গোড়ার কথাঃ সেদিনের ভারত ও দুই বোমার ধাক্কা …
দুটি বোমা ছোঁড়া হলো সেবার, পরপর।
প্রথমটি ১৯২৯ এর ২৩ শে ডিসেম্বর দিল্লীর কাছাকাছি ফেলা হলো ভাইসরয়ের বিশেষভাবে সাজানো ট্রেনে। আলাদা হয়ে গেলো দুটি বগি! যদিওবা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন লর্ড আরউইন। সাহেবের উপর এই হামলার কথা শুনে যারপরনাই কাতর হলেন যিনি, তিনি ‘মহাত্মা’ ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারেন! এর ঠিক দশ দিনের মাথায় ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ১৯৩০-এর ২রা জানুয়ারী গান্ধী লিখলেন একটি লেখা — ‘কাল্ট অব বম্ব’ বা ‘বোমার পূজা’ শিরোনামে! সে লেখায় বোমা ছোঁড়া ‘মহপাপীদের’ সন্ত্রাসবাদী, নাশকতাবাদী, এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন ও জনসমর্থনহীন বলে তীব্র অভিযোগ আনলেন গান্ধী৷ অভিযোগ আনলেন যে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব’লে কিছুই নেই, স্রেফ ‘মজার জন্য’ তারা এই ধরণের কাজ করছে [১]।
দ্বিতীয় বোমাটি আছড়ে পড়লো এরও হপ্তা তিনেক পর৷ জানুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ৷ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সেদিন প্রচারিত হলো ‘হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশনের ঘোষণাপত্র’, যাতে একটি লেখা বার করলেন বিপ্লবীরা ‘দ্য ফিলোজফি অব দ্য বম্ব’ বা ‘বোমার দর্শন’ শিরোনামে [২]। লেখক, ২৩ তারিখ আরউইনের ট্রেন ওড়ানোর প্রধান অভিযুক্ত ও ফেরার, এইচএসআরএ-র সভাপতি ভগবতীচরণ বোহরা৷ এ লেখার ‘ফাইনাল এডিটিং’-এর ভার নিয়েছিলেন ভগৎ সিং স্বয়ং৷ ‘কাল্ট অব বম্ব’-এর জবাবে ‘ফিলোজফি অব বম্ব’, যেমনটা প্রায় এক শতক আগে হয়েছিলো ইউরোপে। প্রুঁধোর ‘ফিলোজফি অব পভার্টি’-র জবাবে মার্ক্সের ‘পভার্টি অব ফিলোজফি’!
গান্ধীর করা তাঁদের বিরুদ্ধের সবকটি অভিযোগকে বিপ্লবীরা খারিজ করলেন যুক্তি দিয়ে। বোহরা-সিংরা সেই লেখায় সরাসরি স্পষ্ট করলেন যে দেড় শতক ধরে দেশের জনতার উপর সশস্ত্র নিপীড়ন চালানো ইংরেজ প্রভুরা কোনও ‘ভালোমানুষ’ নয়৷ উপরন্তু এতো বছর ধরে অনুনয়-বিনয়ের যে রাজনীতি কংগ্রেস ক’রে এসেছে তাতে কজন শাসকের হৃদয় তাঁরা জিততে পেরেছেন? তাঁরা ঘোষণা করেন যে, ‘সশস্ত্রতা’ তাঁদের উদ্দেশ্য নয়; বরং শাসকের বুকে ‘বিপ্লবী অভ্যুত্থানের আতঙ্ক’ সৃষ্টি করা ও তাকে পরাস্ত ক’রে দেশ থেকে তাড়ানোর উপায় মাত্র। বিপ্লবীদের সশস্ত্রতা কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উদ্দেশ্যহীন ব্যপার নয়৷ বরং এটি একটি নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত, যা এক শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক ভারতের জন্ম দিতে সক্ষম।
সেদিন গান্ধী যে আক্রমণ বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নামিয়েছিলেন, আজ একশ’ বছর পরও তার প্রভাব কিছুই কমেনি৷ সেদিন গান্ধী তাঁর দক্ষিণপন্থী লাইন দিয়ে, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সাথে আপোষরফা ও শান্তির নামে একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও মতাদর্শগতভাবে পঙ্গু ‘নেশন’ নির্মানের চেষ্টা করছিলেন। আজকের দিনে, সেই গান্ধীই ফিরে ফিরে আসছেন, যদিওবা স্রেফ দক্ষিণপন্থীদের দিক থেকেই নয়৷ এমনকি বামপন্থীদের ভিতর থেকেই। কমিউনিষ্টদের কাজ যে বিদ্যমান ব্যবস্থার সবল উচ্ছেদ ঘটানো, সে কথা পাড়লেই আজ সবচাইতে বেশী আক্রমণ ধেয়ে আসে ‘কমিউনিষ্ট-নাম্নী’ পার্টিগুলোর থেকেই!
মেহনতীর জঙ্গি অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আজ ‘পবিত্রতার’ বুকনি ঝেড়ে বিকিয়ে যাওয়া, গান্ধীবাদের কোল আলো করা বামপন্থীরা শানান দুই দফা আক্রমণঃ একদল বলেন ‘আজকের দিনে’ বিপ্লব বা ক্ষমতাদখল হলো ‘মিথ’; ‘আজকের দিন’-টা কেনো যে আলাদা, আর কেনোই বা হঠাৎ আজকে এসে বিপ্লব ‘মিথ’ হয়ে গেলো— এপ্রশ্নের যদিও কোনও সদুত্তর মেলেনা!
অন্যদল, যাঁরা বাম-মহলে অনেক বেশী পরিচিত ‘মার্ক্সবাদী’ নামে, কমিউনিষ্ট তাত্ত্বিক নামে, তাঁদের আক্রমণটি যদিওবা আরও ভয়ানক ও ছলাকলায় ভরা৷ তাঁরা বলেন, বিপ্লব মানে হলো ‘পরিবর্তন’, আর তাই তাকে যে সশস্ত্র অভ্যুত্থানই হতে হবে তার কোনও মানে নেই৷ দুনিয়ায় কোথায়, কোন পরিবর্তন বিনা অভ্যুত্থানে, বিনা সশস্ত্রতায় হয়েছে? আর আজকের দিনে যদি নতুন কিছুও করতেই হয়, তবে তার কারণটাই বা কী, এসব প্রশ্নের উত্তরে এঁরা ন্যাকামোর নাকিকান্নায় দোহাই পাড়েন ‘পরিস্থিতির’! স্পষ্টতই এই দুই লাইনই হলো সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসকের সাথে আপোষরফা ও মীমাংসার লাইন। মেহনতীর রাজনৈতিক উত্থানের বিরুদ্ধে এগুলি হলো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
মেহনতীর এই দুই জানি-দুশমনকে নাঙ্গা ক’রে এই লেখায় আমরা প্রমাণ করবো যে, প্রথমত, একুশ শতাব্দী ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য বিশ্বের দেশে দেশে সমাজবিপ্লবের যুগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে আর কীভাবে ভারত তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে; এবং দ্বিতীয়ত, হিংস্র ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লব ক’রে মেহনতীরাজ কায়েম করতে গেলে সশস্ত্র ও জঙ্গি অভ্যুত্থানকে ছেড়ে বা তার প্রতি কোনও ‘না’ রেখে এক কদমও এগোনো সম্ভব নয়৷
এই গোটা বিশ্লেষণটাকে আমরা দাঁড় করাবো মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের উপর, আমাদের সমালোচকদের-ই ‘মনিবদের’ দেওয়া তথ্য থেকে৷ মজুরবিপ্লবের মহান দর্শনই যে আমাদের ছোঁড়া সমস্ত বোমার আসল রাসায়নিক, তার স্বপক্ষে আমরা প্রমাণ হাজির করবো এই লেখায়৷
আজকের ফ্যাসিভারতের উত্থান
২০২৩ সাল চলছে। ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ ক্রমশ তার ‘ফ্যাসিস্ট যাত্রায়’ যথাযথ মর্যাদার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে চলেছে৷ এদেশের পার্লামেন্টে গত সাত-আট বছরে বিজেপির নেতৃত্বে একের পর এক চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, চূড়ান্ত শ্যভিনিস্ট ও চূড়ান্ত সাম্রাজ্যবাদী বিল পাশ হয়ে এসেছে৷ এ ঘটনায় অবশ্য এক অদ্ভুত ও অভূতপূর্ব বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে পার্লামেন্টের অ-বিজেপি দক্ষিণপন্থীদের থেকে, অর্থাৎ কিনা জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ সমস্তকটা জাতীয় ও আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলের থেকে৷ বিজেপির সবকটি ফ্যাসিবাদী প্রস্তাবে এবং বিলে হয় তাঁরা মৌন, নয়তো বা ‘মেকি-বিরোধ’-এর নামে ছলে-বলে-কৌশলে ‘অ্যাবসেন্ট’ বা ‘অ্যাবস্টেন্ট’-এর পথ বেছেছেন৷ কিছুক্ষেত্রে অবশ্য বীরদর্পে বিজেপি সরকারের ‘জনদরদী’ পদক্ষেপের পাশে উদ্বাহু নৃত্যও করেছেন৷ বিজেপি ও তার থিঙ্কট্যাঙ্ক আরএসএস-এর এসব জাতীয় ও প্রাদেশিক এজেন্টরাই আবার এদেশের মেইনস্ট্রীম কমিউনিষ্ট নাম্নী দলগুলোর চোখে ফ্যাসিবাদকে রুখে দেওয়ার ‘ন্যাচারাল অ্যালাই’, যুক্তফ্রন্টীয় মিত্র, সংগ্রামী সখা, বন্ধু, কমরেড ইত্যাদি! মোটকথা, পার্লামেন্টে ফ্যাসিস্ট ও অফ্যাসিস্ট (?) দুই শক্তিই ফ্যাসিবাদের পক্ষে নিজের কর্মোদ্যমের প্রমাণ দিয়েছেন। সব পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন৷
ফ্যাসিবাদের কথা উঠলেই আমাদের দেশের তথাকথিত কমিউনিষ্ট পার্টিগুলির নেতারা (তা সে পার্লামেন্টারি হোন বা ‘বিপ্লবীবুলিধারী’!) প্রধাণত তিনটি বুলি আউড়ে থাকেন৷ এক, ফিনান্স পুঁজির সঙ্কট; দুই, চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন; আর তিন, উগ্র হিন্দুত্ব৷ যদি ‘ফ্যাক্ট’-এর দিক থেকে ভাবি, তবে কথাগুলি আলবাৎ সত্য। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়! আর কে-ই বা অস্বীকার করবে যে অসম্পূর্ণ সত্য আসলে মিথ্যারই প্রশ্রয়দাতা!
ভারতে আজকের ফ্যাসিবাদ দানা বেঁধেছে ফিনান্স পুঁজির গভীর সঙ্কট থেকেই, কিন্তু তেমনভাবে নয়, যেমনটা গত শতাব্দীতে ইউরোপে দেখা গেছিলো। ফিনান্স পুঁজির সেদিনের চরিত্র থেকে আজকের চরিত্রে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে তার জাতীয় চরিত্রই ছিলো কর্তৃত্বময়; কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরে, এবং বিশেষ ক’রে শেষ তিনদশকে ট্রান্স-ন্যাশনাল কর্পোরেশনের গঠন ও জাতিরাষ্ট্রের সীমানা ভেঙ্গে পুঁজির অবাধ গতি ফিনান্স পুঁজিকে ক’রে তুলেছে আন্তর্জাতিক। নিঃসন্দেহেই আজকের যুগ হলো আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির কর্তৃত্বের যুগ। এই অর্থনৈতিক যুগটিরই রাজনৈতিক রূপ হলো নয়াউদারবাদ। এখন ফিনান্স পুঁজির এই আন্তর্জাতিকীকরণ স্বাভাবিকভাবেই আরও একটি ব্যপার ঘটিয়েছে। সঙ্কটের বিশ্বায়ণ! বিশ্বায়িত পুঁজির হাত ধ’রে সঙ্কটও আজ ক্রমশ এক দেশ থেকে অন্যদেশে বিভিন্ন সময়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সঙ্কট থেকে সামগ্রিকভাবে মুক্তির কোনো পথ এই ব্যবস্থার কাছে নেই। সাময়িকভাবে যে ‘ম্যানেজ’ সে করছে, সময়ের সাথে ব্যুমেরাং হয়েই ফিরে আসছে সে সঙ্কট। ফিরছে সময়ের চক্রাকারে, এবং আগের তুলনায় আরও গভীরভাবে। ফলে, ক্রমশ আজকের নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি স্থায়ী সঙ্কটের যুগে প্রবেশ ক’রে যাচ্ছে! আজকের ফ্যাসিবাদ জন্মই নিচ্ছে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির এই চিরস্থায়ী হতে বসা সঙ্কটের পেট থেকে! খোলসা ক’রে বললে আজকের বুর্জোয়া গণতন্ত্র, আজকের উদারবাদই, নয়াউদারবাদই তার মা।
সংকট আজ একটি বা দুটি জাতিরাষ্ট্রের ব্যপার নয়, ব্যপার নয় পুঁজির এক বা দুটি শিবিরের। এ এমন এক সঙ্কট যাতে আকন্ঠ ডুবে আছে ফিনান্স পুঁজির সব শিবিরই। আর সেজন্যই আজকের যুগে ফ্যাসিবাদের বিপরীতে বুর্জোয়াদের, ফিনান্স পুঁজির কোনও স্বতন্ত্র লিবারাল শিবিরের বাস্তব অস্তিত্ব সম্ভবই নয়! বরং পুঁজির সব শিবিরই আজ এককাট্টা হয়েছে সঙ্কটের সমস্ত বোঝাকে চরম হিংস্রতার সাথেই মেহনতী জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে! এ তাদের ‘পছন্দ’ নয়, বরং এই ভয়াল সঙ্কটের ‘বাধ্যবাধকতা’!
ফ্যাসিবাদের আমদানী হচ্ছে অবশ্যই মতাদর্শগতভাবে ফ্যাসিস্ট ঝোঁক আছে এমন কোনও রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বেই; কিন্তু তার বিপরীতে যে সমস্ত বুর্জোয়া শক্তিগুলি রয়েছে, দেখা যাচ্ছে যে ফ্যাসিস্ট শক্তিটির সাথে তাদেরও কোনও লাইনগত বিরোধ-ই নেই! ভারতীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টটি এর এক অতি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেমনটা উপরে ব্যখা করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ থেকে আরো একটি ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যায়! আজকের পার্লামেন্টে বাস্তবেই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে কোনও বুর্জোয়া শক্তি নেই! অন্যদিকে, আমাদের মতো দেশে যেহেতু কমিউনিষ্ট নামের পার্টিগুলিও সেইসব ‘অ-ফ্যাসি’ বুর্জোয়াদেরই লেজুড়ে পরিণত হয়েছে, ফলে পার্লামেন্টে ফ্যাসিস্টদের জন্য আসলে কোনও বিরোধী শক্তিই নেই! আর তা নেই বলেই, তার আজকের পার্লামেন্টকে ভাঙ্গার দরকারও নেই! বরং পার্লামেন্টের আড়ালে, ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’-এর আড়ালে সে অতিসহজেই চাপিয়ে দিতে পারে জনসাধারণের উপর সবধরণের ফ্যাসি-নিপীড়ন। আজকের যে ভারতীয় পার্লামেন্ট আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা মোটেও বুর্জোয়া উদারবাদী গণতন্ত্র নয়, বরং এ হলো গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে ফ্যাসিস্ট স্বৈরতন্ত্রই!
পুঁজির আজকের দিনের এই বিশ্বব্যপী অসামালযোগ্য সঙ্কট একটা বিষয়কে স্পষ্ট ক’রে দেয় —ব্যবস্থাটা মুমূর্ষু, জ্বরাজীর্ণ! এই ব্যবস্থা ধুঁকছে বলেই ফ্যাসিবাদ আমদানী করছে, নিজের শেষ ‘লাইফ-সাপোর্টিং সিস্টেম’ হিসেবে। ফলে, মৃত্যুর সবরকম বস্তুগত সম্ভাবনা নিয়েই সে বেঁচে আছে, শুধু তার হন্তারকটি এসে উপস্থিত হয়নি বলেই! আর যেহেতু, তার জরাকে মুছে আগের যৌবনে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ফেরার কোনও পথ আর খোলা নেই, তাই তাকে খতম ক’রে পুঁজিবাদকে মূল থেকে উপড়ে ফেলাই আজ সময়ের দাবী, শ্রমিকশ্রেণীর বিজ্ঞানের দাবী। স্বভাবতই, এ দাবী হলো মজুর-বিপ্লব ও মেহনতীরাজের দাবী, তাকে কায়েম ক’রে আগামীর শোষণ-নিপীড়নহীণ সমাজের দাবী— বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবী।
মেহনতীর উপর অভূতপূর্ব সশস্ত্র দমন
পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা হলো নিরানব্বই জনের খাটুনি দুয়ে এক-একজনের লুটেপুটে খাওয়ার ব্যবস্থা। মুষ্টিমেয় কয়েকজন, যাদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে উৎপাদনের যাবতীয় উপায় ও উপকরণগুলি, গোটা সমাজের বাদবাকীদের তাদের মজুরী দাসে পরিণত করাই এ ব্যবস্থার মোদ্দা কথা৷ স্বভাবতই, এ সমাজ সিংহভাগ মেহনতী জনতার উপর তীব্র দমন ছাড়া টিঁকতে পারেনা৷ সংখ্যায় হাতে গোনারা যখন এক বিরাট বড়ো জনসমষ্টিকে শোষণ করতে চায়, তখন দমনের স্বরূপটিও হয়ে ওঠে চূড়ান্ত মাত্রাতেই সশস্ত্র! শুধু পুঁজিবাদই নয়, তার আগেও সমস্ত শ্রেণীসমাজের ক্ষেত্রেই এটা খাটে৷ যেকোনও শ্রেণীসমাজেই রাষ্ট্রের এই সার্বজনিক-দমন-যন্ত্রের দরকার পড়ে৷ ফর্মের দিক থেকে তা নিজেকে দাঁড় করায় ‘সক্কলের ঊর্ধ্বে, সক্কলের তরে’ মার্কা ভণ্ডামিতে, আর কন্টেটের দিকে খিদমত করে শাসকশ্রেণীর। পুঁজিবাদী সমাজে এই সার্বজনিক-দমন যন্ত্রটি অতীতের যে কোনও সমাজের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী আর অনেক বেশী হিংস্র!
এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই যখন তার ফ্যাসিস্ট দশায় উত্তোরিত হয় তখন তাকে চাপাতে হয় সবধরণের শ্যভিনিস্ট, সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল উৎপীড়নের প্রকাশ্য সন্ত্রাসী একাধিপত্য৷ ফলে তার সশস্ত্রতার মাত্রাও পুঁজিবাদের সাধারণ অবস্থা থেকে উত্তোরিত হয় এক অভূতপূর্ব তেজি স্তরে। আজকের ফ্যাসিবাদ, যেমনটা উপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, নয়াউদারবাদের অসামালযোগ্য সঙ্কটের ফলশ্রুতি৷ ফলে সে জিঘাংসাকেই ক’রে তোলে মূলমন্ত্র। এ কথার সত্যতার প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। তবু আমাদের ‘আকাদেমিক মনন’ আর খণ্ডিত সত্যের বদাভ্যাসের ভয়ে কিছু তথ্য না দিয়ে থাকা মুশকিল! গত দু দশকে ভারতীয় ইউনিয়নের সশস্ত্রতা ঠিক কীভাবে বেড়েছে, আর ২০১৪ সালের পরবর্তী সময়ে তার গতি কীভাবে ত্বরাণ্বিত হয়েছে, কতগুলো তথ্য দিয়েই না হয় সেটা দেখা যাক।
তথ্য ১
ভারত এইমুহুর্তে প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয়ের নিরিখে দুনিয়ায় তিননম্বরে, ইউএস ও চীনের পরেই। এদেশে অস্ত্রশস্ত্র ও মিলিটারি-পুলিশ খাতে বাজেটের যে হিসেব আমরা পাচ্ছি, ২০১৪ সালের পর থেকে তা এক লাফে বেড়েছে চারগুণ। নীচে আমরা সে তথ্য হাজির করলাম।

চিত্র ১ – সেনাখাতে চারদশকের ব্যয়বৃদ্ধি ধারা [৩]
তথ্য ২
কাশ্মীরে ৩৭০ বিলোপ ক’রে ভারত সম্পূর্ণভাবেই মানবাধিকারের শেষ সীমাও লঙ্ঘন করেছে। আফস্পার নামে সাধারণ মানুষের জীবন, মহিলাদের ইজ্জত সব নিয়েই খেলে চলেছে ভারতীয় ইউনিয়ন ও তার সশস্ত্র-বাহিনী। এই খেলাতেই ইন্ধন জোগাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলো শাসকের সাথে টেবিলে সেটিং করেই। এই গোটা খেলার বোড়ে হিসেবে মরছে স্রেফ সাধারণ মানুষ । কাশ্মীরে বিগত ২৩ বছরে সেনা হস্তক্ষেপে মৃত্যুর মোট অফিশিয়াল সংখ্যা ২২, ১২৮ জন। এই কর্মযজ্ঞে মোট ৪৯১৮ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর অফিশিয়াল হিসেব আছে! [৪] নিখোঁজ, গুম, ইত্যাদি ব্যপারে সাধারণ মানুষের ডেটাবেস পাওয়া মুশকিল। যদিওবা মৃতের সংখ্যা দেখে সেই সংখ্যা সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
তথ্য ৩
শুধুই কি কাশ্মীর? সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের আর এক কেন্দ্র হলো আসাম-সহ দেশের উত্তর-পূর্বের পার্বত্য রাজ্যগুলো। সেখানেও জারি আছে আফস্পা। গতবছর নাগাল্যাণ্ডে ৬ জন কয়লাশ্রমিককে নৃশংসভাবে খুন করে ভারতীয় সেনা। পরে জনগণ প্রতিরোধ করলে ১২ জন সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হয়। সে ব্যপারে সংসদে মিথ্যাচার ক’রে মুখ পোড়ে দেশের দাঙ্গাপুঙ্গব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর। [৫]

চিত্র ২ — উত্তরপূর্ব ভারতে আফস্পা শাসনে সাধারণ মানুষের মৃত্যু [৬]
তথ্য ৪
রাষ্ট্রের সশস্ত্র নিপীড়নের আরেকটি অন্যতম দিক হলো মহিলাদের উপর সেনা দিয়ে যৌন-নির্যাতন। এ কাজে উর্দিধারী গুণ্ডারা, পুলিশ-মিলিটারীরা কেমন বীরপুঙ্গবতা দেখাচ্ছেন, সেইটেও দেখে নেওয়া যাক। ২০০০-এর নভেম্বর থেকে ২০২০-এর অক্টোবরের মধ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে সেনাদের করা যৌন অত্যাচারের যে অতিসামান্য নথিভুক্ত হয়েছে, স্রেফ সেটুকুর তথ্য দেখলেই চমকে উঠতে হয়! [৭]

তথ্য এ-ও বলছে যে মোট ১১৪ টি কেসের ২২৪ জন মহিলা নিগৃহীত হয়েছেন যাঁদের ৩৫%-এর বতস ৭ থেকেও ১৭-এর মধ্যে এবং ৭০%-ই আদিবাসী নারী।
তথ্য ৫
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গোপনে খুন করার বাহানায় ভারতীয় ইউনিয়ন আমদানী করেছে ইউএপিএ-র কালা কানুন, যা দিয়ে বর্বরতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে গণ-আন্দোলনের কর্মীদের। সে তথ্যকে এড়াবেন কীভাবে আমাদের শান্তিবাদীরা?

চিত্র ৩—ইউএপিএ’র নামে নির্বিচার আটক [৮]
তথ্য ৬
আমাদের দেশে আজ কাস্টোডিয়াল মার্ডার বা পুলিশ হেফাজতে খুনকে একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। দেখে নেওয়া যাক সে কাজে কেমন হাত পাকিয়েছেন আমাদের পুলিশ-আর্মি বাহিনী! ২০২০থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশ ও জুডিশিয়াল হেফাজত মিলিয়ে মোট ৪৪৮৪ টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে ২৩৩ জন পুলিশের এনকাউন্টারে খুন হয়েছে। এ কথা কোনও বামপন্থীর নয়, সরাসরি ফ্যাসিস্ট পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিজেপির মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই এই সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন। ২০১৯-২০ এর তুলনায় ৬০% ও ২০২০-২১-এর তুলনায় ৭৫% বেড়ে যাওয়া পুলিশি হেফাজতের মৃত্যুতে আজ অব্দি একজন পুলিশের বিরুদ্ধেও কোনোও ব্যবস্থা নেয়নি সরকার [৯]! একে সশস্ত্র নিপীড়ন বলে না মানা আসলে মনুষ্যত্বের সাথেই বেইমানী!
মাহেন্দ্রক্ষণ
উপরের তথ্যগুলি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, গলা অব্ধি সঙ্কটে ডুবে থাকা আজকের নয়াউদারবাদী ভারত তার মাত্রাছাড়া সশস্ত্রতা নিয়েই মেহনতী জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাঁচতে সে মরিয়া, তাই ডেকে আনছে ফ্যাসিবাদ। অন্যদিকে, পার্লামেন্টেও ‘ফ্যাসিবাদ’-এর নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়ন ঘটে গেছে; পার্লামেন্টারি ব্যবস্থাকে সে এখন কাজে লাগাবে তার সবরকম জ্বি-হুজুরিতে! সেখানে ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডার বাইরে অন্য কোনো বক্তব্যের জায়গাই নেই। তার উপর বৈজ্ঞানিক অনুমান অনুযায়ী সামনের বছর, ২০২৪ সালে এই শতাব্দীর তৃতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটটি আছড়ে পড়তে চলেছে, যা ধারে ও ভারে হতে পারে গত দুটি সঙ্কটের (২০০৮ ও ২০১৬) চেয়ে অনেক মারাত্মক! দুনিয়ার তাবড় নীতিনির্ধারকেরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন এ সঙ্কটের চরম প্রভাব থেকে বাদ পড়বেনা ভারতও।
ফলে ভারতীয় জনতা একদিকে যেমন দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র সশস্ত্র শাসকের স্টেইনগানের মুখে; তেমনই অন্যদিকে সেই শাসকও আজ সম্পূর্ণ ক্ষতবিক্ষত, ভীত ও সন্ত্রস্ত; মরতে বসেছে সে! আর এই গোটাটাই আবার ঘটছে এক বিশ্ব-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে। ফলে মেহনতীর জন্য, তার অগ্রনী বাহিনীর জন্য এইটেই হলো মজুরবিপ্লবের সবচেয়ে অব্জেক্টিভ সময়, মাহেন্দ্রক্ষণ! এটাই সেই সময় যখন নিজের সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার জায়গায় রাষ্ট্র নেই; সে তার ইতিহাসের দুর্বলতম মুহুর্তে এসে পৌঁছেছে৷ ফলে তাকে মারতে দরকার শুধু একটা সজোর ধাক্কার, সবল উচ্ছেদের।
লেনিন লিখছেন, “রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, সশস্ত্র লোকের বিশেষ বাহিনীরূপে একটি বিশেষ শক্তির সৃষ্টি হয়; এবং শাসকশ্রেণী তার খিদমতগার সশস্ত্র লোকের বাহিনীকে পুণ:প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এবং নিপীড়িত শ্রেণীও কীভাবে ঐধরণের এমন একটা নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে প্রয়াস করে, যে-সংগঠন শোষকের বদলে শোষিতদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম— প্রত্যেক বিপ্লবই রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিধ্বস্ত ক’রে সুস্পষ্টরূপে আমাদের তা দেখিয়ে দেয়” [১০]। অর্থাৎ শাসকের ‘সার্বজনিক দণ্ড-যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে নিপীড়িতের সশস্ত্র হওয়ার ঘটনা যে ঐতিহাসিক সত্য, সেটাকেই খোলসা করছেন লেনিন।
উচ্ছেদের প্রশ্ন উঠলেই, ব্যবস্থাটার আমূল পরিবর্তনের কথা উঠলেই, সাথে সাথে একটা প্রশ্ন এসে উপস্থিত হয়। তার পদ্ধতির প্রশ্ন৷ বলাই বাহুল্য যে এই প্রশ্ন যত না মজুরবিপ্লবের সঙ্কল্প থেকে আসে, তাকে রূপায়নের ইচ্ছা থেকে আসে, তার চেয়ে অনেক বেশী আসে বিপ্লবী অভীপ্সাটিকে দমিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে৷ কিন্তু কোনও তাত্ত্বিক ভাঁড়ামো না করেই এই জলবৎ তরল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়৷ শাসকশ্রেণীর সবল উচ্ছেদ ও তারজন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থান৷ শ্রমিকশ্রেণীর জঙ্গি লড়াই ও তার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা উঠলেই প্রতিপক্ষের যে ‘অসম্ভাব্যতার’ ছেঁদো যুক্তিগুলো ধেয়ে আসে, সেগুলিকে উড়িয়ে দিতে দুটো বিষয়ের উল্লেখই যথেষ্ট। প্রথমত, দুনিয়ার ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মানুষের ইতিহাসের সমস্ত সমাজবিপ্লবই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই অর্জিত হয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এমন কোনও বিপ্লব, এমন কোনও শ্রেণীগত উচ্ছেদ ঘটেনি, যা বিনা সশস্ত্রতায় নির্ঝঞ্ঝাটে পুষ্পস্তবক বিনিময়ে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যখনই বিদ্যমান ব্যবস্থার খোলনলচেটা পাল্টাতে মেহনতী এগিয়ে যাবে, মালিকের রাষ্ট্র তাকে অভ্যর্থনা জানাবেনা৷ বরং পুলিশ-মিলিটারি-গোয়েন্দা-আদালত-মিডিয়া-স্কুলকলেজ-হাসপাতাল সব দিয়ে তাদের সমূলে শেষ করতে চাইবে! খুনে রাষ্ট্রের দরজায় নাঙ্গা হাতে টোকা মারবো নাকি বোমা মেরে দরজাটাকেই ওড়াতে হবে, এ কি নেহাৎ-ই শিশুসুলভ প্রশ্নই নয়? উপরে দেওয়া ফ্যাসিভারতের অস্ত্রোন্মাদনা সেই সত্যের একেবারে খাঁটি রূপটাকেই তুলে ধরে৷ পুলিশ, মিলিটারি, ইন্টালিজেন্স থেকে জেলখানা-আদালত সবটাই তার এই জবরদস্তিমূলক মানুষ-খুনে প্রবৃত্তিরই পরিচয় দেয়৷
সুতরাং, সশস্ত্র ফ্যাসিরাষ্ট্রকে জানে মারতে গেলে, মেহনতীর জঙ্গি ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরই প্রয়োজন হবে৷ এটা যুদ্ধই, এবং মেহনতীকে এই যুদ্ধে নিরস্ত্র করার প্ররোচনা আসলে ফ্যাসিরাষ্ট্রেরই বিশুদ্ধ দালালির সামিল; মেহনতীর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের প্রমাণ!
বৈজ্ঞানিক লাইনের প্রশ্ন
সশস্ত্র অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবীই; কিন্তু তা মজুরবিপ্লবের নীতির দিক থেকে আসেনা৷ আসে কৌশলের প্রশ্নে৷ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের হিংস্র আক্রমণের বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই শ্রমিক শ্রেণী অস্ত্র ধারণ করে৷ তাই অস্ত্রের তাৎপর্য চরম, কিন্তু তা বিপ্লবী উদ্দেশ্য ও বিপ্লবের বিজ্ঞানের অধীন। মনে রাখা দরকার অস্ত্র বিপ্লব আনে না, বিপ্লবে অস্ত্রের দরকার পড়ে মাত্র। ‘হেগেলের অধিকার সম্বন্ধীয় দর্শনের সমালোচনার প্রতি অবদান’ শীর্ষক প্রবন্ধের ভূমিকায় মার্ক্স লিখছেন “… সমালোচনার অস্ত্র অবশ্যই অস্ত্রের সমালোচনাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না, বস্তুগত শক্তিকে বস্তুগত শক্তি দ্বারাই উৎখাত করতে হবে; কিন্তু তত্ত্বও বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে যখনই তা জনগণের চেতনার অধিকারে আসে …”। অর্থাৎ, সমাজবিপ্লবের বিজ্ঞান যখনই মেহনতীর চেতনায় সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়, যখনই মেহনতী তাকে আঁকড়াতে শেখে, তখন সেটিও একটি বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়। পরিণত হয় অস্ত্রে।
আমাদের দেশের মাওবাদী পার্টির নেতৃত্বে যে সশস্ত্র আন্দোলন চলছে, সেটিকে এই দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন৷ শুরুর দিকে তাঁরা দেশের দক্ষিণপূর্বের এক বিরাট অঞ্চলজুড়ে এক ব্যপক সংগঠন গড়ে তোলেন৷ কিন্তু শেষ এক দশকে তাদের উপর রাষ্ট্র যখন ব্যপক নিপীড়ন নামিয়ে আনলো, তাকে প্রতিহত করার জায়গায় তাঁরা আর রইলেন না। ফলে অচিরেই তাঁদের সংগঠন আজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷ শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে সে সংগঠন টিঁকবেও না, বরং আরও ক্ষইবে৷ একুশ শতকের ফিউচারিস্টিক স্টক মার্কেট আর ডলার-রিজার্ভের খেলার যুগে, যাঁরা এখনও কৃষিতে আধা-সামন্ততন্ত্র দেখেন, আর দেশে স্বাধীনভাবে পুঁজির বিকাশকেই মেনে নিতে পারেননা; বিশ্বায়িত পুঁজি ও দেশের পুজিবাদের বিকাশের সম্পর্কই যারা বুঝে উঠতে পারেন না; শ্রমজীবী মানুষকে প্রাত্যহিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ভাবে পরিপক্ক করে তোলার পরিশ্রমটাতেই যাঁদের আলস্য, — আধুনিক নয়াউদারবাদী ভারতরাষ্ট্রকে উৎখাত করার কোনও যোগ্যতাই তাঁরা তৈরী করতে পারেননি৷ অস্ত্রের জোরে, একটি নির্দিষ্ট মুক্তাঞ্চলে গণভিত্তির জোরে তাঁরা বড়োজোর রাষ্ট্রের জন্য নিজেদের ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই দেখাতে পারেন, দেখিয়েওছেন। কিন্তু অচিরেই রাষ্ট্র তাঁদেরই ব্যবহার করেছে৷ গণবিচ্ছিন্ন ও অবৈজ্ঞানিক লাইন নিয়ে তাঁদের কমিউনিষ্ট পরিচিতি ও ‘বিপ্লব’-এর ঘোষনাকে রাষ্ট্র ব্যবহার করেছে তার কমিউনিষ্ট-বিদ্বেষী ও বিপ্লব-বিরোধী প্রোপাগাণ্ডায়৷ পশ্চিমবাংলায় নয়াউদারবাদের বিশ্বস্ত এজেন্ট তৃণমূল কংরেসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জোগানো থেকে শুরু করে ছত্তিশগড়ে বিজেপি সাংসদের হয়ে ‘সুপারি কিলিং’— ‘উদ্দেশ্যহীন সশস্ত্রতা’ ও রাজনৈতিক-অজ্ঞতা তাঁদের চরম রাজনৈতিক বিচ্যুতিকে স্পষ্ট করেছে৷ বিপ্লবের বিজ্ঞানটাকে আয়ত্ত্ব না করতে পারলে, তার অব্জেক্টিভিটিকে না বুঝলে, তা যে এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে, এদেশের মাওবাদীরা তার জ্বলন্ত প্রমাণ৷ একই কথা খাটে মাওবাদীদের ‘তুতো-ভাই’, এরাজ্যে তৃণমূলের বিশ্বস্ত স্লিপারসেল নকশালপন্থীদের বেলায়ও!
মোদ্দাকথা
আজকের ফ্যাসিবাদকে রোখার একমাত্র পথ মজুরবিপ্লব৷ ফ্যাসিরাজের বিরুদ্ধে চাই মেহনতীরাজ৷ স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবের সব সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে নষ্ট করতে ফ্যাসিরাষ্ট্র ঝাঁপাবেই, বের করে আনবে তার হিংস্র দাঁত-নখ। সে আক্রমণ সামলে ওই দাঁত ভাঙতে হলে , ওই নখ ওপড়াতে হলে, সশস্ত্র অভ্যুত্থানই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র বাস্তবতা। অন্যদিকে বুর্জোয়া পার্লামেন্টে তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কাজটাকে খাটো ক’রে দেখা বা খারিজ করা (যেমনটা এদেশের মাওবাদীরা করেন) জনতার উপর তাদের সংসদীয় অত্যাচারের রাস্তাকে খোলা ছাড়ারই এক নাম! মেহনতীর আজকের শ্রেণীসংগ্রামের অনুশীলন তাই সংসদীয় ও অতিসংসদীয়, বিতর্ক ও বিদ্রোহ, নিয়মতান্ত্রিক ও বিপ্লবী — একইসাথে এমন দুই লাইনের সাঁড়াশিপ্যাঁচে রাষ্ট্রের টুঁটি চেপে না ধরে সম্ভবই নয়৷ একদিকে মেহনতীকে বিজ্ঞানের দিক থেকে, তত্ত্বের দিক থেকে নিজেকে এবং নীতির দিক থেকে নিজের রাজনৈতিক অস্ত্রকে ধারালো করতেই হবে৷ অন্যদিকে, রাষ্ট্রের সশস্ত্র আক্রমণের সামনে সশস্ত্র প্রতিরোধের ব্যারিকেডও গড়ে তুলতে হবে৷ জনগণের এই সশস্ত্র সংগঠন যা মজুরবিপ্লব ও মেহনতীরাজের আশু কর্মসূচি ও লক্ষ্য নিয়েই গড়া, তাকে পরিচালিত হতে হবে আজকের যুগের শ্রেণীসংগ্রামের বিজ্ঞান দিয়ে।
এক শতক আগে গান্ধী হাজির করেছিলেন রাজনীতির সাথে অধ্যাত্মের এক বকচ্ছপ দর্শন৷ আজ একুশ শতকে তাঁরই উত্তরসূরীরা তার চেয়েও অনেক নীচতার সাথে, তার চেয়েও অনেক ঘৃণ্যতার সাথে সেই দর্শনেরই পুণরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে ‘নিরস্ত্র বদল’-এর সোনার পাথরবাটি দিয়ে। ফিরিয়ে আনতে চাইছে গান্ধীর নিরস্ত্রতার ভাববাদকে, যা শাসকের সবচেয়ে বড়ো বস্তুবাদী অস্ত্র। বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে সমূলে শেষ করতে গেলেও বিপ্লবীর বেশ ধরতে হয়৷ লেনিন দেখিয়েছিলেন কীভাবে মার্ক্সবাদকে খতম করতে সবার আগে তার ‘তীক্ষ্ণ খোঁচাগুলোকে ভোঁতা’ করতে হয়; এবং কেনো সে কাজ মার্ক্সবাদের নাম নিয়েই করা হয়!
সেদিন বোহরা বা ভগৎ-রা আসল বোমাটি ফাটিয়েছিলেন দেশের চেতনজগতের অন্দরমহলে৷ চেতনারই অস্ত্রে শাণ দিয়েছিল চিটাগং থেকে বোম্বে, তেভাগা থেকে তেলেঙ্গানা৷ আজকের মেহনতী জনতাকে ও তাদের সারথি হয়ে দাঁড়ানো আজকের ভগৎ-ভগবতীদেরও ফাটাতে হবে দু-দুটি চেতনবোমা। ঠিক সেদিনের মতই। তার একটি নাঙ্গা ক’রে দেবে শান্তিবাদের নামে ‘বিপ্লবের ভেকধারী’ পালতুদের আসল চেহারাটা; আর অন্যটি ফাটিয়ে দেবে সঙ্কটের চাপে খোকলা হয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট রাজপ্রাসাদের দেওয়াল৷ মেহনতীর ক্ষমতাদখল ও চূড়ান্ত বিজয়ই ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো সত্য হয়ে দেখা দেবে, কেননা কেবল তার ছোঁড়া বোমারই আছে আমূল পরিবর্তন ও নতুন নির্মানের দর্শন!
তথ্য ও রেফারেন্সঃ
[১] গান্ধী রচনাবলী (৪৮তম খণ্ড)।
সূত্রঃ https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/mahatma-gandhi-collected-works-volume-48.pdf
[২] https://www.marxists.org/hindi/bhagat-singh/1930/bum-ka-darshan.htm
[৪] https://www.satp.org/datasheet-terrorist-attack/fatalities/india-jammukashmir
[৬] https://www.satp.org/datasheet-terrorist-attack
[৮] ও [৯] https://ncrb.gov.in
[১০] লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, এনবিএ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১১।