গোটা বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের আস্ফালনের সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হল লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার চরম রাজনৈতিক চড়াই উৎরাই এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় ভাঙন। ১৯৯৯ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার সরকারে রয়েছে খেটে খাও-বাদীদের পার্টি পি.এস.ইউ.ভি (ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ ভেনেজুয়েলা) যার উত্থান ঘটেছিল জন নেতা হুগো শাভেজের হাত ধরে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৯ – এই ২০ বছরে পি.এস.ইউ.ভি পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার একাধিক জনমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে দেশের অনেকগুলি প্রাইভেট অয়েল কোম্পানির নিজেদের মুনাফার পাহাড় অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পেয়ে আসা অতিরিক্ত কর ছাড়ের মত সুবিধাগুলির অবসান ঘটিয়ে তাদের উপর প্রাথমিক স্তরে আয় কর, রাষ্ট্রের আদেও রয়্যালটির হার এবং ব্যারেল প্রতি ক্রুড অয়েলের বিনিময়ে ‘এক্সট্র্যাকশান’ কর বাড়িয়ে দেয়। ২০০৭ সালে একটি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশে অবস্থিত সমস্ত আন্তর্জাতিক তেল সংস্থাগুলিকে ‘মিক্সড কোম্পানি’ হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলির মালিকানার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করে। শেভরন, টোটাল, বিপি, স্ট্যাটঅয়েল-এর মত সংস্থাগুলি সরকারি নীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও কনোকো ফিলিপ্স এবং এক্সনমবিল এখনও আইনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে [১]। হুগো শাভেজের সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ‘খেটে খাও-বাদী’ সরকারের উপর বিভিন্ন কূটনৈতিক আক্রমণ করে আসছে। ২০০২ সালে তাঁকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হলেও দেশের সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের জেরে তা বিফল হয়। ২০১৩ সালে হুগো শাভেজের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলেও এই নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত এবং জল্পনা রয়েছে। উপরন্তু কিউবার বর্ষীয়ান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ফিদেল কার্স্ত্রো শাভেজের মৃত্যুর পিছনে সি.আই.এ-এর হাত আছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হন নিকোলাস মাদুরো। শাভেজের মতই মাদুরো সরকারও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করে। ঠিক এই সময়ে,বিশ্ব তেলের বাজারে ভেনেজুয়েলা, রাশিয়া, ইরান, সিরিয়ার মত দেশগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে “High oil production, low cost” (বেশি তৈল নিষ্কাশন, কম দাম)-নীতি প্রণয়ন করার উপদেশ দেয়। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলেরদাম কমে যায় এবং রাশিয়া,ইরান,ভেনেজুয়েলার মতো তৈল নিষ্কাশনকারী দেশগুলি ক্রমশ প্রতিযোগিতামূলকভাবে সংকটের মুখে পড়ে [২, ৩]। সেই থেকে ভেনেজুয়েলা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে… ২০১৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভেনেজুয়েলা থেকে প্রায় ৪১% ক্রুড অয়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ২৫% চীনে এবং ২২% ভারতবর্ষে রপ্তানি হয় কিন্তু বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার জেরে অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে [৪]।দেশের জি.ডি.পি ৬% কমে যাওয়ার সাথে সাথে দেশের তেল নিষ্কাশনকারী সংস্থাগুলোও ক্ষতির মুখে! ফলে অর্থনৈতিক সংকটের সাথে সমান্তরালে চলছে খাদ্যাভাব আর রোগের প্রাদুর্ভাব। একটা রিপোর্টে দেখা গেছে, দেশে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১৩০০০০০% এবং ২০১৮ সালে প্রতি ১৯ দিনে মূল্যবৃদ্ধির গতি গড়ে  প্রায় দ্বিগুণ ছিল [৪]। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০১৮ সালে দেশের প্রায় ৬৪.৩% মানুষের খাদ্যাভাবে গড়ে ৪কেজি ওজন হ্রাস পেয়েছে [৪]। বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে হামও ডিপথিরিয়ার মতোরোগের মহামারি এবং একই সাথে পর্যাপ্ত পরিমান ওষুধের অভাব [৪]। কেবল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রাইমা কুইনা নামক একটি ম্যালেরিয়া নিরামক ওষুধকেও অমানবিকভাবে দেশে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র [৫]!

ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে ২০১৫ সালে দেশের জাতীয় সংসদে বিরোধীরা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর থেকেই তারা প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনী কোর্ট বিরোধীদের ৩জন এবং শাভেজপন্থীদের ১জন নির্বাচিত প্রার্থীকে অসাংবিধানিক কার্যকলাপের জন্য সাংসদ পদ থেকে হঠিয়ে দিলে বিরোধীরা একপ্রকার গায়ের জোড়ে দেশের সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের অভিযুক্ত ৩জন প্রার্থীকে সাংসদ পদে বহাল রেখে মাদুরোকে পদচ্যুত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। ২০১৬ সালে মাদুরোর সাথে তারা গোল টেবিল বৈঠকে দরাদরি করতে বসলেও নিজেদের দাবীগুলিকে জিতিয়ে আনতে না পেরে হিংসার আশ্রয় নিতে শুরু করে। দেশের আধা-সামরিক বাহিনীকে প্রভাবান্বিত করে ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া হিংসার ঘটনায় ১২৫জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই অরাজকতার পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে মাদুরো জাতীয় সাংবিধানিক সংসদ তৈরির প্রস্তাব দেন। বিরোধীরা ২০১৫ সালে এই একই প্রস্তাব দিলেও মাদুরো নিজে যখন তা বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হন তখন তারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা শুরু করে। ২০১৮ সালে এই সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচনে বিরোধীদের একটা বড় অংশ অংশগ্রহণ না করলেও ৪২% ভোটার টার্ন আউটের মাধ্যমে শাভেজপন্থীরা নির্বাচিত হয়ে নতুন সংবিধান তৈরির কাজ শুরু করে যা পপুলার রেফারেন্ডামের মাধ্যমেই গৃহীত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাতীয় সাংবিধানিক সংসদ নতুন সংবিধান তৈরি করা ছাড়াও পাবলিক সার্ভিস সংস্থাগুলির পরিচালন পদ্ধতি আরও জনমুখী করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে অনেক মাদুরো বিরোধী পার্টি গুয়েইডো ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অবস্থান থেকে সরে এসে আঞ্চলিক নির্বাচনগুলিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে [৬]।

মাদুরোর উপর ২০১৮সালে বলিভিয়ান ন্যাশনাল গার্ডসের অনুষ্ঠান চলাকালীন সেন্ট্রো সিমন বলিভার টাওয়ারস এবং প্যালাসিয়া দি জাস্টিসিয়া দি ক্যারাকাস-এ পরপর দুখানা ড্রোণ আক্রমণ হয়।এই ঘটনায় মাদুরোর অল্পের জন্য প্রাণ রক্ষা হলেও দেহরক্ষী সহ প্রায় ৯জন আহত হন।মাদুরোর মৃত্যু হলে বিরোধী নেতা জুয়ান গুয়াইডোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ যে আরো প্রশস্ত হত তা বলাই বাহুল্য।

অন্যদিকে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার তাঁবেদার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মদতে ভেনেজুয়েলায় মাদুরোর বিরোধী এবং বিকল্প হিসাবে জাতীয় সংসদ কর্তৃক জুয়ান গুয়াইডোকে প্রেসিডেণ্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে।তাই দেশজুড়ে এখন প্রধানতম প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে একই দেশে প্রেসিডেণ্টের পদে দুজন কিভাবে থাকতে পারে? এই প্রশ্নে গোটা বিশ্ব কার্যত তিনটি শিবিরে বিভক্ত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কানাডা সহ প্রায় ৫০টি দেশ মাদুরো সরকারের বিরোধিতা করলেও এই পরিস্থিতিতে অবশ্য রাশিয়া, চীন, কিউবাকে জোরালোভাবেই পাশে পেয়েছেন মাদুরো এবং সমগ্র ঘটনার কার্যকারণ হিসাবে পুঁজিবাদী স্বার্থকে নিশানা করেই তোপ দেগেছেন তিনি–“Imperialists like US and Europe are waging ‘economic war’ against Venezuela for oil” অর্থাৎ ইউ. এস এবং ইউরোপের মত সাম্রাজ্যবাদীরা তেলের জন্য ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’-এ অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে মাদুরোর সরকার এক্ষেত্রে পাশে পায়নি ইউরোপীয়ান দেশগুলিকেও। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালীর মতো দেশগুলিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সাথে পা মিলিয়ে জুয়ান গুয়াইডোকেই প্রেসিডেন্ট হিসাবে সমর্থন করছে। বন্ধু দেশ রাশিয়া অবশ্য গুয়াইডোর উত্থানকে একটি রক্তক্ষয়ী রাস্তা হিসাবেই দেখছে-“A direct path to blood shed”। তৃতীয় শিবিরে রয়েছে ভারতের মত দেশগুলি যারা এই বিষয়ে সরাসরি মাদুরোর বিরোধিতার পথে হাঁটেনি।ভারতের বর্তমান উগ্র ডানপন্থী সরকারের এহেনও অবস্থানের কারণ আমাদের দেশ সামগ্রিক চাহিদার প্রায় ১০% তেল কম দামে আমদানি করতে পারে ভেনেজুয়েলা থেকে [৭]।

ভেনেজুয়েলা বর্তমানে কার্যত একটি পরিকল্পিত যুদ্ধক্ষেত্র এবং হিংসা ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আমেরিকার মদতপুষ্ট বিভিন্ন মিডিয়াগুলি মাদুরো বিরোধী প্রচার করে চলেছে, ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিভিন্ন আঞ্চলিক সামাজিক সংগঠনগুলিকে দখল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ড্রাগ এবং মদের ব্যবসা বাড়ছে মারাত্মক হারে, যার ফলস্বরূপ চরম অরাজকতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে-অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক, উভয় দিক দিয়েই। এরই মধ্যে,দক্ষিণপন্থী বিরোধীদের জোট এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সবচেয়ে নির্লজ্জ আক্রমণের উদাহরণ হল ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড়ো বৈদ্যুতিক বিপর্যয়। গত৭ থেকে ১০ই মার্চ অর্থাৎ প্রায় চারদিন ধরে দেশটি বিদ্যুৎহীন হয়ে থাকে। মাদুরোর প্রতি ভেনেজুয়েলাবাসীর ভরসা টলিয়ে দিতে এবং দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তৈরি করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই এই চক্রান্তের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ৭ই মার্চ দেশের বলিভার রাজ্যে অবস্থিত ‘গুরি’ হাইড্রো ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের উপর শিকাগো ও হিউস্টন থেকে সাইবার আক্রমণ, ইলেক্ট্রো ম্যাগ্নেটিক পালস যন্ত্র এবং চারটি সাব স্টেশানকে অচল করে দেওয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। চারদিনের এই বিদ্যুতহীনতার ফলে দেশের যানবাহন, খাদ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বিরোধী নেতা গুয়েইডো সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তার বক্তৃতায় বলে যে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে তবেই এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। ১১ই মার্চ, মাদুরো সরকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন করতে সফল হলে বিরোধীদের গণউন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় [৮]।

এই চরম দুর্যোগের মধ্যে দিয়েই দিন কাটাচ্ছে ভেনেজুয়েলাবাসী। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে এটা মাদুরো সরকারের ব্যর্থতা। আসলে আক্রমণ আসছে বিভিন্ন দিক থেকে… ২০১৫ সালে মাইয়ামি-র “ডলার টুডে”নামক কোম্পানী কৃত্রিম ভাবে ভেনেজুয়েলার টাকা (বলিভার)-এর দাম কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের ৬০% বিনষ্ট হয়! ফরাসি কোম্পানি ‘কোফেস’ ভেনেজুয়েলায় আন্তর্জাতিক আর্থিক অনুদান ও বাণিজ্যিক লেনদেন স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালাতে শুরু করে। তাদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে যে তথ্য ব্যবহার করা হয় তা সেই মার্কিন সংস্থা (মুডিজ্‌, ফিচ রেটিং এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস্‌)-গুলির থেকে নেওয়া যারা ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার জন্য দায়ী! ২০১৬-১৭ সাল থেকেবিভিন্ন বিদেশি প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলিতে (জার্মানির কমার্জ ব্যাঙ্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাঙ্ক, ওয়েলস ফারগো, ইস্ট অ্যান্ড সিটি, গোল্ডম্যান স্যাক্স ও জে. পি মর্গান, সুইস ব্যাঙ্ক) গচ্ছিত ভেনেজুয়েলার সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হতে থাকে [৫]। ২০১৬ সালে আই.এম.এফ তার রিপোর্টে ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশের আড়ালে ওই দেশের দুই বৃহৎ ব্যবসায়ী সমিতি ‘ফেডেকামারা’ ও ‘কন্সেকমারসিও’-র মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক ছায়াযুদ্ধকে স্বীকৃতি দেয়। মাদুরো সরকার এই সংকটের মুহূর্তে দেশের খেটে খাওয়া জনগণকে স্বস্তি দিতে দেশের ন্যুনতম মজুরী বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে এই প্রাইভেট সংস্থাগুলি বাধা দিতে শুরু করে। তারা তাদের পাশে পায় গুয়েইডো সমেত সমস্ত মহান বিরোধী নেতৃত্বকে যারা সাধারণ জনগণের দুঃখ দুর্দশা দূর করার বক্তৃতা দিয়ে আসছে এতদিন ধরে [৯]। ২০১৮ সালে সুপার মার্কেটগুলো থেকে মুরগি, ডিম, বিফ সমেত ২৫টি নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার উধাও করার চক্রান্তের অপরাধে কন্সেকমারসিও সমেত বেশ কিছু সংস্থারমোট ১৩১জনকে আটক করে সরকার [১০]। ২০১৭ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে পি.ভি.এফ এনার্জি-র মত দেশের সর্ববৃহৎ অয়েল রিফাইনারির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সিটি ব্যাঙ্কের অসহযোগিতার ফলে ৩০০,০০০ ডোজের ইন্সুলিন দেশে ঢুকতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইউরোক্লিয়ার নামক কোম্পানি দেশের ১৬৫০কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে। ৭০ কোটি ডলারের ধার সরকারের পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেওয়া হলেও আই.এস.ডি.এ নামক একটি মার্কিন সংস্থা ঋণ-খেলাপির অভিযোগ আনে মাদুরোদের বিরুদ্ধে! এই অর্থ সংকটের মাঝেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার জাতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি করপোলেক-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে ২৭ কোটি ডলার সুদ না কমানোর জন্য! ২০১৮ সালে  মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে দেশের বক্সাররা মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত ক্যারিবিয়ান গেমস্‌-এ অংশগ্রহণ করতে পারে না। কলোম্বিয়ার তৎকালীন মার্কিনীদের পুতুল প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল স্যান্টোস-এর চক্রান্তের ফলে ৪০০,০০০ কিলো খাবার বাজেয়াপ্ত করে ভেনেজুয়েলার ৬ লক্ষ কোটি মানুষকে সপ্তাহখানেক ধরে তীব্র খাদ্য সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। দুই আমেরিকার পুঁজিবাদী দেশগুলির সমন্বয় ‘লিমা গ্রুপ অফ কান্ট্রিস’ জুয়ান গুয়েইডোকে সমর্থন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর আদেশ অনুসারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করে দেশের ১২ লক্ষ কোটি ডলার আমদানি রোধ করে দেয় [৫]।

এই ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক চাপের মাঝেও মাদুরো দেশের সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার বাস্তব চাহিদাগুলি মেটাতে সফল হওয়ায় ২০১৮ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। মার্কিনীদের সাহায্যে তাকে পদচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ২০১৯-এর জানুয়ারিতে গুয়েইডো নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করে অরাজকতার সৃষ্টি করে। গত ৩০শে এপ্রিল তিনি মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে দেশজুড়ে গৃহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবার ডাক দেন সেনাবাহিনীকে। এই পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান সেনা বাহিনীর অংশগ্রহণের অভাবে ভেস্তে যায়। মাদুরোর পক্ষে সওয়াল করে সাধারণ জনতার বিশাল মিছিল জাতীয় পতাকা হাতে ঐক্য ও শান্তির স্লোগান দিতে দিতে দেশের রাজধানী কারাকাসের রাজপথ মুখরিত করে তোলে [৭]। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে বিরোধী নেতৃত্ব বর্তমানে ছত্রভঙ্গ। বিরোধী নেতা ম্যারিয়ানেলা ম্যাগান্সেন্স ইতালির এবং লিওপোল্ড লোপেজ স্পেনের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছে। বিরোধীদের প্রধান গুয়েইডো গা ঢাকা দিলেও তার সহচর এডগার জামব্রানো বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে।

সব মিলিয়ে বিশ্ব বাজারে মার্কিনীরা যেভাবে তেলের উপর একচেটিয়া মালিকানা বজায় রাখার জন্য এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে মুনাফার রাস্তাটাকে চওড়া করে নিতে চাইছে, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলা বর্তমানে তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ।প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে মানুষ কি শুধুই কিছু সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে?

কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘গ্রানমা’ পত্রিকায় বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই ভাবেঃ “Against all imperialist logic, Venezuela resists. Washington has encountered an obstacle that cannot be overcome with supercomputers, superagents, or chaos professionals: the people’s refusal to be subjugated, the determination to resist” (সমস্ত সামারাজ্যবাদী যুক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ভেনেজুয়েলা প্রতিরোধ করছে। ওয়াশিংটন এমন এক বাধার সম্মুখীন হয়েছে যা সুপার কম্পিউটার, সুপার এজেন্ট এবং পেশাদার অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়ঃ সাধারণ মানুষের নিজেদের অবদমিত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান এবং প্রতিরোধ করার প্রতি তাদের দৃঢ় সংকল্প) [১১]।

 তথ্যসূত্রঃ 

১. https://www.ogj.com/articles/print/volume-115/issue-8/general-interest/case-study-the-nationalization-of-the-venezuelan-oil-industry.html

২. https://www.investopedia.com/ask/answers/030315/why-did-oil-prices-drop-so-much-2014.asp

৩. https://oilprice.com/Energy/Oil-Prices/Did-The-Saudis-And-The-US-Collude-In-Dropping-Oil-Prices.html?fbclid=IwAR08RG6D03ld86MSFCj2-1fyvqc1SMKcoyphEpdplKuoVOCJwBhgwvdOelU

৪. https://www.bbc.com/news/world-latin-america-46999668?fbclid=IwAR0KRXsNA06xnccfgKou1mdiuM4XtOakTj3CCmj5qE7jWIhNmLw80N8gu2Y

৫. http://misionverdad.com/MV-IN-ENGLISH/financial-blockade-chronology-of-a-strategy-to-destroy-venezuela?fbclid=IwAR3enVcLHss40FL9HirBra-Fc_EHsRuFRCOhMTahiO7eAVGjyxej4mH_ylo

৬. http://misionverdad.com/mv-in-english/why-does-venezuela-have-a-national-constituent-assembly?fbclid=IwAR0z2-HN4my5Mcyi-T23Ioz-0VP-mMZJrjvD23E8-UIvQU0ge-Y9xtc2wSs

৭. https://www.bbc.com/news/world-latin-america-48121148?fbclid=IwAR3w4gI5-IJbmaiII7JA2vNxwHn_3K1IAQ1C4cbTnZH4rCkez_SJGNWt30E

৮. http://misionverdad.com/entrevistas%20/reconstructing-the-history-of-the-electricity-sabotage-in-venezuela-special-report?fbclid=IwAR2cW2mpNc41_OHaKcGw0o_uNlvsOWbKccDZFwNKz_JgFS6nsqdzmx1GEPU

৯. https://www.telesurtv.net/opinion/Is-Venezuela-Right-to-Raise-the-Minimum-Wage-20180331-0013.html

১০. https://www.business-standard.com/article/pti-stories/venezuela-arrests-131-accused-of-economic-sabotage-118083100097_1.html?fbclid=IwAR1JzTJZ58qUSmwU80V4OCJzAhM4uRHXQlfr6jAoJhOW3gnPN0cXVFjGpLg

১১. http://en.granma.cu/mundo/2019-04-09/venezuela-confronts-fabricated-chaos?fbclid=IwAR2zhruH6-zaeBcGz5yHL6tQ-DyxxVwrYkzcqvUdUnC8eBVUAR2eL3ntPVo

চিত্র সূত্রঃ

১. http://www.21stcenturywatch.com/2018/10/09/socialist-venezuela-falling-apart-as-president-maduro-shockingly-blames-party/

২. https://volksnieuwsuitamsterdamnoir.com/2019/02/23/the-supported-from-the-cia-puppet-guaido-who-hate-maduro-just-like-trump-d66-sophie-in-t-veld-need-humanitarian-aid-the-least/

৩. https://www.apnews.com/07e2f8abb3a64506a91d11dfd69e86cc

৪. https://www.wionews.com/world/maduro-says-us-wants-to-fabricate-venezuela-crisis-to-start-war-199739

৫. https://www.dhakatribune.com/tribune-supplements/world-tribune/2017/05/07/venezuela-crisis-going

দীপ সরকার পিপ্‌ল্‌’স্‌ ব্রিগেডের যুব ইউনিটের সদস্য। 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *