Editorial
6th December, 2017
আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের পাশবিক ধ্বংসলীলায় ভেঙ্গে পড়ে দেশের স্থাপত্যের এক অনন্য ঐতিহ্য – বাবরি মসজিদ। জনপুর সুলতানি ঘরানায় তৈরি এই অসামান্য ‘আর্কিটেকচার’টি শুধু সুউচ্চ শিল্পকলার পরিচায়কই নয়, পরিবেশ-বান্ধব নির্মাণ ও অতি উন্নত অ্যাকুয়াস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এরও অনুকরণযোগ্য নিদর্শনও বটে; একদিকে কার্যত প্রাকৃতিক বাতানুকূল ব্যবস্থা, ও অন্যদিকে, গ্রাহাম পিকফোর্ড–এর মতে, মিহরাবে একটা ফিসফিসানিও ২০০ ফুট দূরে স্পষ্ট শোনা যায়, এমন অডিও সিস্টেম। এহেন স্থাপত্যের ওপর আক্রমণ কেবল একটি সম্প্রদায়ের আবেগকে আঘাত করা মোটেই ছিল না, বরং দেশের সহজাত শিল্প-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মূলে আঘাত করাও ছিল তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
ঘটনার ঠিক এক বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের নরসিমা রাও-এর নেতৃত্বে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর হাত ধরে এদেশে প্রথম হালখাতা চালু করে পুঁজিবাদের নতুন যুগ নয়া-উদারবাদ। বিশ্বায়নের নামে আসলে সমস্ত দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নির্দিষ্ট ধরণের পণ্যের চালান করাই যার কাজ, যার একমাত্র লক্ষ্য হবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী গুটিকয়েক পুজিপতির মুনাফা বৃদ্ধি, আর যার দিকনির্দেশ করবে একমাত্র আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজি। মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণীর জন্য বিলাস-বাহুল্য আর সিংহভাগ মানুষের জন্য ‘কৃচ্ছসাধন’ — এই হল তার সারকথা। ফলে একদিকে হিন্দু ধর্মের পুরাতন ‘কৃচ্ছসাধন’-এর বানী, আর অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতির ওপর বাঁদুরে তাণ্ডব-এর যোগ্যতাসম্পন্ন টু-ইন-ওয়ান জায়গা করে নিল দেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় গহ্বরে। ’৯২-এর ৬ই ডিসেম্বর বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দুত্বের ঝাণ্ডা নিয়ে ধ্বংস করা হল বাবরি মসজিদ। হিন্দুত্ববাদীদের এই অ্যাজেন্ডা তো দুই শতকের, তবে হটাৎ কেন এই সময়েই ! আসলে এরই মধ্যে দিয়ে নয়া-উদারবাদের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হল দেশ জুড়ে। আদবানির রথযাত্রা আসলে নয়া-উদারবাদেরই জয়যাত্রার প্রতীক। সহজেই সরকারেও চলে এলো তারা।
বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন লিবারহান কমিশন বাবরি-কাণ্ডে অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদবানি, তৎকালীন ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং-এর সমালোচনা করার সাথে আইবি-র জয়েন্ট ডিরেক্টর মলয় কৃষ্ণ ধর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চবন-কেও দায়ী করেন। আজ বলা যেতেই পারে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ছিল এদেশে নয়া-উদারবাদের উদ্বোধনী ধামাকা।
আজ ২৫ বছর পর একদিকে যখন সুপ্রিম কোর্ট এল কে আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতীদের ওপর বাবরি কাণ্ডে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ পুনর্বহাল করছেন, তখন অন্যদিকে মোহন ভাগবত, সুরেন্দ্র জৈনরা খোলামেলা হুঁশিয়ারি দিচ্ছে আগামী বছরই অযোধ্যায় রাম-মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে। আইন-আদালত বলেই আর কিছুতে বিশ্বাস রাখা যায় কি?
বুর্জোয়া বিচার-ব্যবস্থার এই দৈন্য আসলে নয়া-উদারবাদের আজকের দৈন্যেরই প্রকাশ। দুনিয়া জুড়ে যে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে ডুবে গেছে সে, তাতে বুর্জোয়া নিয়ম-কানুনগুলোও মেনে দেশ চালাবার ক্ষমতা তার আর থাকছে না। ফ্যাসিবাদী কায়দায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে শূলে চড়িয়ে আসলে দেশের সকল সাধারণ মানুষের মগজে আঘাত হানছে সে, আর তাতে শারীরিক-মানসিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কোনও নিপীড়নই বাদ যাচ্ছে না। সিকি শতকেই নয়া-উদারবাদ যে গভীর সংকটে নিমজ্জিত, বাবরি-ইস্যুও তার পিছু পিছু মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে “মন্দির ওয়হি বানায়েঙ্গে” কলরবে। এ কলরবের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আবার হোক, কলরব নয়, এক সম্মিলিত প্রতিরোধ।