আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র সমীকরণ ঘেঁটে দিয়ে চলতি বছরের ১৬ই জুলাই তুরস্কের মাটিতে পা রাখল রাশিয়ার এস-৪০০ মিশাইল ডিফেন্স সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ। যুদ্ধাস্ত্র কেনা-বেচার পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণ লুকিয়ে থাকে, তা রাফায়েল ডিলের দৌলতে আমাদের কাছে অজানা নয়। আজকের দিনে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যেন অস্ত্র কেনাটাই বন্ধুত্বের নিশান। আর সেইকারনেই তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার এই ডিল নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে ঢি ঢি পড়ে গেছে।
রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্ক এতটাই মধুর ছিল যে ২০১৫ সালের নভেম্বরে সিরিয়ার সীমান্তে রাশিয়ান যুদ্ধ বিমানকে গুলি করে নামায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোস্ত, ন্যাটো সদস্য তুরস্কের এফ-১৬। আর এই ঘটনার চার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সতর্কবাণী উপেক্ষা করেই তুরস্কে থাকা মার্কিন বিমান ঘাঁটি, ইন্সারলিক পাহারা দেবে রাশিয়ার এই অত্যাধুনিক ডিফেন্স সিস্টেম। আর এতেই শিবির বদলের আভাস দেখছে ওয়াকিবহাল মহল। মার্কিনদের কাছ থেকে এফ-৩৫ মিসাইল কেনার বরাতও দিয়েছিল তুরস্ক কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে এই ডিলের পর সেই বরাত খারিজ করা হয়েছে বলে হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। রাশিয়া তাদের অত্যাধুনিক এফ-৩৫ সম্পর্কে অনেক তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে বলে তাই এই দুই যুদ্ধাস্ত্র এক সঙ্গে থাকতে পারে না বলে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র স্টেফনি গ্রিসাম জানিয়েছেন। তাঁদের তরফ থেকে একাধিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের অফার দেওয়া হলেও, তুরস্ক তা প্রত্যাখ্যান করে। ‘রাশিয়ান অস্ত্র অগ্রাহ্য করা’র ন্যাটো শপথের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করার “জোটের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে” বলে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। তুরস্কের বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যকে “অন্যায্য” আখ্যা দিয়ে বলা হয় “এই ধরণের একতরফা কথা জোটের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায় না আর এর পিছনে কোন যথোপযুক্ত কারণও নেই।”

মধ্য প্রাচ্যকে কেন্দ্র করে মার্কিন-সোভিয়েত দ্বৈরথ নতুন ঘটনা নয়। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র থাকার সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সংগ্রাম চললেও, তার পতনের পরে মূলতঃ বাজার ও তেলের দখলকে কেন্দ্র করেই দ্বন্দ্ব জারি থাকে। আর সেখানে তুরস্কের মত রাজনৈতিক-ভৌগলিক অবস্থানের দেশের গুরুত্ব কতটা তা সন্দেহাতীত। দক্ষিণ ইউরোপ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য তুরস্কই গুরুত্বপূর্ণ স্থান, অর্থাৎ তিনটি মহাদেশে প্রবেশদ্বার। একই সঙ্গে তেল, বাজার ও সস্তার শ্রমিকের আলিবাবার গুহার দরজা। সোভিয়েত পরবর্তী যুগে তুরস্ক আরও বেশি করে মার্কিনপন্থী হিসেবেই পরিচিত। এহেন গভীর বন্ধুত্বে চিড় কেন ধরল, বিশেষতঃ তখন যখন তুরস্কের নিজস্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে?
রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা তুরস্ক-মার্কিন সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত ২০০৩ সাল থেকেই। ইরাকে আক্রমণ চালানোর জন্য তুরস্ককে লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ওয়াশিংটন, যাতে সরাসরি ‘না’ করে করে দেয় জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি শাসিত তুরস্ক। অপরদিকে সিরিয়া সঙ্কটের সময় ইউ.এস-কে বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করলে, ওবামা সরকার তা নাকচ করে দেয়। তুরস্ক তখন সিরিয়া সঙ্কটের সূচনা মুহূর্তে উন্মুক্ত সীমানা নীতি গ্রহণ করে বিপ্লবী ও জিহাদি উভয়পক্ষকে সিরিয়ায় যাতায়াতের সুবিধা করে দেয়। পরবর্তীতে সীমানা বন্ধের সিধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমে আই.এস (ইসলামিক স্টেট)-এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও, যুদ্ধের আঁচে ক্রমশ কোণঠাসা হতে শুরু করলে তুরস্ককেই এর জন্য একমাত্র দায়ী করতে শুরু করা হয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলস্বরূপ ২০১৬ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টাও হয়েছিল।

