একদিকে যখন ফ্রান্সের শ্রমিকরা মাক্রুঁর পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে, তখনই ফরাসি সেনার উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মালির সাধারণ মানুষ বামাকো শহরের রাস্তায় ফরাসি পতাকা পোড়াচ্ছে। ইসলামী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ২০১৩ সালে ফ্রান্স প্রথম হস্তক্ষেপের পর থেকে এই দেশটি মানবতার সংকটে পড়েছে।
২০১৩ সাল থেকে মালি দখলে রাখা ফরাসি সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে ১৩ই জানুয়ারী বামাকোয় এক হাজারেরও বেশি লোক বিক্ষোভ করায় মালির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব আবারও ফুটে উঠেছে। বিক্ষোভকারীরা ফরাসী পতাকা পোড়ানো ও “ফ্রান্স আউট”- স্লোগানের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ফরাসী সরকার “সন্ত্রাসবাদী” নেটওয়ার্কগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিল যা মালিকে কুক্ষিগত করারই হুমকি। তবে এই প্রতিবাদগুলি এই দেশে ফরাসি ঔপনিবেশিক এবং সাম্প্রতিক হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতি, বলা যেতে পারে।
আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে হামলার প্রেক্ষিতে ১৩ই জানুয়ারী ফরাসী সরকার ঘোষণা করে যে তারা সেখানে নিযুক্ত ৪৫০০ ফরাসী সৈন্যদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পশ্চিম আফ্রিকাতে আরও ২৫০ জন সৈনিক পাঠাবে। মালিতে ফ্রান্সের সেনার উপস্থিতি সারা পৃথিবীর যে কোনও অংশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সৈন্যের বৃহত্তম উপস্থিতির পরিচায়ক।
মালি, নাইজার, ছাড, বুর্কিনা ফ্যাসো এবং মরিতানিয়ার নেতারা ফরাসী কূটনীতিকদের সাথে দেখা করার পরে এই ঘোষণাটি প্রকাশিত হয়েছিল যে তারা ইউরোপীয় শক্তিগুলির সাথে একটি যৌথ সামরিক কাঠামো গঠন করবে। এর প্রধান কারণ, যৌথ চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি-র ১৩ই জানুয়ারির মন্তব্য যা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে নিজস্ব উপস্থিতি হ্রাস করার বিষয়ে বিবেচনা করছে।
ফ্রান্স বহু শতাধিক বছর ধরে পশ্চিম আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশের সাথে একটি আধা-ঔপনিবেশিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এই পাঁচটি দেশ আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ।
এই বিক্ষোভগুলি স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, বিশেষত ওই অঞ্চলে ফরাসী সামরিক উপস্থিতির নিন্দা তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অপারেশন বরখানে যা অপারেশন সার্ভালের উত্তরসূরি। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ অপারেশান সার্ভাল চালু করেছিলেন। এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাত দেখিয়ে ফরাসী সরকার সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ নিয়েছিল যার লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে স্থায়ী ফরাসি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা এবং পশ্চিম আফ্রিকাতে এর প্রভাব আরও দৃঢ় করা। এটাই অপারেশান বরখানের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেই সময়, মালির উত্তরাঞ্চলে তুয়ারেগ বিদ্রোহের ফলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, যা আজওয়াদ অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবির উন্মেষ ঘটায়। তুয়ারেগ একটি প্রাচীন উপজাতি যারা কমপক্ষে ১৯১৬ সাল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করছে। তৎকালীন সংকটের ফলস্বরূপ, মালির সেনাবাহিনী তখনকার রাষ্ট্রপতি আমাদৌ তৌমানী ট্যুরকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং মালিয় সংবিধানকে দুই মাসের জন্য স্থগিত করে। পরবর্তীকালে, জিহাদি দলগুলি এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করে। তুয়ারেগদের সামরিক গোষ্ঠীগুলির দুর্বল হওয়ার সুযোগ নিয়েছিল তারা। ফ্রান্স তার নিজ স্বার্থ রক্ষায় মালির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
ছাড, মালি, মরিতানিয়া, নাইজার, বুর্কিনা ফ্যাসো এবং আলজেরিয়ার একাংশ সোহেল অঞ্চল পারমাণবিক শিল্পের অর্থাৎ ইউরেনিয়াম নিষ্কাশনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। আজ, এই অঞ্চলটি মাদক এবং মানুষ পাচারের নেটওয়ার্ক ছাড়াও “সন্ত্রাসবাদী” গোষ্ঠী যেমন বোকো হারাম, ইসলামিক স্টেট, আল কায়দার এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
অন্যান্য আফ্রিকার অনেক দেশগুলির মতো মালিও দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাধিক আঞ্চলিক ও জাতিগত উত্তেজনার স্বীকার এবং তার সীমানা ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক বিভাগের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে বেশী মেনে চলে। মালির বর্তমান কনফিগারেশনের সীমান্তগুলি ১৯৬০ সালে মালির স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ফরাসী সুদানের অংশ ছিল এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী নিয়ে মোট আটটি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত।
ফ্রান্সের এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থেকে স্বাধীনতার পরেও এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। যেমন বড়ামা (যারা ১৯৬০ সাল থেকে বামাকো শাসন করেছে), টুয়ারেগস, ডগনস এবং ফুলানি। এদের মধ্যে ফরাসী দখলদার বাহিনী জার্মান সমর্থনে নিজেদের প্রবেশ ঘটিয়েছে।
মালিতে আজ লিবিযয়া-ন্যাটো যুদ্ধের পরবর্তীতে আগত ফরাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে কারণ ফ্রান্স জেহাদী সৈন্যের সহায়তায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। ফ্রান্স তার স্বার্থ রক্ষার জন্য গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের উভয় পক্ষের লড়াই অব্যাহত রেখেছে এবং মালিয়দের জিহাদি সৈন্যের হাত থেকে রক্ষা করার ভান করে ২০১৩ সালে তারা সেখানে আক্রমণ শুরু করেছিল। সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়ার যুদ্ধগুলি সোহেল অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি কেন্দ্রীভূত করে ধীরে ধীরে জিহাদিদেরকে বাস্তুচ্যুত করেছে। এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এবং বোকো হারামের মতো গোষ্ঠীর মধ্যে আটকা পড়েছে।
বামাকোতে ১৬ই জানুয়ারীর এই বিক্ষোভ ফ্রান্স এবং মালিয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বাউব্যাকার কেট্টার বিরুদ্ধে চালিত হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে আরও বেড়েছে একের পর এক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ। ফরাসী দখলদারির বিরুদ্ধে ৩রা জানুয়ারী আবারও মালির বানিয়াগাড়ার কাছে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।
মাঁক্রু এবং কেট্টা জোর দিয়ে বলেছিল যে এই বিক্ষোভগুলি আল কায়দা এবং ইসলামিক স্টেটের সাথে কাজ করা ক্ষুদ্র উস্কানিদাতাদের দ্বারা পরিচালিত এবং বেশিরভাগ লোক ফরাসিদের দখলদারিত্বের জন্য “কৃতজ্ঞতা অনুভূতি” বোধ করে। তবে, সাম্প্রতিক একটি সার্ভে অনুসারে, ৮০% মালিয় তাদের দেশে ফরাসী উপস্থিতি প্রত্যাখ্যান করছে।
সাম্রাজ্যবাদ “সন্ত্রাসবাদ”-এর সমস্যা সমাধান করতে পারে না এবং তা করাও এদের আগ্রহের বিষয় নয় । সাম্প্রতিক ইতিহাসে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ফ্রান্স থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি উগ্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে লড়াইকে অজুহাত হিসাবে সমর্থন করেছে। তারা উভয় সন্ত্রাসী সেনা এবং “অফিসিয়াল” সামরিক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াই না করে কৌশলগতভাবে অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছে।
১৩ই জানুয়ারির বিক্ষোভে এক প্রতিবাদকারী ফ্রান্স এবং মৌলবাদী সেনার মধ্যেকার জটিল সম্পর্ককে চিহ্নিত করেছেন এইভাবে: “বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনীর বিশাল উপস্থিতি সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অতএব আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, এই বিদেশী শক্তিগুলি এই অঞ্চলের বিশাল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করছে”।
মালিতে ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি ফরাসি পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এবং খনি সম্পর্কিত সংস্থাগুলির স্বার্থের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ফ্রান্স আফ্রিকা থেকে ইউরোপে অভিবাসন প্রবাহকে সহিংসভাবে আটকাতে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে সোহেল অঞ্চলের সরকারের সাথে সহযোগী সম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়েছে।
এমন এক সময়ে যখন ফ্রান্সে শ্রমিকরা সাধারণ ধর্মঘট পালন করছেন এবং আলজেরিয়ার হিরাক আন্দোলন সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, তখন আফ্রিকায় ফরাসী সামরিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যোগসূত্র স্থাপন করা প্রয়োজন যাতে বল প্রয়োগকারী এই সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই দেশগুলির শোষিত জনগণ।

রোহন চক্রবর্তী রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষ।



