কার সাধ্য। নজরে পরে গেলেন আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের কোচ কর্নেখোর। সেখান থেকে ১১ বছর বয়সে আর্জেন্তিনার প্রতিভার খনি হিসেবে পরিচিত বোকা জুনিয়র্সের ছোটদের দলে। সেই শুরু, এরপর মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে পদার্পণ । ১৯৭৭-এ দেশের হয়ে অনূর্ধ-২০ বিশ্বকাপ জয় করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে ৯১ টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেন।
জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসাবে ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপ জয় করেন। মেক্সিকো সিটির এই বিশ্বকাপ আর দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা হয়তো সমার্থক হয়ে থাকবে যতদিন ফুটবল খেলাটা পৃথিবীতে থাকবে। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা এও বলে থাকেন যে, আর কোনো ফুটবল বিশ্বকাপকে একজন ব্যক্তি এমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেননি। বিংশ শতাব্দীর সেরা গোলটাও এসেছিল তার পা থেকে। ১৯৮৬ সালের ১২ই জুন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব দুটো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিলো প্রথমটি ফুটবল ইতিহাসে চির বিতর্কিত ইংরেজ গোলকিপার পিটার শিল্টনের সাথে ওয়ান-টু-ওয়ানে “দ্য হ্যান্ড অফ গড”গোল , আর দ্বিতীয়টি ৬০ মিটার বল নিয়ে ছুটে ৫ ডিফেন্ডারকে ডজ করে বল জালে জড়ানো বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল। পরেরদিন ফ্রান্সের পত্রিকা লিকুইপে তাঁকে “অর্ধেক দেবদূত অর্ধেক দানব” বলে সম্বোধন করে। ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে কাপ অধরা রইলেও আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবনে তিনি চার বার বর্ষসেরা ফুটবলার এবং ২০০০ সালে তিনি ফিফার শতাব্দীর সেরা ফুটবলার মনোনিত হন।যদিও ফিফা পেলেকেও এই সম্মান দেয়। ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপ বিশ্বের ফুটবল প্রেমিদের কাছে নিয়ে আসে সেই অন্ধকার সময়, ডোপিং টেস্টে নির্বাসিত হন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে। নীল সাদা জার্সি গায়ে মাঠে আর দেখা যায়নি ফুটবলের রাজপুত্রকে।
ক্লাব ফুটবলে ৫৮৮ ম্যাচে ৩১২ টি গোল করেছেন খেলেছেন আরজেন্তেনিওস জুনিওরস, বোকা জুনিওরস, বার্সেলোনা, নাপোলি,সেভিয়া, নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজ এর হয়ে। বার্সেলোনার হয়ে একবার স্প্যানিশ কাপ এবং একবার স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতেন। নাপোলির হয়ে প্রায় স্বীয় দক্ষতায় একবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতেন, এবং দুবার ইতালি সেরা হন। বোকা জুনিয়র্সের হয়ে একবার আর্জেন্টিনা সেরা হন। ১৯৯৮ সালে সমস্ত রকম ফুটবল থেকে অবসর নেন। অবসরের পর দীর্ঘদিন বিভিন্ন ক্লাব আর জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টেক্সটিল ম্যানডিউ, রেসিং ক্লাব, আল ওয়াসি, ফুজাইরা,ডোরাডস, গিম্নাসিয়া ডে লা-প্লাটা ক্লাবের হয়ে মোট ১৪০ টি ম্যাচে এ ম্যানেজারের ভুমিকা পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচ হিসাবে নিযুক্ত হন। ২০১০-এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে তার সময়ে আর্জেন্তিনার সাফল্য ফুটবলার মারাদোনার মত হয় নি।
