বসন্তে তাপমাত্রা বাড়লে একসময় প্রচুর পলাশ ফুল ফুটতো। বন-পলাশের কথা বলছি, ও’ একটু জংলী প্রকৃতির, যেখান-সেখানে জন্মাতো, বেড়ে উঠত। আবহাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাজারও যখন আগুন, রেশনের সামান্য চালের ভাতে কুলোচ্ছে না পাঁচ জনের শ্রমিক-পরিবারের, কর্মচারীদের দুমাসের বেতন মেরে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে কোনো লেবার কন্ট্রাক্টর, ৱ্যাগপিকার্স ছেলেটার গা যখন জন্ডিসে হলুদ, তখন ও’ ফুটতো। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মতো ওর রঙখানা। বাজার, মহল্লা, রিক্সাস্ট্যান্ড, কারখানার আশপাশ যেন মুড়ে রাখতো। শহরে চাল, সবজি, চিনি, চা আমদানি করা ট্রাকগুলো যখন ভোরে ফিরতো, দেখতাম গাড়ির মাথা ঢাকা ওই ফুলে।
সবাই বলাবলি করতো “আবার কিছু হলো নাকি?”
রোজ কত কিছুই তো আখছার ঘটে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, অফিস-কাছারিতে, কনফারেন্স রুমে, অদৃশ্য বাজারে, অন্ধকার গলিতে। সব খবর কি রাখি আমরা!
রাখতো ঐ বন-পলাশ।
কোথায় কার চোট গেছে টাকা, রক্তের অভাবে কার বৌ গেছে মরে, কোথায় দেওয়ালে বেওয়ারিশ বুলেটের দাগ, খসে গেছে চুন-সুড়কি, সেখানেই ও’ গজিয়ে উঠবে আপনা থেকেই। রাগী বাতাস বইবে তারপর লোকালয়ে। ঘুম হবে না কারোর। এক সময় দেখেছি কোনো কারখানা লকআউটের খবর চাউর হলে তার চারপাশ ভরে যেত ওই পলাশে। বোবা ঝুপড়িটার মাথার ওপরে কাঠফাটা রোদে সটাং দাঁড়িয়ে ও’ ফুলগুলো চোখ রাঙাতো ‘হাইরাইজ’-গুলোকে। প্রোমোটারের কাঙ্খিত জমির দখল নিয়ে নিতো অনায়াসে। পার্কের বেঞ্চেতে ঘুমন্ত কোনো শিশু-শ্রমিকের পাশে হঠাৎ গজিয়ে উঠতো একটা বন-পলাশের ডাল। হাসপাতালের গাফিলতিতে মৃত রোগীর ডেডবডির পাশে কোনো কোনো সময় দেখা যেত একটা পলাশ ফুটে আছে। যেখানে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে ফুটপাথবাসী একটা পরিবারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো কোনো হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি, সেখানটা ভরে গেছিল ও’ ফুলে।
মজার ব্যাপার… কেউ কেউ ডাল ভেঙে নিয়ে গিয়ে লাগতো তিনতলার ছাদে। পথ চলতি কেউ কেউ ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজে নিতো। কেউ কেউ ইংরাজিতে চিঠি লিখতো পৌরসভায় “এই জংলী ফুলের জন্য শহরের শান্তিময় সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে” জানিয়ে। সরকার আর তার মালিকেরা জেরবার হয়ে ভাবত এ গাছের গোড়া কাটবে না আগা। কিন্তু এইমাত্র বন্ধ কোনো স্কুলবাড়ির মাঠে ছিঁড়েখুঁড়ে চাপা দেওয়া হলো তো তৎক্ষণাৎ গজিয়ে উঠলো লেবার-কমিশনের অফিসের সামনে। পুলিশ-স্টেশনের সামনে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হলো তো পরক্ষণেই দেখা গেলো বেড়ে উঠেছে জেলখানার ভিতরে। সংবাদ-সংস্থার অফিসের সামনে উপড়ে ফেলা হলো তো কিছুদিন পরে রেড-লাইট এরিয়াগুলো ছেয়ে গেলো ফুলে। শেষমেশ প্রশাসনের উদ্যোগে যেখানে যত ও’ ফুল চোখে পড়ে, সব খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা হলো, তাতেও সুরাহা হয়নি। কাগজ কম পড়ে গেলো। ফুলের ধাক্কা সামাল দিতে রোজ হিমশিম খেতে হতো। হিমশিম খেয়েছিলেন কবিও, একবার ওর সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে করবী ভেবে বসেছিলেন, কিন্তু ও যে বন-পলাশ!
তারপরে আস্তে আস্তে হাওয়া-বাতাস বদলেছে। এসেছে কালার টিভির সন্ধ্যে। হোলসেল-এ একাকিত্ব কিনে বাড়ি ফিরছে সবাই। মানুষের চোখ আর ফুলগুলোর মাঝে দম্ভের মতো দাড়িয়ে গিয়েছে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হেডিং। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আর শেয়ার মার্কেটের ‘ব্যাহেতি গঙ্গায়’ হাত ধুয়ে নিয়েছে তাদের মালিকেরা। ব্যাংকের খাতায় নন-পারফর্মিং অ্যাসেটের মতোই গুম হয়ে গেছে সেই বন-পলাশ। রাগী বাতাসও আর বয় না। কিছু গোলাপ ফুল দিয়ে এখন ভোটের প্রচার-গাড়ি, রোড-শো সাজানো হয়। বিশেষ অতিথিদের মঞ্চে বরণ করে নেওয়া হয় হাতে গোলাপ ফুলের তোড়া দিয়ে। এখন কোনো কোনো পাঁচতারা রিসর্টের লনে বা কোনো লাখপতির ফার্মহাউসে দেখা মেলে এইসব গোলাপের। ফ্যাকাশে তার রং, নেই কোনও তেজী রূপ, কেমন যেন বনশায়ী স্বভাব, নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। কন্ট্রোল রুম স্বস্তিতে আছে।
কিন্তু সেদিন গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে চোখ আটকে গেলো এক জায়গায়। ঝড়ে ভেঙে পড়া একটা ঘরের ধ্বংস স্তূপ, কিছুটা জঙ্গুলে জমি। সাপখোপের রাজত্ব তাই কেউ মাড়ায়না সেদিক। ইট আর টিনের চালের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট কয়েকটা টকটকে লাল বন-পলাশের মাথা গজিয়েছে। একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে তার পরিচর্যায় ব্যস্ত। পাতায় হাত বুলোচ্ছে। তেলের বোতলে জল ভরে এনে দিচ্ছে গাছের গোড়ায়। পাড়ার লোকেরা ফিরে আসতে বলছে, সাপখোপের ভয় দেখাচ্ছে, বাড়ির লোকেরা ডাকছে, কিন্তু সে আসবেই না। কেন এমন করছে সে? কিসের নেশায় সব ভয় উপেক্ষা করে সে রয়ে গেলো ওখানে! এইটুকু রঙ বাঁচিয়ে কি করতে চায় সে! এইটুকু তো একটা রং-পেন্সিলে থাকে যা দিয়ে পৃথিবী ভরানো তো দূরের কথা একটা খাতাও ভরানো যায়না! তবু কেন এতো উৎসাহ তার! কিসের এতো বিশ্বাস! বুঝিনি! সেই রাতে ঘুমোতে পারিনি আর। মনের ভিতরে হটাত না জানি কেন রাগী বাতাস বইতে শুরু করলো, সারারাত!