কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের একের পর এক পদক্ষেপে দেশে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের তীব্রতা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। এনআরসি, জম্মু ও কাশ্মীরের উপর লাগু ৩৭০ এবং ৩৫-এ ধারা বাতিল, ইউএপিএ আইনের সংশোধনের মতো একের পর এক পদক্ষেপ রীতিমতো ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করছে দেশজুড়ে। একই সাথে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণ, ব্যাঙ্ক সংযুক্তি, গাড়ি-শিল্প থেকে রেল ও প্রতিরক্ষার মতো সরকারী ক্ষেত্রে ব্যপক ছাঁটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথ প্রশস্ত ক্রমেই হচ্ছে। ফ্যাসিবাদের তীব্রতা বাড়ার নেপথ্যের কারণ এবং দেশের লড়াকু বামপন্থী শক্তিগুলির করনীয় কী, এই প্রশ্নকে সামনে রেখে গত ২২ শে সেপ্টেম্বর, রবিবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করে সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার। উক্ত আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী শক্তির প্রতিনিধিবর্গ এবং বামপন্থী বিশিষ্ট্যজন।
আলোচনাসভার শুরুতে সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড কে এন রামচন্দ্রন, সংগ্রামী বাম শক্তিদের নিয়ে একটি কেন্দ্র গঠন করার প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবের সপক্ষে তিনি বলেন, “একটি কেন্দ্র ছাড়া বৃহত্তর ফ্যাসিবাদবিরোধী ফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব নয়। কারণ এই সময়ে একটি শক্তিশালী ও সাচ্চা কমিউনিষ্ট পার্টির অভাব আছে।” কিন্তু এর সাথে তিনি যোগ করেন, এই কেন্দ্রই গোটা লড়াইটা লড়তে পারবে এমন ভাবাটাও সম্পূর্ণ সঠিক নয় কিন্তু একটি কেন্দ্র ব্যাতিরেকে কমিউনিস্টদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব হবে না।

সিপিআই (এম-এল)-কানু সান্যাল গোষ্ঠীর কমরেড সুমিত দাস বলেন, “আমাদের অর্থাৎ বিপ্লবী কমিউনিস্ট শক্তিগুলিকে বর্তমানে অনেক বেশি করে একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে আমরা পরষ্পরকে আরও ভালভাবে জানতে বুঝতে পারি”। সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে বক্তব্য কমরেড আলোক মুখার্জী বলেন তাঁদের দল ইতিমধ্যেই এই ধরণের একাধিক উদ্যোগ শুরু করেছে। হায়দ্রাবাদে এবং কলকাতায় দুটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি সভাতেই সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার-এর কমরেডরা উপস্থিত ছিলেন। একই সাথে তিনি বলেন অত্যন্ত দ্রুত তাঁরা এই দুটি উদ্যোগকে মিলিয়ে কীভাবে একটি কমন জায়গায় পৌঁছনো যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

আলোচনাসভার প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে ইউসিসিআরআইএমএল (কিষান)-এর পক্ষে কমরেড সদানন্দ এবং পি.আর.সি-সিপিআই (এম-এল) দলের পক্ষ থেকে কমরেড কানাই এই সময়ে ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্ট গঠন করার অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেন। ‘চিন্তন’ পত্রিকার তরফ থেকে কুশল দেবনাথ বলেন, গণ-আন্দোলনগুলির বিকাশের জন্যই বামপন্থীদের আরও সচেষ্ট হতে হবে।
কর্নাটকের ‘জনচেতনা’ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড মোহন। তিনি বলেন যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ধরণের একটি উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ফ্যাসিবাদও আসলে প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রসম্পন্ন একটি গণ-আন্দোলন। তাই পালটা প্রগতিশীল চিন্তনের গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা কমিউনিস্টদের আশু কর্তব্য। তাই ফ্যাসিবাদকে রুখতে কমিউনিস্টদের মতাদর্শভিত্তিক সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

পিপ্ল্’স্ ব্রিগেডের আহ্বায়ক কমরেড বাসুদেব নাগচৌধুরী তাঁর বক্তব্যে কিছুটা ভিন্ন সুর বেঁধে ফ্যাসিবাদের উত্থানের নেপথ্যে বিশ্ব-অর্থনীতির সংকটের প্রেক্ষিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বর্তমানে ভারতে আমাদের মত কমিউনিস্ট শক্তিগুলির কাছে দুটি ধারনা তৈরি হয়েছে। এক, আমাদের বিরুদ্ধের ফ্যাসিবাদী শক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুই, প্রবল প্রতাপশালী ফ্যাসিবাদীদের তুলনায় আমরা নিতান্ত দুর্বল। কিন্তু আসলে বিষয়টা ঠিক বিপরীত, পুঁজিবাদ বর্তমানে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ফ্যাসিবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে।” একইসাথে তিনি নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির একের পর এক সংকটের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখান যে নয়াউদারবাদের আমলে শেয়ার বাজারের ফাটকা কারবার বা ডেরিভেটিভ ট্রেডিং’-এর জন্য মোটামুটি সাত-আট বছর অন্তর অর্থনৈতিক সংকট ঘুরে ফিরে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাই এর মোকাবিলায় আঘাত হানতে হবে দুর্বলতম গ্রন্থিতে।
আলোচনাসভাটিতে যে সব বামশক্তি অংশগ্রহণ করেন তাঁরা প্রত্যেকেই আলোচনায় উঠে আসা বিভিন্ন বক্তব্যের ভিত্তিতে বিপ্লবী বাম শক্তিগুলিকে একজোট হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান।