অসম্ভব প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও সারা জীবন তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে বিতর্ক। ব্যাক্তিগত জীবনে কিছু খারাপ অভ্যাস শেষ করেছে খেলোয়াড় মারাদোনাকে। ১৯৮০ থেকে ২০০৪ তিনি ছিলেন কোকেন আসক্ত। দীর্ঘদিন মাদক সেবনের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন, আর্জেন্টিনা সরকার তার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়। এই সময় তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আসতে সাহায্য করেন ফিদেল কাস্ত্রো। কমরেড কাস্ত্র ফুটবলের রাজপুত্রকে স্বাভাবিক জবনে ফিরে আসা কে সম্ভব করেন। মারাদোনা ফিদেলের সম্বন্ধে বলেন “তিনি আমার পিতার মত, যখন আর্জেন্টিনা আমার জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল তিনি কিউবার দরজা আমার জন্য খুলে দিয়েছিলেন”। মারাদোনা যে পা দিয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোল টি করেছিলেন সেই বা পায়ে তিনি ফিদেলের মুখ উল্কি দিয়ে আঁকিয়ে ছিলেন।
লাতিনভূমে আরেক সমাজতন্ত্রী নেতা ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজ অনুগত ছিলেন মারাদোনা। তিনি বলেন “আমি স্যাভেজকে বিশ্বাস করি, আমি স্যাভাজস্তা(হুগো স্যাভাজের অনুগামী)। আমার মতে ফিদেল যা করেছে স্যাভেজ যা করেছে সেটাই শ্রেষ্ঠ।” সম্ভবত তিনিই ছিলেন একমাত্র ঘোষিত বামপন্থী আন্তর্জাতিক ফুটবলার। হুগো স্যাভাজের মৃত্যুর পর সমাজতন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলার জন্য ভেনেজুয়েলা বাসী দের উদ্দেশে বার্তা দেন “সংগ্রাম চালিয়ে যাও”। খোলাখুলি ঘোষণা করেন তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। ২০০৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ কে “হিউম্যান গারবেজ” বলে আখ্যা দেন। তিনি আরো বলেন “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রতিটি জিনিসকে আমি সর্বশক্তি ঘেন্না করি”।
ভিসা ফিওরিতায় অভাব, দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে বড় হবার ফলে আজীবন তিনি লুটে খাওয়াদের বিরুদ্ধে ছিলেন বিদ্রোহী। ধনীদের গরীব ‘প্রীতির’ বিষয়ে তার স্বচ্ছ ধারনা ছিল তাই ১৯৮৭ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে ‘সম্পদ বৈষম্য’ বিষয়ে তার পোপ দ্বিতীয় জন পলের সাথে মৌখিক সংঘাত হয়। তিনি বলেন “আমি তার সাথে তর্ক করেছি কারণ আমি ভ্যাটিকানে ছিলাম এবং আমি এই সমস্ত সোনার সিলিং দেখেছিলাম এবং তার পরে আমি পোপকে বলতে শুনেছিলাম তিনি দরিদ্র বাচ্চাদের কল্যাণ নিয়ে উদ্বিগ্ন’। তখন মারাদোনা পোপকে বলেন- “তাহলে আপনার সিলিংটি বিক্রি করুন, কিছু করুন।”
আসলে মারাদোনা ছিলেন চির বিদ্রোহী। আর্জেন্তিনার সমরশাসক গলতিয়েরি হোক বা ফুটবল বিশ্বে প্রবল পরাক্রমশালী ফিফা। ফুটবলকে নিয়ে কারো দুর্নীতি বা ধান্দাবাজীর সাথে আপোস করেননি মারাদোনা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের জন্য আজীবন রাগ পুষে রেখেছিলেন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে, খেলেননি তাদের ক্লাবে, শেখেননি তাদের ভাষা। আসলে মারাদোনা মানেই ছক ভাঙা, মারাদোনা মানেই বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ… মারাদোনা মানেই বিপ্লবী। তার করা প্রত্যেকটা গোল ছিল শোষিত লাঞ্ছিত মানুষের হয়ে পচাগলা সমাজের বিরুদ্ধে একেকটা লাথি। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পয়সা ছড়িয়ে ফুটবলার তৈরি করা যায় না। মুখ বন্ধ রাখলে তিনি পেতে পারতেন অমোঘ ঐশ্বর্য। কিন্তু তিনি তো কেবল ফুটবলার ছিলেন না… তিনি ছিলেন শিল্পী, মাথা নোয়াবেন কেন? তৈলমর্দন করে পাবার বিরুদ্ধে তিনি যে স্বয়ং বিদ্রোহ।