সরকারি ছুটি উপভোগ সর্বস্বতায় মে দিবসের ইতিহাস আজ বিস্মৃতির পথে। শুধু কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন বা তথাকথিত শ্রমিক শ্রেণীর পাটিগুলির নিজস্ব উদযাপন ছাড়া আর কিছুই তেমন অবশিষ্ট নেই। অবশ্য কর্পোরেটদের দালাল পুঁজিবাদী দলগুলির শ্রমিক সংগঠনগুলি যে মে দিবসের সংস্কৃতিকে ইতিহাসবিহীন-সংগ্রামবিহীন একটি ছুটির দিনে পরিণত করবে, সেটাই স্বাভাবিক! অথচ, আজ যখন নয়াউদারবাদের শোষণে শ্রমিকশ্রেণীর প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন দাঁড়িয়ে ছুটি আর মোচ্ছব ভুলে ইতিহাসকে স্মরণ করাই একান্ত আবশ্যক। 
 
১৮৮৬ সালের ১লা মে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবীতে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয় এবং ৩রা ও ৪ঠা মে-তে পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধের পরিণতিতে শ্রমিক নেতা স্পাইন্স, স্পাইজ, এঙ্গেল এবং ফিসারকে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিতে হয়। এই লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি ও তার উপনবেশগুলিতে এবং ১লা মে দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের লড়াকু চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। 
 
এই লড়াই একদিনে সংগঠিত হয়নি। ১৮২০-১৮৪০ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজের দাবীতে আন্দোলন-ধর্মঘট চলছিল। ১৮৫৬-এ প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ধর্মঘট হয়।। তার চার বছরের মাথায় ১৮৬২-তে আমাদের দেশে হাওড়ায় ১২০০ রেল শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ধর্মঘট করেন। ১৮৬৬-এ আমেরিকার ৮টি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ ঘোষণা করে, “এই দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে পুঁজির দাসত্ব থেকে মুক্ত করবার জন্য এই মুহূর্তে প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হল এমন একটা আইন পাশ করা যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব রাজ্যেই সাধারণ কাজের দিন হবে ৮ঘণ্টা।” মার্কস ও এঙ্গেলস গঠিত প্রথম ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ বিবৃতি দেয়, “কাজের দিন আইন করে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার ব্যাপার একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা ; এই ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি ও মুক্তির পরবর্তী সকল প্রচেষ্টাই বিফল হতে বাধ্য।” কারণ, প্রয়োজনীয় কাজের সময়’ (necessary working time)-এর তুলনায় উদ্বৃত্ত শ্রমের পরিমাণ যত বেশি হবে, শ্রমিক শ্রেণীর শোষণ ততই বাড়বে, একইসাথে কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং মানসিক বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের অবকাশ লোপ পাবে যা শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের পথে এক অন্যতম বাধা হিসেবে কার্যকর হবে।
 
এই সামগ্রিক আন্দোলন-ধর্মঘটের সাথে সংযুক্ত ছিল মার্ক্সের পুঁজি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। মার্ক্স তাঁর ‘ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খণ্ডে (১৫ অধ্যায়) বলেন, “যখন মেশিনারির ব্যবহার মোটামুটি একটি একচেটিয়া ব্যাপার, তখন স্বভাবতই মুনাফা হয় অসাধারণ এবং মালিক চেষ্টা করে কর্মদিবসকে যথাসাধ্য দীর্ঘায়িত করে তার ‘প্রথম প্রেমের আলোকিত প্রহরটির’ পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে। মুনাফার আয়তন তার আরও মুনাফার লোলুপতাকে আরও শানিত করে তোলে।” এখানেই মার্ক্স দেখান কিভাবে মেশিনারী ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি উৎপাদন করিয়ে এবং অন্যদিকে যতটা বেশি সময় সম্ভব খাটিয়ে দু’তরফা মুনাফা অর্জন করে মালিকশ্রেণী। তাছাড়া, ক্যাপিটালের ১ম খণ্ডে (১০-ম অধ্যায়) মার্ক্স দেখিয়েছেন কিভাবে এমনকি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্বৃত্ত শ্রমও সামগ্রিকভাবে মালিকশ্রেণীর হাতে এক বিপুল অঙ্কের মুনাফা তুলে দেয়! ফ্যাক্টারি ইন্সপেক্টারদের রিপোর্ট থেকে তিনি দেখিয়েছেন যে শ্রমিকের মাথাপিছু “প্রতিদিন ৫ মিনিটের বর্ধিত শ্রম, কিছু সপ্তাহের সঙ্গে গুণ করলে তা বছরে আড়াই দিনের উৎপাদনের সমান হয়”! আর মালিকের এই অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলশ্রুতিতে শ্রমিকের নিয়তি হয় ‘ছাঁটাই’।   
 
১৮৬০-এর দশকে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলার কারণে এই আন্দোলন সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। কিন্তু, তা কয়েকগুন বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে আসে ১৮৮৩-তে, মার্ক্সের মৃত্যুর পরেই; ১৮৮৬-তে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ১৮৯০-তে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশে এই লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছর মে দিবসের আগে প্রকাশিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভূমিকায় এঙ্গেলস লেখেন, “দুনিয়ার মেহনতী জনগণ এক হও! প্রথম প্যারিস বিপ্লবে সর্বহারা তার নিজস্ব দাবী নিয়ে হাজির হয়, তার ঠিক পূর্বক্ষণে, আজ থেকে ৪২ বছর আগে আমরা যখন পৃথিবীর সামনে একথা ঘোষণ করেছিলাম, অতি অল্প লোকেই তাতে গলা মিলিয়েছিল। … ঠিক আজকের দিনে যখন আমি লিখছি তখন  ইউরোপ আর আমেরিকার- সর্বহারারা তাদের লড়বার বল পরিদর্শন করছে, সেটার এই সর্বপ্রথম সমাবেশ ঘটছে। সমাবেশ ঘটছে একটা গোটা বাহিনী রূপে, একই পতাকার নীচে, একই তার লক্ষ্য…”। এরপর এক শতক জুড়ে বিশ্বের মেহনতী জনতা তাদের  অসামান্য ঐক্য তৈরী করেছিল ক্রমে ক্রমে, বিশেষত কমরেড লেনিনের দেখানো পথে সোভিয়েত বিপ্লবের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে, ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করে এবং পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ দেশে নিজের সমাজতান্ত্রিক শিবির বানিয়ে।
 
নয়াউদারবাদের এই যুগে শ্রম জলের চেয়েও সস্তা দরে বিকোচ্ছে। বর্তমানে যেখানে আমাদের দেশের ধনী ১% দেশের ৭৩% সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে সেখানে দেশের ১১০ কোটিরও বেশি জনগণের দিনে ৫০ টাকাও খরচ করার সামর্থ নেই! ১৩৩ বছর আগের আজকের দিনের ধর্মঘটের দাবীকে কার্যত কাঁচকলা দেখিয়ে যখন ওভারটাইমের রমরমা বাজার চলছে, তখন আবার নতুন করে ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ হয় এসেছে।  
 
আজ সমস্ত বেসরকারী ক্ষেত্রগুলিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা হচ্ছে, কন্ট্রাকচুয়াল লেবারার/ওয়ার্কার বা ঠিকা শ্রমিক দিয়েই পুঁজির উনুনে আঁচ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি ক্ষেত্রগুলিকেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে পরিণত করার এক প্রকৃয়া চলছে আমাদের তৃণমূলীয় বাংলায়; পুলিশের বদলে সিভিক ভলেন্টিয়ার, স্থায়ী শিক্ষকের বদলে ভলেন্ট্যারি টিচার ইত্যাদি ইত্যাদি। অবাধে সরকারি ক্ষেত্র সংকোচন করা চলছে আর বেড়ে চলেছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-পরিবহন-সর্বত্র বিপুল হারে প্রাইভেটাইজেশন। ব্যাংকিং-এর ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে প্রত্যেকের হাতের টাকা (cash-in-hand)-তে হাত গলিয়ে রাখছে কেন্দ্রের বি জ়ে পি সরকার। 
 
বিশ্বপুঁজির সংকট বয়ে আসছে আমাদের দেশেও। উন্মুক্ত এই বিশ্ববাজারে সংকট চালান হয় মূলধনের সাথে সাথে, ফলে ফাটকা কারবারির এই উদার বাজার ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের সংকটের মুখে পড়ে বড় বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে একের পর এক ছোট বড় ব্যাংক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ঋণের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে আর নয়তো উড়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে কোনো গোপন বিদেশি আস্তানায়। আর সেই সব ঋণের দায় এসে পড়ছে সাধারণ খেটে খাওয়াদের ঘাড়ে। সংকট ঠেকাতে বাজারে হই হই করে ব্যাংক কোলাবরেশন চলছে। তার ওপর ফাটকা কারবার থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তেও একচেটিয়াদের মুনাফার হার অক্ষুন্ন রাখতে এসে পড়েছে বিমুদ্রাকরণ। সঙ্গে রয়েছে দোসর জিএসটি- আয় করের বদলে ব্যায়করের এই ব্যবস্থায় মানুষের জীবন রাষ্ট্রের হস্তগত হয়ে উঠছে। আর এহেন পরিস্থিতিতে মে দিবসের ইতিহাসের চেয়ে রামনবমীর ঝলক বেশি আলোকিত করে রাখার চেষ্টা চলছে মেহনতীদের চোখে। ‘গিলিয়ে দেবে ধর্মটনিক, ভুলিয়ে দেবে শ্রেণী’– সেই ধর্মটনিকের মায়ার বাধন কাটিয়ে উঠে শ্রেণীশোষণের বিরুদ্ধে মেহনতী-শ্রমিক-কৃষক-ঠিকাশ্রমিক-ছোট ব্যবসায়ী-বেকার-দলিত-আদিবাসী-মহিলা-হিজড়ে সহ সমগ্র শোষিত নিপীড়িতদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠা আজ সময়ের দাবী। 
 

ঐতিহাসিক মে দিবস জিন্দাবাদ।

দুনিয়ার মজদুর এক হও।

 
 
তথ্য ঋণঃ
১.  মে দিবস… আজকের শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত-জবরদখল পত্রিকা, বর্ষ ৪, সংখ্যা ১৪ 
২. ক্যাপিটাল- কার্ল মার্ক্স; ১ম খন্ড (১০ ও ১৫ অধ্যায়)
৩. কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো- কার্ল মার্ক্স
 
Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *