ঠিক ২১ শে জুলাই-এর প্রাক্কালে ‘এই সময়’ পত্রিকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক শ্রীযুক্ত মইদুল ইসলাম–এর আর্টিক্‌ল্‌টি তৃণমূল দল ও সরকারে বেশ মজেছে বলে মনে হল। মহামতি লেখক পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম) এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে প্রধান তিনটে পার্থক্য তুলে ধরেছেন :
রামধনু জোট

প্রথমত, তৃণমূল অনেক বেশি রাজ্য-কেন্দ্রিক ইস্যু নিয়ে চিন্তিত। বামেরা তাদের বিভিন্ন প্রদেশের ‘লবির’ দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত। দ্বিতীয়ত, সামাজিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে তৃণমূল অপেক্ষাকৃত সাবল্টার্ন (নিম্নবর্গীয়)। তৃতীয়ত, বামেদের সংগঠিত শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির তুলনায় সংখ্যায় বিপুল, অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষকে ম্যানেজ করার বিষয়ে তৃণমূল অধিক পটু।

এহেন মহান আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক রাষ্ট্র-এর থেকে সবিশেষ পুরস্কার ও উপঢৌকন আশা করতেই পারেন, আর তা অতীব সহজলভ্যও হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত ২১শের পুণ্যলগ্নের পূর্বক্ষণেই এমন গবেষণা-বুদ্ধির প্রয়গের জন্য। ‘বুদ্ধি’ বিক্রির ‘জীবিকা’ বলে কথা ! যাই হোক, এই তিনটে কথাকেই আমরা এখানে বুঝে দেখবার চেষ্টা করব, যদিও বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-কে ডিফেন্ড করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়; কারণ তাঁদেরকে রক্ষা করার দিবাস্বপ্ন সম্ভবত স্বয়ং স্তালিন বেঁচে থাকলেও দেখতেন বলে মনে হয় না; তাঁদের সুইসাইডাল অ্যাটেম্প্‌ট্‌ অপ্রতিরোধ্য।
 
 সল্ট লেকে হকার উচ্ছেদ
প্রথম কথা, তৃণমূল কংগ্রেস যে “অনেক বেশি”-ই নয় বরং “সম্পূর্ণতই” রাজ্য-কেন্দ্রিক ইস্যু নিয়ে চিন্তিত থাকবে, সেটা কি পাঁকাল মাছ যে জোয়ার-ভাঁটা নিয়ে চিন্তিত হয় না, তেমনই স্বতঃসিদ্ধ নয়? অল্‌ ইন্ডিয়া পার্টির তকমা পেলেও সে যে একান্তই একটা রাজ্যে সীমাবদ্ধ আঞ্চলিক দল, আর পাঁচটা মায়াবতী-মুলায়াম-লালু-নীতিশ-এর মতোই দুর্নীতির দায় থেকে ‘লাইফ্‌ সেভ্‌’ করা ছাড়া সর্বদাই নিজের কুয়োয় ‘সেফ্‌ ডাইভ্‌’ দেওয়া ব্যাং, তা বুঝতে কি ডক্টরেট-এর মুকুট পরতে লাগে? ভাবনার বিষয় বরং তখনই এসে পড়ে যখন চড়া পরা পাড় দেখে পাঁকাল নদীর গতি মাপতে শুরু করে; আর ভাবনা আরও বাড়ায় যখন দেখি সেই পাঁকালের লেজ ধরে কেউ বাথটবে জল ছলকাচ্ছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল রাজ্য-কেন্দ্রিক ইস্যুগুলি কী? যেখানে আজ আমাদের রাজ্যের প্রায় ৮৫% মানুষের দৈনিক খরচের ক্ষমতা গ্রামে ৫০ টাকার কম এবং শহরে ১০০ টাকার কম, সেখানে সাম্প্রতিক নোটবন্দী-জিএসটির নামে মহামান্য মুখ্যমন্ত্রীর দেশব্যাপী ঘুরঘুর, বা লালু থেকে তেলেগু থেকে কেজরি হয়ে বিজয়ন সাক্ষাৎ কোন রাজ্য-কেন্দ্রিক ইস্যু বলতে পারেন অধ্যাপক মশাই ! অন্যদিকে বামেরা যে তাদের “বিভিন্ন প্রদেশের ‘লবির’ দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত”, তা তাদের যার যার প্রদেশের “রাজ্য-কেন্দ্রিক চিন্তা”-কেই দেখায় না কি? লক্ষ্য মতাদর্শ ভুলে ‘ফেডেরালিজ্‌ম্‌’-এর সুবিধাবাদকেই আঁকড়ে ধরে আরও অতলে তলিয়ে যাও, এই কি আপনার ‘ভাবনা’-র ফসলজাত সুচিন্তিত পরামর্শ, ‘কমরেড’? 
দ্বিতীয় কথা, উপজাতি, অনগ্রসর শ্রেণী ও পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন বাদে কোন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদ তৃণমূল কংগ্রেস তথাকথিত সাবল্টার্নদের দিয়েছে? অনুরূপ মন্ত্রিত্বগুলি বাম আমলেও এরূপ সাবল্টার্নদের হাতেই ছিল। কিন্তু তা কি যথেষ্ট ছিল? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তা বলে তৃণমূলকে এই সার্টিফিকেট ! ক্যাবিনেট মন্ত্রিত্বের সিংহভাগটাই সে আমলেও ছিল উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতে, এ আমলেও ঠিক তাইই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তখন ছিলেন ‘ভট্টাচার্য্য’, এখন ‘ব্যানার্জি’; শুধু পার্থক্য একটাই, বর্তমান প্রাক্তনের থেকে তিনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নিজের হাতে নিয়েছেন, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, স্বাস্থ্য এবং ক্ষুদ্রশিল্প। ভাঙ্গড় থেকে ভাবাদিঘি ভূমির এবং ডেঙ্গুতে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের অকালমৃত্যু স্বাস্থ্যের নিশ্চয়ই উন্নয়নের দ্যোতক ! একথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে তৃণমূল সরকারের ক্ষুদ্রশিল্প নীতি বাংলাকে বিশ্ব-বাংলায় উত্তীর্ণ করেছে, জগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘তেলেভাজা শিল্প’-এর খ্যাতি। 