তুরস্কের দ্বিতীয় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে আছে কুর্দিশ বিপ্লবী গোষ্ঠীর বাড়-বাড়ন্ত, যারা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির মতাবলম্বী ও সামরিক মদতপুষ্ট। এরা যেমন একাধারে আই.এস ও আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে, তেমনি তুরস্কের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধেও কয়েক দশক ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই বিপ্লবী গোষ্ঠী সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে তুরস্কের কিছুটা দখল করে রেখেছে। ইউ.এস আবার এই কুর্দিদের প্রত্যক্ষ মদত দেয় আই.এস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। প্রায় ২০০০ মার্কিন বাহিনী বর্তমানে সিরিয়ান কুর্দিস্তানে অবস্থিত।
এছাড়াও, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইপ এরদগানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত ইউ.এস-এর বাসিন্দা তুর্কি পাদ্রি ফেতুল্লাহ গুলেনকে এবং তার সহযোগী এক সি.আই.এ অফিসারকে (তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে) তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বললেও ইউ.এস রাজি হয়নি। এই ঘটনাবলীর প্রভাবে তুর্কি-মার্কিন সম্পর্কে অবনতি ত্বরান্বিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।
অপরদিকে প্রেসিডেন্ট পুতিনও তুরস্ককে কাছে পাওয়ার জন্য বেশ কিছু আপোষ করেছেন। তুরস্ক যখন সিরিয়ার কুর্দিশ শহর আফ্রিন আক্রমণ করে, রাশিয়া নীরব ছিল, দামাকাসের প্রতিবাদের পরও। উপরন্তু ইরানের সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি এবং সিরিয়ান সরকারের উপর রাশ টানার জন্য আলোচনা চালানো হয়, যদিও এক সময় ইরান ও রাশিয়া সিরিয়া সরকারেরই পক্ষ নিয়েছিল। এগুলি তুরস্ককে রাশিয়ার পক্ষে থাকার জন্য প্ররোচিত করেছে। তুরস্কের সঙ্গে মিত্রতার ফলে কৃষ্ণ সাগর (রাশিয়ান নৌ ঘাঁটি) থেকে ভূমধ্যসাগর অবধি পথ সুগম হবে, যাতে এশিয়াতে প্রভাব বিস্তার করা যায়, সেই অঙ্ক সহজেই কষে ফেলেছেন পুতিন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাতে প্রভাব বিস্তারের লিপ্সা নিয়ে তুরস্ক সিরিয়া দখলের চেষ্টা করেছে। আরব বসন্তকে ‘বিদেশী নীতি’ (!) হিসেবে ঘোষণা করে আসাদ সরকারকে ফেলার চেষ্টা করেছিল তুরস্ক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের মত ইসলামিক সংগঠনের সরকার গঠন করাতে চেয়েছিল যাদের মতাদর্শ বর্তমানে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কাছাকাছি। কিন্তু সেই সময় রাশিয়া ও ইরান সিরিয়া সরকারের পক্ষে থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ঐ উদ্দেশ্য বিপ্লবী ও জেহাদিদের অবাধ প্রবেশকে মদত দেওয়ার কাজ করেছিল। কিন্তু প্রথমে জেহাদি ও পরে কুর্দিশ বিপ্লবীদের শক্তি বৃদ্ধি বুমের্যাং হয়ে যায়। সেই সঙ্গেই বাস্তবতা বিচার করে সিরিয়া দখলের পররাষ্ট্র নীতি থেকে সরে এসে নিজেদের সীমান্তে কুর্দিশ বিপ্লবীদের আটকানো তাদের কাছে এখন মূল উদ্দেশ্য। এতে সিরিয়া সরকারেরও মদত পাওয়া যাবে, কারণ বিপ্লবীদের বাড়বাড়ন্তে তাদের মাথাতেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অন্যদিকে কুর্দিশ বিপ্লবীদের সরাসরি সাহায্য করে ইউ.এস। তাই শিবির বদল অনিবার্য।

বাজারের আকাশে মন্দার মেঘ যত ঘনীভূত হবে, যুদ্ধের ঝলকানি ক্রমশ সচরাচর হবে আর সেই সঙ্গে চলবে শিবিরে বিভক্তিকরণ। আমরা যদি ভালভাবে লক্ষ্য করি, দেখতে পাবো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক, বা রাশিয়া উভয় ডিলের ক্ষেত্রেই আদতে প্রত্যেক দেশের একটাই উদ্দেশ্য, যুদ্ধের রুট ম্যাপ তৈরি করে রাখা।



