বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে তৎকালীন আরবিআই গভর্নর রঘুরাম রাজনের মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সরকার চাইছিলো সুদের হার কমিয়ে লোন নেয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে স্টক ও ডেরিভেটিভ মার্কেটকে চাঙ্গা করতে যাতে দেশের অর্থনীতির গ্রোথ রেট বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, রাজন ইনফ্লেশন ঠেকাতে চাইছিলেন সুদের হার একটি ন্যূনতম উচ্চসীমায় বেঁধে রেখে, লোন নেয়ার প্রবণতা কমিয়ে, বাজারে মুদ্রার চলাচল সীমিত রাখার মাধ্যমে (‘জবরদখল’ ৩-য় বর্ষ, ১০ম সংখ্যা), কারন দুনিয়া জুড়ে আর্থিক সংকট আসতে চলেছে এই ছিল তাঁর অনুমান। এই সংঘাতের অনিবার্য ফল হয় রাজন-এক্সিট তথা ‘রেক্সিট’। নতুন গভর্নর হন উৰ্জিত প্যাটেল, কিন্তু উৰ্জিত-জমানাতেও রেট কাট-এর লাগামছাড়া প্রবর্তন সম্ভব হয়নি। আবার তাঁর সময়েই কালো টাকা উদ্ধারের নামে ‘নোটবন্দী’-র মত জনবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা ছিল আসলে আর্থিক সংকটে বাজারে মুদ্রার চলাচল সীমিত করে ‘মার্কেট স্টেবিলাইজেশান স্কিম’-এর মাধ্যমে ফাটকা কারবারকে রক্ষার কর্মসূচী। কালো টাকা ফেরার আশায় সাধারণ মানুষ সকল প্রকার হয়রানি সহ্য করতে রাজি থাকলেও দেখা যায় শেষ অবধি বিজয় মাল্য, মেহুল চোকসি, নীরব মোদীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ! দেশের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ও ব্যাঙ্কের সংকট-পরিস্থিতিও সামনে উঠে এসেছে সাম্প্রতিককালে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আর্থিক সংকট জুজু হয়ে উঠেছে মোদী-সরকারের। মহান অর্থনীতিবিদদের সামনে রেখে চালানো সমস্ত এক্সপেরিমেন্টই তাঁর ফেল করেছে। এবং ফলে সরকারের উপর মানুষের ক্ষোভ যে বাড়ছে বই কমছে না, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল সম্প্রতি প্রকাশিত নির্বাচনী ফলাফলেও। এমতাবস্থায় উর্জিত পটেলের সরে দাঁড়ানোর খবরে প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন থেকে মনমোহন সিং সকলেই শঙ্কিত। এই প্যাটেল-এক্সিট তথা ‘পেক্সিট’-ই কারন কি শঙ্কার?
পরবর্তী গভর্নর : শক্তিকান্ত দাস, অর্থ দফতরের প্রাক্তন সচিব তিনি। তাঁর পূর্ববর্তীদের তুলনায় অর্থনীতিতে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি নেহাতই শিশু। অর্থনীতিতে নয়, ইতিহাসে মাস্টার্স, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি এই পদে বসার যোগ্য কি না সেটা সময়ই বলে দেবে।
কিন্তু শঙ্কার কারন কি সেটাই? নাকি সম্ভাব্য রিসেশন? কারন গভর্নর হিসাবে প্যাটেল বারংবার বাধার দেওয়াল তোলা সত্ত্বেও শীর্ষ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারের ভাগ পেতে মরিয়া কেন্দ্র। কেন তার এই মরিয়াপনা যাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিতর্কিত ৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করার জন্য স্বাধীকারে হস্তক্ষেপ করতেও পিছপা হল না মোদী সরকার ! অনেকেরই প্রশ্ন তাই, ১৪ ডিসেম্বরের বোর্ড বৈঠকে এই চাপ আরও বাড়বে আঁচ করেই কি শেষমেশ সরে দাঁড়ালেন উর্জিত?
ভারতের অর্থনীতিতে বর্তমান গভর্নর শক্তিকান্ত দাস অবশ্য চেনা মুখ। নোটবন্দীর সময়ে সরকারের হয়ে বিবৃতি দিয়ে বেড়িয়েছেন। জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি এই আমলা ১৯৮০ সালের তামিলনাড়ু ক্যাডারের আইএএস অফিসার; ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব নেন। জিএসটি চালুতে এনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ভারতের অর্থসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে, কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ প্রিয়পাত্র এই আমলা। আসলে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতিতে কেন্দ্র-সরকারের পরের পর জনবিরোধী পদক্ষেপের মাধ্যমে কর্পোরেট প্রফিট অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে তার জন্য প্রয়োজন যে একজন ‘ইয়েস স্যার’ প্রকৃতির ‘দাস’, তা আজ স্পষ্ট। শক্তিকান্ত বাবু আখেরে কোন পথে চলেন, সেটার উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে।