 ভাঙ্গরে সন্ত্রাস
মহামতি মইদুলবাবু তাঁর ‘সাবল্টার্ন’ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য এক অসামান্য পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন। তিনি তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন যে ২০০৬-এর বামফ্রন্টের তুলনায় ২০১৬-র তৃণমূল মন্ত্রিসভায় মহিলা, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধির সংখ্যা যথাক্রমে ৬.৮১, ১৫.৯০, ৪.৫৪ ও ১১.৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.৯০, ১৬.৬৬, ৭.১৪ ও ১৬.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ কিনা মন্ত্রিসভায় মহিলা, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধির সংখ্যা সে আমল থেকে এ আমলে বেড়েছে যথাক্রমে ৫.০৯, ০.৭৭, ২.৬ এবং ৫.৩০ শতাংশ। বেশ বেশ। কিন্তু মইদুল বাবু, মন্ত্রিসভায় মোট সদস্য সংখ্যা কত? ২০০৬-এ ছিল ৪৮, ২০১৬-এ ৪২। সুতরাং যাকে আপনি ১০০-এ কত বাড়ল বলে তুলে ধরছেন, ৪৮/৪২-এ তা কি অর্ধেকেরও কম হয়ে যায় না? সুতরাং আসলে সংখ্যায় দু-একটির বেশি যা বাড়েনি, তাকেই ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে তুলে ‘শতাংশ’-এ দেখানোর মহান উদ্দেশ্যটি কী তা জানতে পারি? আর প্রকৃত বাস্তবে এই ১-২ জন প্রতিনিধির বেড়ে ওঠাতেই তৃণমূল হয়ে গেল বামেদের তুলনায় বেশি ‘সাবল্টার্ন’ ! 
মইদুল বাবু তাঁর তত্ত্বের সপক্ষে এহেন তথ্যের সাথে যে সকল ‘উদাহরণ’ হাজির করেছেন, তা সমাজবিদ্যার তত্ত্বায়ণের পরিসরে ‘নজির’ গড়তে পারে। নাম না করে তিনি যাঁদের কথা তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ক্ষমতার লোভে দেড় হাত জিভ বার করে থাকা ধনী চাষি পরিবারের রেজ্জাক মোল্লা, যিনি মইদুল বাবুর চোখে ‘বাঙালি কৃষক’-এর প্রতিমূর্তি, আছেন প্রচুর আর্থিক-সামাজিক প্রতিপত্তি সম্পন্ন ডাঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, যিনি নাকি ‘সাবল্টার্ন’ প্রতিনিধি, এবং সর্বোপরি আছেন ‘উন্নয়নখ্যাত’ অনুব্রত বাবু, কেবল পদবির কারণেই যিনি নাকি হয়ে উঠেছেন নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতিরূপ (ছবিটা একবার কল্পনা করুন) ! এই সূত্র ধরে তো শুটেড-বুটেড মইদুল বাবুও হয়ে উঠবেন বাংলার হৃতসর্বস্ব সাধারণ মুসলমান জনগণের ‘আইকনিক সিম্বল’ ! তাই না ! 
একদিকে ইমামদের জন্য ভাতা ঘোষণা করে ধর্মীয় দাঙ্গা তৈরিতে ইন্ধন, আর অন্যদিকে অনগ্রসর সংখ্যালঘুদের ১০ ’হাজার পদে এক জনকেও নিয়োগ না করে তাঁদেরকে রোজ রোজ ভাতে মারা, ‘কন্যাশ্রী’ নামের ঝলক দিয়ে বাম আমলে চালু হওয়া এই প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, আর ক্ষতিপূরণের নামে ‘রেপ-রেট’ চালু করা, আর ‘বেঙ্গল মিন্‌স্‌ বিজনেস’ স্লোগানে ঢালাও বেসরকারিকরণের (যেখানে সংরক্ষণ হয় না) মাধ্যমে দলিত-আদিবাসীদের সকল সেক্টর থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, এই না হলে আপনাদের মহান উত্তরাধুনিকতাবাদী ‘সাবল্টার্ন’ রাজনীতি?      
জনকল্যাণে সারদা !
এ রাজ্যের অগণিত নিঃস্ব প্রকৃত ‘সাবল্টার্ন’ মানুষের সাথে কি পরিহাসমূলক তঞ্চকতা করছেন, ভেবে দেখেছেন, কমরেড?
তৃতীয় কথা, বামেদের তথা সিপিআই(এম)-এর অরগানাইজ্‌ড্‌ সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির সাথে মইদুল বাবু তুলনা টেনেছেন তৃণমূলের আনঅরগানাইজ্‌ড্‌ সেক্টরের বিপুল সংখ্যক মানুষকে ‘ম্যানেজ’ করবার যোগ্যতার। সিপিআই(এম)-কে তিনি এক্ষেত্রে যে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, ফ্যাক্টরি মজদুরেরা তেমন সার্টিফিকেট দিচ্ছেন কিনা তা গত দুই দশকে যাঁরা তাঁদের মধ্যে ন্যূনতম কাজকর্ম করেছেন তাঁদের থেকে জেনে নিন; মজদুরদের সাথে কথা বলা তো আর আপনাদের মতো মহান ‘সাবল্টার্ন’পন্থী অধ্যাপকদের হয়ে ওঠে না। আপাতত না হয় সে কথা ছেড়েই দিলাম। তবে তৃণমূলের ‘ম্যানেজ’ করবার বিশেষ পটুতাকে আপনি সত্যই আবিষ্কার করেছেন। শুধু কিনা তার স্বরূপ প্রকাশ করার জন্য কোনও উদাহরণ তুলে ধরতে ভুলে গেছেন ভুলবশত। যেমন, একশো দিনের কাজ দেওয়ার নামে গড়ে ১৫ দিন কাজ দিয়ে বাকি টাকা মেরে দিয়ে গ্রামীণ বেকারত্ব ‘ম্যানেজ’ করছেন পঞ্চায়েতের হুব্বারা। রাস্তার ধারের প্রতিটা চা-তেলেভাজা-রোলের দোকান থেকে এক-এক জন তৃণমূল কাউন্সিলার দিনে ৩০০-৫০০ টাকা তোলা নিচ্ছেন তাঁদের রাস্তা ‘ম্যানেজ’ করার ফিজ্‌ হিসাবে। কোর্টের রায়ে সল্টলেকের হকারদের পুলিশ দিয়ে উচ্ছেদ করতে না পেরে পৌরসভার কর্মীদের (আদতে তৃণমূলের ভাড়াতে গুন্ডা) দিয়ে উচ্ছেদ চলছে আইন ‘ম্যানেজ’ করতে। নিরন্ন কিন্তু নিজের পয়সায় কেনা বাধ্যতামূলক পোষাকে ঢাকা সিভিক পুলিশ দিয়ে চলছে রাস্তায় প্রতিদিন বাড়তে থাকা প্রাইভেট গাড়ি আর লুপ্তপ্রায় পাবলিক বাসের ‘ম্যানেজ’। আর সিন্ডিকেটের অসংগঠিত মানুষের কথা না হয় নাই পাড়া গেল। 
 টাকা যার, অনার্স তার…
তাই বলে অবশ্য আসল ‘ম্যানেজ’-এর ক্ষমতাটা তো আর বাদ রাখা যায় না, সংগঠিত হোক বা অসংগঠিত, শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকলেই তা ভাঙতে পুলিশ দিয়ে মাইক প্রচার এমন কি ‘সার্ভিস ব্রেক’-এর হুমকি, কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলেই আরও একটা ‘ছুটি’। ছুটির পর ছুটি উপভোগ করতে থাকা আপনারা হলেন ‘সাবল্টার্ন’ ! আপনাদের ছুটির দিনের মোচ্ছব বাঁচিয়ে রাখা রান্নার মাসি থেকে উবের চালক থেকে স্টেশনের কুলি থেকে রেস্টুরেন্টের ওয়েটার থেকে সুইগির ডেলিভারি বয়, সকলের মহান ‘সাবল্টার্ন’ প্রতিনিধি আপনারা ! এই ‘সাবল্টার্ন’ ঘরের ছেলেমেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে বা কলেজে ভর্তি করতে গেলে আপনার ‘সাবল্টার্ন’ পার্টির নেতারা কত দর হাঁকাচ্ছে তার একটা পরিসংখ্যান দেবেন, গবেষক মশাই? 
তৃণমূলের প্রতি ব্যাপক জনরোষ এবং বিরোধী সংগ্রামী শক্তির অনুপস্থিতিই যে এরাজ্যে বানরবংশীয় আরএসএস-বিজেপি-র অনুপ্রবেশের মসৃণ রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছে তা আজ স্ফটিকের মতো স্পষ্ট। এহেন পরিস্থিতিতে “লোট ও জোট” ছাড়া আর কীই বা অপশন থাকতে পারে ! তাই আপনি তৃণমূল কেন ভোট বেশি পায় তার যতো ব্যাখ্যাই দিন না কেন আপনার প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী ২১শের সমাবেশে তাঁর ব্যাখ্যা কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় হাজির করেছেন : “তৃণমূল জেলা পরিষদে ৯০% আসনে জিতেছে। উত্তরাখণ্ডে তো ৭০% আসনে ভোট হয় না, সিকিমে ৮০% আসনে ভোট হয় না, বিহার, উত্তরপ্রদেশেও একই। কই তখন তো কিছু বলা হয় না”। আপনার “কেন ভোট বেশি পায়” এই প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রীর “ভোট হয় না” এই উত্তরে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নিশ্চয়ই। তা কি আর হয় ! কারণ তৃণমূলকে দেখে বামেদের শিখতে আপনার এই মহান পরামর্শ যে উভয়কে কাছে আনার দারুন সুকৌশল প্রয়াস, তা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কংগ্রেসের সাথে জোট করে এরাজ্যের নেতারা এমনিতেই বিপরীতধর্মী মেরুকে এক চুম্বকে বাঁধতে সুপটু। তাঁদের পদ্ধতিগুলোও এখন আগের চেয়েও আরও অনেক বেশি বোধগম্য হয়ে গেছে। যেমন যাঁরা যাঁরা যে যে অর্ডারে কংগ্রেসের সাথে জোটের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাঁরা তাঁরা প্রায় সেই একই অর্ডারে এখন একে একে তৃণমূলের সাথে জোটের কথা তুলতে লেগেছেন। তাঁদেরই পরিকল্পনায় যে মইনুল সাহেব তৃণমূলের সাথে জোট না করলে পার্টি ছেড়ে দেব বলে গোঁ ধরেছেন, বাজার গরম করছেন তা আজ স্পষ্ট। কিন্তু আপনি কাদের হয়ে বাজারে নামলেন, কমরেড? 
শেষ কথা, তৃণমূলের কংগ্রেসি স্বভাব আর বাম বিকল্পের অভাব ‘ভাবনা’-র আলোকচ্ছটায় এভাবে চেপে রাখা যাবে, কমরেড?
 
 
 
 
 
 
বাসুদেব নাগ চৌধুরী ‘পিপ্‌ল্‌স্‌ ব্রিগেড’ সংগঠনের আহ্বায়ক। 
 

 

Similar Posts

4 Comments

  1. Era sob Mamata r Dalal… TV te ese lombachowra kotha chara ar ki ba ache eder…

  2. Trinamuler songe haat na melale godi te thakbe kivabe? Subidhabadi rajnitir obosombhabi porinoti…

  3. মোটামুটি বাঙালি বুদ্ধিজীবির স্বরূপটা হচ্ছে এরকম:
    সবাই খুব ভদ্রলোক, উৎকট রকমের সম্ভ্রান্ত। কেউ সওদাগরি দপ্তরে বড় সাহেব, কেউ ব্যবসাতে ফেঁপেছেন, কেউ মস্ত সরকারি চাকুরে; সেখানে স্বচ্ছল মাইনের ব্যবস্থা আছে। এদের বছরে একদিনও ট্রামে-বাসে চরতে হয় না; র‍্যাশনের লাইনে দাঁড়াতে হয় না; রেলস্টেশনের ভিড় ঠেলতে হয় না; কলকাতার বাইরে অন্য জায়গায় গেলে এরা হাওয়ায় জাহাজেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তা ছাড়া প্রতি বছর ২-১ বার দেশের বাইরে যাওয়া তো লেগেই আছে। এদের ছেলেমেয়েরা ইংরাজি স্কুলে শাণিত উচ্চারন শিখছে; মার্কিনী আদর্শে বড় হচ্ছে। বাড়িতে বাংলা ভাষায় কথা বলার পাঠ প্রায় উঠে যাওয়ায় যোগার। ব্যাঙ্কে কিছু টাকা জমেছে। বাইরের লোকেরা জানে না, চুপি চুপি ১টা ২ টো জমি কলকাতার আশে পাশে কেনা আছে। মিছিলে এদের দেখা যায় না; ময়দানের মিটিং এও পাত্তা পাওয়া যায় না।
    গা বাঁচিয়ে, অবসর বিনোদনের আধার হিসেবে এদের সাম্যবাদ চর্চা। জাগতিক সম্ভোগের মগডালে বসে এরা মনে করে ‘সমাজতন্ত্র’ মন্দ বিষয় নয়; ২-১ টা প্রবন্ধ লেখা যেতেই পারে। তাই, ‘সাংস্কৃতিক’ ও ‘সাহিত্যিক’ পত্রিকায়, এদের ক্বচিৎ-কদাচিৎ লিখতে দেখা যায়। সে-সব লেখা নানা-রকম কথায় টয়টম্বুর – দেশ থেকে বড়লোক দের ঝেঁটিয়ে তাড়াতে হবে; শিল্পদ্যোগ গুলো সব জাতীয়করণ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে-মধ্যে আবার গাড়ি হাঁকিয়ে কোথাও কোথাও সমাজতন্ত্রের সমস্যার ওপর বুলি কপচাতে যায়। লুকিয়ে চুরিয়ে বামপন্থী আন্দোলনের জন্য এরা ২-১০ টাকা দেয়। তারা বই কেনে; সামর্থ্য বেড়েছে, তাই বেশি করেই কেনে; মার্ক্সীয় সাহিত্যও কাতারে কাতারে কেনে। সন্ধ্যাবেলায় এদের ফ্ল্যাটে চকচকে ঝকঝকে জনসমাগম হয়; চলে রসালো আড্ডা…। তখন গর্বের সাথে সে-সব বই সবাইকে দেখায়। ব্যাস এই করে এদের লীলা শেষ। কিন্তু, তাদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় আদর্শের সামান্যতম ছোঁয়াও নেই।
    হয়তো কিশোর বয়সে এরাও স্বপ্ন দেখতো; ত্যাগে বিশ্বাস করতো; ইচ্ছা ছিলো – গোটা দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করবে; চাষি-মজুরের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে; তাদের আশ্বাস দেবে, আশ্রয় দেবে, অভয় দেবে, একসাথে জলে ভিজবে, রোদে পুরবে, কাদা মাখবে। এখন সবাই চোরের মত পালিয়ে এসেছে। যা হয়েছে তার কারনটা অবশ্যই শ্রেণীগত। মধ্যবিত্ত মানুষ তো! ব্যাক্তি-স্বার্থ থাকেই; অত সহজে de-classed হওয়া সম্ভব নয়। তাই, আস্তে আস্তে এদের আদর্শের প্রতি সেই বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। দুঃখ-কস্ট সহ্য করার, ত্যাগ করবার আঘাত এরা খুব বেশি দিন সইতে পারে নি। কিছুদিন বিপ্লব-বিপ্লব খেলে তাই সরে পরেছে। এখন আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের নিরাপদ দুর্গে ফিরে এসেছে।
    এইসব মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিরা তাদের ক্ষণিক প্রেম দিয়ে বামপন্থী আন্দোলনের উপকার বিশেষ করে নি; বরং ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। তারা ‘আদর্শহীনতা’র আদর্শ গড়েছে। এদের দেখে হালের ছাত্র-ছাত্রীরা শিখছে – বিপ্লবের বুলি আসলে বুজরুকি। তাহলে, আর কেন বামপন্থী আন্দোলনে মাথা গলানো? আর কেন মিছিলে নামা? আর কেন চেঁচিয়ে স্লোগান দেওয়া? আর কেন ক্ষেতে-খামারে গিয়ে সংগঠন? তার চেয়ে বরং এখন থেকে শেখা যাক, কি করে ভাল চাকরি বাগানো যেতে পারে; দেখা যাক, কোন চালাকি মারফৎ অল্প সময়ের মধ্যে বেশি টাকা করা যায়।
    এই ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবিরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাস্তায় শুধু বাগড়া দিতে পারে মাত্র; এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবে বলে তো মনে হয় না। চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সময় আমাদের দেশের জমিদাররা হাতি পুষতেন, পাখি পুষতেন। শিল্পপতিরা তেমনি এখন তাদের খেয়াল মেটাচ্ছেন এই সব নাম-ডাক ওয়ালা বুদ্ধিজীবি পুষে।

  4. “…দেখা হলেই মিষ্ট অতি
    মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
    অলস দেহে ক্লিষ্টগতি –
    গৃহের প্রতি টান…”
    সোজা কথায় এই হচ্ছে বাঙালি বুদ্ধিজীবির আসল স্বরূপ।
    সব্বাই খুব ভদ্রলোক; উৎকট রকমের সম্ভ্রান্ত। কেউ সওদাগরি দপ্তরে বড় সাহেব, কেউ ব্যবসাতে ফেঁপেছেন, কেউ বা মস্ত সরকারি চাকুরে; সেখানে মোটা মাইনের ব্যবস্থা আছে। বছরে একদিনও এদের ট্রামে কিংবা বাসে চরতে হয় না; দাঁড়াতে হয় না র‍্যাশনের লাইনে; ঠেলতে হয় না রেল স্টেশনের ভিড়। কলকাতার বাইরে যখন যেতে হয় তখন হাওয়াই জাহাজই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাছাড়া, প্রতি বছর ২-১ বার দেশের বাইরে যাওয়া তো লেগেই আছে। ব্যাঙ্কে কিছু টাকা জমেছে; বাইরের লোক জানে না, চুপি চুপি একটা ২ টো জমিও কলকাতার আশেপাশে কেনা আছে। এদের ছেলেমেয়েরা ইংরাজি স্কুলে শাণিত উচ্চারন শিখছে; মার্কিনি আদর্শে বড় হচ্ছে। বাড়িতে বাংলা ভাষায় কথা বলার পাঠ প্রায় উঠে যাওয়ার যোগার। সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধের মগডালে বসার পর এদের মনে হয়েছে, অবসর -বিনোদনের জন্য সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস রাখাটা মন্দ জিনিস নয়। তাই, তারা লুকিয়ে চুরিয়ে বামপন্থী আন্দোলনের জন্য ২-১০ টাকা দেয়। তারা বই কেনে; ইদানিং সামর্থ বেড়েছে; তাই একটু বেশি করেই কেনে। তার মধ্যে বামপন্থী বইও কাতারে কাতারে থাকে। বসবার ঘরে সবাইকে তারা সে-সব বই গর্বের সাথে দেখায় । মিছিলে এদের মুখ দেখা যায় না; ময়দানে মিটিং হলেও এরা বেপাত্তা। সুখী জীবনের নিরাপদ আরামের আশ্রয়ে বসে, ক্বচিৎ-কদাচিৎ সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পত্রিকায় এরা প্রবন্ধ লেখে। সেগুলো সব নানা রকমের বাণীতে টয়টম্বুর: সমাজতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ; দেশ থেকে বড়লোকদের ঝেঁটিয়ে তাড়াতে হবে; শিল্প গুলো রাষ্ট্রায়াত্ত করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে গাড়ি হাঁকিয়ে তারা সমাজতন্ত্রের সমস্যার ওপর বুলি কপচাতে যায়। ব্যাস, দায়িত্ব শেষ।
    অথচ, একদিন হয়তো এরাও স্বপ্ন দেখতো।; ত্যাগে বিশ্বাস করতো। ওদেরও ইচ্ছা করতো দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করবে; চাষি-মজুরের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে; তাদের মধ্যে যতদিন পর্যন্ত শ্রেণীচেতনা না আসছে, যতদিন না তারা একজোট হচ্ছে, তাদের পাশে পাশে থেকে আশ্বাস দেবে; আশ্রয় দেবে; অভয় দেবে। তাদের সাথে জলে ভিজবে; রোদে পুড়বে; কাদায় মাখামাখি হবে। কিন্তু কোথায় কি? কিছুদিন বিপ্লব-বিপ্লব খেলা খেলে সবাই চোরের মতো পালিয়ে এসছে।
    স্বীকার না করে লাভ নেই, যা হয়েছে তার কারণ পুরোটায় শ্রেণীগত। মধ্যবিত্ত মন তো; ব্যাক্তিস্বার্থ বলে একটা ব্যাপার আছে। অত সহজে কি নিজেকে De-classed করা যায়? তাই আস্তে আস্তে আদর্শের প্রতি বাঁধন আলগা হয়ে এসেছে। দুঃখ কস্ট সহ্য করার রোমান্টিক স্বপ্ন বাস্তবের আঘাত খুব বেশিদিন সামলাতে পারে নি। শ্রেণীস্বার্থের হাতছানিতে, এখন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় আদর্শের ছিঠেফোঁটাও নেই। কি-করে জীবনযাত্রার মান আগের চেয়ে আরোও ভাল করা যায়, সেটাই এখন একমাত্র চিন্তা।
    এই বাংলাদেশে বামপন্থী বুদ্ধিজীবি হিসেবে এদের বেশ নাম আছে; কিন্তু, এইসব মধ্যবিত্ত লোকজন তাদের ক্ষনিক প্রেম দিয়ে বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলনের উপকার তো কিছু করেই নি, তার চেয়েও বরং ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। তারা আদর্শহীনতার আদর্শ তৈরি করেছে। হালের ছাত্র-ছাত্রীরা এদের দৃষ্টান্ত থেকে শিখছে: ও-সব বিপ্লবের বুলি আসলে বুজরুকি। তা-ই যদি হয়, তাহলে আর কেন বামপন্থী আন্দোলনে মাথা গলানো? আর কেন মিছিলে নামা? আর কেন চেঁচিয়ে স্লোগান দেওয়া? আর কেন খেতে-খামারে বা কারখানায় গিয়ে সংগঠন? তার চেয়ে এখন থেকে শেখা যাক, কি করে ভাল চাকরি বাগানো যেতে পারে; দেখা যাক, কোন চালাকি মারফৎ অল্প সময়ে বেশি করে টাকা করা যায়।
    এই-সব ‘ভদ্রলোক’ গোছের বুদ্ধিজীবিরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে শুধু বাগরাই দিতে পারে; এর বাইরে তাদের আর কোনো অবদান নেই। উনবিংশ শতকে, চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সময়, জমিদাররা হাতি পুষতো, পাখি পুষতো, ওস্তাদ পুষতো। আর এখন শিল্পপতিরা বামপন্থী পুষে তাদের আমোদ আর আনন্দের খোরাক মেটাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *