গত ১১ই ডিসেম্বর থেকে সোনারপুরের চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারির (পাখিরালয়) অস্থায়ী কর্মীরা পাখীরালয়ের মূল ফটকের সামনে, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকালীন অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবী, গত জানুয়ারী মাস থেকে টানা ১১ মাসের বেতন বাকি রয়েছে তাদের। দীর্ঘদিন ধ’রে কর্তৃপক্ষকে বেতন দিতে অনুরোধ করলেও, তাঁরা ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপও করেননি; উপরন্তু, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেছেন। এই মুহুর্তে তাদের মাসিক বেতন ৮৪০০ টাকার কাছাকাছি, যা ১১ মাসে প্রায় ৯৫,০০০ টাকার কাছাকাছি দাঁড়ায়। আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, কনট্র‍্যাকচুয়াল কর্মী হওয়ার কারণে তাঁদের উপর কাজের ক্ষেত্রেও ব্যপক অত্যাচার চালিয়ে আসছে কর্তৃপক্ষ। এঁরা সকলেই সিকিউরিটি-কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হলেও, এঁদের দিয়ে সাফাইয়ের কাজ থেকে শুরু ক’রে বন্যপ্রাণী উদ্ধার অব্দি সব করানো হয়। স্থায়ী কর্মচারীরা ছুটি পেলেও এঁরা না পান কোনও ছুটি, না আছে এঁদের কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা। নিয়মিত ডিউটি আওয়ারের পরেও এঁদের দিয়ে বিনামূল্যে অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া হয়। আপত্তি জানালে দেওয়া হয় কাজ ছাঁটাইয়ের হুমকি! নদীয়ায় বাড়ী এমন এক কর্মী জানালেন যে গত দুবছর তাঁর বাড়ীই ফেরা হয়নি!

এমনকি করোনা-পরিস্থিতিতেও এঁদের উপর চাপ দিয়ে কাজ করানো হয়। স্থায়ী কর্মীরা কাজে না এলেও এঁরা যেকোনওভাবে রোজ কাজে আসতে বাধ্য থেকেছেন। সকলেই জানাচ্ছেন যে, গত এগারো মাসে বিনা বেতনে কাজ করতে গিয়ে, বাজারে দেনা হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। যাদের যেটুকুও সম্পত্তি আছে, তা হয়ে বিক্রী করতে হয়েছে অথবা বন্ধক রাখতে হয়েছে! বাড়ীতে বৃদ্ধদের জন্য ওষুধ বা বাচ্চাদের লেখাপড়া সবই এখন গভীর অনিশ্চয়তায়।

আন্দোলনকারীদের সাথে কথা ব’লে জানা গেলো তাঁদের চাকরীর চুক্তিপত্রের মেয়াদ এক বছর, যেটা এবছরের সেপ্টেম্বরেই শেষ হয়েছে। তারপরেও টানা দুমাস বিনা নতুন এগ্রিমেন্টে কাজ করিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। তাই দাবী উঠছে, টানা বারো বছর ধ’রে কর্মরত থাকা ও গত দু’মাস বিনা এগ্রিমেন্টে কাজ করানোর পরও তাঁদেরকে স্থায়ী কর্মী হিসেবে কেনো নিযুক্ত করা হবেনা! শ্রম-আইনের বিন্দুবিসর্গ মানতেও যে এরাজ্যের সরকার ও শাসকদল তৃণমূল একেবারেই নারাজ, সরকার-অধিকৃত একটি সংস্থায় এরকম ঘটনাই তার প্রমাণ। 

বনমন্ত্রকের অধীনে থাকা এই সংস্থার ক্ষেত্রে, বনমন্ত্রকের তরফ থেকে কোনও আলোচনা প্রস্তাব আসেনি বলেই জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। রেঞ্জার তাঁদের বকেয়া মেটানোর আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন তুলে নিতে বললে, বিক্ষোভকারীরা তার লিখিত চান। রেঞ্জার তা দিতে অস্বীকার করায় আন্দোলনকারী কর্মীরা বলছেন যে, যতক্ষণ না অব্দি তাঁদের দাবীগুলি পূরণ করা হবে, তাঁদের অবস্থান-বিক্ষোভ চলবে। 

এদিকে, লকডাউনের কোপেই যে এইভাবে ছাঁটাই বা বেতন-বকেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে, সেই সত্যকে চাপতেই বড়ো বাজারী মিডিয়া যে তাঁদের আন্দোলনের কথা চেপে যাচ্ছে, এমন ক্ষোভও উঠে আসে অবস্থান থেকে। 

এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে, করোনার অজুহাতে এই লকডাউন দিয়ে দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষকে জেনেবুঝে বেকারী ও বেরোজগারীর উনুনে ফেলা হয়েছে। কাজ ছাঁটাই ও বেতন-বকেয়া বা বেতন-হ্রাস এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার ও দুই শাসকদলই যে এব্যপারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে তাও জলের মতই স্বচ্ছ। এর বিরুদ্ধে যে একটি ব্যপক ও সংগঠিত আন্দোলন জরুরী তা নিয়ে সাধারণ মানুষও একমত হচ্ছেন। 

আন্দোলনরত চিন্তামণি কর পাখিরালয়ের অস্থায়ী কর্মীদের সাথে কথা বলছেন পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের কমরেড অরিত্র বসু

চিন্তামনি’র কর্মীরাও একথা স্বীকার করে নিলেন যে লকডাউনের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের দাবীতে, সরকারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের খেটেখাওয়া মানুষের  ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দরকার। 

এইমুহুর্তে, ১২ জন অস্থায়ী কর্মী তাঁদের এগারো মাসের বকেয়া বেতন ও স্থায়ী কর্মী হিসেবে স্বীকৃতির যে লড়াই চালাচ্ছেন, তা কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সেটাই দেখার।  

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *